Image description

বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী প্রথম দুই মাস বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠজুড়ে গ্রীষ্মকাল। এই সময় সূর্যের প্রচণ্ড তাপে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে জনপদ ও প্রকৃতি। এবার গ্রীষ্মের তাপদাহের বিরুদ্ধাচারণ জনপদকে প্রচণ্ড অতিষ্ঠ করে তুলেছে। তীব্র এ গরমে আকাশে মেঘের দেখা নেই! চৈত্রের খরার তাপদাহ যেন বৈশাখের শুরুতেও চোখ রাঙাচ্ছে! প্রচণ্ড রোদ ও তাপদাহে মাঠ-ঘাট, ক্ষেত-খামার, পথ-প্রান্তর খাঁ-খাঁ। 

গ্রীষ্মকালের নাম শুনলেই হয়তো সবার আগে সূর্যের কঠোর তাপদাহ এবং প্রচণ্ড গরমের কথাই সকলের মনে আসে। এতে যদিও ভুল কিছু নেই, কারণ গ্রীষ্মকাল মানেই রোদের কড়া তাপ, গরম বাতাসের প্রবাহ এবং চৌচির মাঠ। প্রতি বাংলা বছরের সূচনালগ্নে ঋতুরাজ বসন্ত বিদায় নেয় এবং আগমন ঘটে গ্রীষ্ম ঋতুর। কালের ক্রমে গ্রীষ্মকাল হলো বছরের প্রথম ঋতু। সুখময় বসন্ত শেষের দিকে এসে চৈত্র মাসের কাঠফাটা রোদে কান পাতলে গ্রীষ্মের পদধ্বানি শোনা যায়। 

বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসজুড়ে পরিবেশে থাকে গ্রীষ্মকালের রাজত্ব। রোদের অসহ্য দাবদাহে ফুটিফাটা হয়ে ওঠে। সারা দুপুরবেলা ধরে বিভিন্ন অঞ্চলজুড়ে বয়ে চলে তীব্র গরম বাতাস। সমগ্র প্রকৃতির নিস্তব্ধতায় চারপাশকে প্রাণহীন মৃতপ্রায় বলে মনে হয়। প্রকৃতি যেন অসীম পিপাসায় একটু শান্তির বারিধারায় সিক্ত হওয়ার নিমিত্ত অপেক্ষা করে থাকে। গ্রীষ্মের অসহ্য গরমে ভূপৃষ্ঠ যখন ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত, তথা বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে, তখন প্রকৃতির আশীর্বাদের মত আকাশ কালো করে ঘনিয়ে আসে এক মেঘের চাদর, যার সাথে বয়ে আসে শীতল ঝড়ো হাওয়া, প্রকৃতির অঞ্জলি রূপে ধরিত্রীর বুকে নেমে আসে শীতল বারিধারা। 

কবির ভাষায় বলতে হয়, ‘রূপকথার চাদরে মোড়া মেঘগুলোর হঠাৎ আগমন, কালবৈশাখীর ঝড়ো হাওয়া, মালতী লতার সুবেশ সুগন্ধ, এসেছে গ্রীষ্ম এসেছে প্রখর তাপের রানি এসেছে।’ কবির ভাষার সাথে প্রকৃতি যেন তাল মিলিয়ে তার স্বরূপ দেখাচ্ছে বর্তমানে।

সারাদেশে এমন তাপদাহ বিরাজমান থাকার ব্যাপারে আসলে কারণ কি? নানা মুনির নানা মত। চলমান তাপমাত্রা সৃষ্টির কারণ কি হতে পারে সে সম্পর্কে অনেকে অনেক ধারণা করছে।

সাম্প্রতিক সময়ে চলমান তাপদাহ বৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে বলেছেন পরিবেশবিদ ও স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমাদ কামরুজ্জামান মজুমদার। তিনি যে বিষয়গুলোর কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে ব্যক্ত করেছেন তা হলো- চার কারণে দেশের তাপমাত্রা অসহনীয়ভাবে বাড়ছে। এর মধ্যে সবুজায়ন ধ্বংস, নদী, পুকুর খাল বিল ও জলাশয় কমে আসা ছাড়াও বৈশ্বিক, আঞ্চলিক ও স্থানীয় কারণ অন্যতম। 

এ বিষয়ে পরিচালিত তাদের গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরে তিনি বলেন, ঢাকা শহরের ৩৬টি স্থান নিয়ে পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব এলাকায় সবুজের উপস্থিতি রয়েছে সেসব এলাকায় তাপমাত্রা তুলনামূলক কম। এর মধ্যে ৯টিতে ছিল তাপমাত্রা বেশি। কারণ এগুলোতে গাছপালা কম ছিল। আর বাকি ৯টিতে বৃক্ষ বেশি থাকায় তাপমাত্রাও কম ছিল। আর অন্য ১৮টিতে মধ্যমানের তাপমাত্রা ছিল। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে কম তাপমাত্রা ছিল বোটানিক্যাল গার্ডেন ও জাতীয় চিড়িয়াখানায়। 

দ্বিতীয় কম তাপমাত্রার অন্য এলাকাগুলো ছিল, রমনা পার্ক, ধানমণ্ডি লেক পাড়, ক্যান্টনমেন্টসহ কিছু এলাকা। অন্যদিকে সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রার এলাকা ছিল তেজগাঁও, মতিঝিল, মিরপুর, যাত্রাবাড়ীসহ কিছু বাণিজ্যিক এলাকা। এগুলোতে তিন থেকে সাড়ে তিন ডিগ্রি তাপমাত্রার তারতম্য ছিল। এতেই প্রমাণিত সবুজ জলাভূমি তাপমাত্রা কম কিংবা বৃদ্ধির অন্যতম উৎস। 

অন্যদিকে রাজধানীর যানবাহনও তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে সহায়ক হিসেবে কাজ করছে। যার মধ্যে রয়েছে রাজধানীতে চলাচলকারী প্রায় ১৫ লাখ গাড়ি। যার এক-তৃতীয়াংশ ফিটনেসবিহীন চলাচল করছে। এগুলোর ইঞ্জিন প্রচণ্ড পরিমাণে উত্তপ্ত হয়ে বাতাসের সাহায্যে ছড়িয়ে পড়ে শহরকেও উত্তপ্ত করে দেয়। 

চতুর্থ কারণের মধ্যে রয়েছে ঢাকা শহরের পিচঢালা রাস্তা। এই রাস্তা দিনের বেলা উত্তপ্ত হয় এবং রাতের প্রথমভাগ পর্যন্ত তাপ ধারণ করে থাকে। এরপর যখন তা রিলিজ করে তখন তা নগরে তাপ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। এ জন্য রাস্তার ডিভাইডারে গাছ প্রয়োজন। যা উত্তাপ কমাতে সহায়ক। কিন্তু এখন শহরের সৌন্দর্যবর্ধনের নামে ডিভাইডারের গাছগুলো কেটে ফেলা হচ্ছে। তাতে তাপমাত্রা আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে।

প্রকৃতির এই বিরূপ আবহাওয়া একদিকে বৈশ্বিক নানান কারণ অন্যদিকে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বনায়নসহ সামগ্রিক দিক প্রভাব। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সবচেয়ে যে জিনিসটি কাজ করে সেটা হলো বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি। আমরা প্রতিনিয়তই বনায়ন কর্মসূচি বৃদ্ধির দিকে নজর না দিয়ে আরো গাছ নিধন কাজে ব্যস্ত। বাগানের গাছ কেটে বাগান ফাঁকা করে কৃষি জমি তৈরি করছি। বাগানের গাছ কেটে জ্বালানি, আসবাবপত্র, ঘরবাড়ি নির্মাণের কারণে দিন দিন গাছ কমে যাচ্ছে। শহরে সুউচ্চ বিল্ডিংয়ের পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। 

বিল্ডিংয়ের তাপমাত্রা শহরের পরিবেশকে আরো বিরূপ করে তুলেছে। তাহলে আমরা প্রকৃতিকে রক্ষা করার বদলে আরো ক্ষতি করছি যার কারণে আজ নরমালি দেশের সামগ্রিক তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস প্রায়। 

প্রকৃতির অভিশাপ আমাদের আজকের এই তাপদাহ পরিস্থিতি। এ অভিশাপ থেকে  রক্ষায় আমাদের আগে সচেতন হতে হবে, গাছ কাটা প্রায় বন্ধ করতে হবে। যদি একটি গাছ কাটি তাহলে আরো নতুন কয়েকটা গাছের চারা রোপণ করবো। প্রকৃতি রক্ষায় সরকারের উদ্যোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি সবাইকে প্রকৃতির অভিশাপ মোচনে এগিয়ে আসতে হবে।

লেখক: আইনজীবী ও কলামিস্ট, জজকোর্ট, খুলনা।


মানবকণ্ঠ/এফআই