Image description

রাস্তায় বেরুলেই দেখি সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, পল্লী বিদ্যুৎ, পুলিশ, মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানসহ নানা ধরনের স্টিকার যানবাহনে লাগিয়ে অনেকেই দাপটে চলছে। বিশেষ কমর বাইক ও প্রাইভেটকার অহরহ। বাদ নেই সরকারি-বেসরকারি অফিসের ব্যক্তিগত গাড়িও। উপজেলা ভূমিকর্মতার গাড়িতেও লেখা ভ্রাম্যমাণ আদালত। বিশেষ করে নজর কাড়ে সাংবাদিক লেখা স্টিকারযুক্ত বাইকগুলো। প্রশ্ন হচ্ছে- এসব স্টিকার কি ব্যক্তির পরিচয় বহন করে নাকি ব্যক্তির ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর চেষ্টা মাত্র। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, রাস্তায় চলাচল করা বড় অংশের গাড়ির মধ্যে এখন এসব স্টিকারই নজর কাড়ে। 

টেলিভিশন, দৈনিক পত্রিকা, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক, অনলাইন নিউজ পোর্টাল সব মিলিয়ে অসংখ্য গণমাধ্যম, অগুনতি সাংবাদিক। তাই রাস্তায় বেরুলেই গাড়িতে সাংবাদিক, সংবাদপত্র, প্রেস, জার্নালিস্ট, টেলিভিশন ইত্যাদি নানা স্টিকার দেখা যায়। কোনো কোনো বাইকের নাম্বার প্লেটের জায়গায় প্রেস বা সাংবাদিক লেখা থাকে। পত্রিকা বা সংবাদমাধ্যমের কোন বিভাগের সঙ্গে কে জড়িত সেটা বড় প্রশ্ন নয়, বড় প্রশ্ন হলো সবাই সংবাদকর্মী হিসাবে সাংবাদিকতার স্টিকার বহন করছে।  একই অবস্থা টেলিভিশনেরও। গাড়ি যারা চালান, তারাও সংবাদকর্মী, তাই বলে সবাই কি সাংবাদিক? বর্তমানে ফেসবুক পেইজ বা ইউটিউবারও  অর্থাৎ সাংবাদিকের স্টিকার উঠছে যার তার পরিবহনে। প্রেসের স্টিকার লাগিয়ে রাস্তায় দাপটে চলছে এক শ্রেণির মানুষ ।

গণমাধ্যমকর্মীদের গাড়িতেই যে স্টিকার লাগানো থাকে তা নয়। অনেক বিচিত্র পেশার মানুষের গাড়িতে স্টিকার লাগানো থাকে। বিচারপতি, আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মী,  ডাক্তার, শ্যুটিং ইউনিট  ইত্যাদি স্টিকার অহরহই চোখে পড়ে। এখন প্রশ্ন হলো, কেন এই স্টিকার লাগানো হয়? আইন ভাঙার জন্য? যেসব পেশার লোকদের ট্রাফিক পুলিশ সমীহ করতে পারে, তারাই নিজেদের গাড়িতে স্টিকার লাগান। কোনো গাড়িতে শিক্ষক লেখা কোনো স্টিকার দেখা যায় না। কারণ ট্রাফিক পুলিশরা নিরীহ শিক্ষকদের কোনো ছাড় দেবে না। কোনো পেশার লোকদেরই গাড়িতে স্টিকার লাগানোর কোনো আইনগত বৈধতা নেই। তবুও হয়তো ভুল পথে গাড়ি চালাতে বা ভুল জায়গায় গাড়ি পার্ক করতে বা ট্রাফিক হয়রানি থেকে রেহাই পেতে অনেকে এ ধরনের স্টিকার ব্যবহার করেন। এদের অনেকেই রাজপথে তৈরি করে অরাজকতা পরিস্থিতি। ট্রাফিক আইন ভাঙা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ না, এমন বিশেষ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অনেক বেআইনি কাজ করার অভিযোগও গণমাধ্যমে দেখি। মাদক পরিবহন, অস্ত্র পরিবহনের অভিযোগও আছে। রংপুরে জাপানি নাগরিক কুনিও হোশি হত্যাকারীরা যে মোটরসাইকেলে এসেছিল তাতেও নাকি প্রেস লেখা ছিল। তার মানে স্টিকার দিয়ে এক ধরনের ফ্রিস্টাইল চলার লাইসেন্স আদায় করে নেয় অনেকে।

বিশেষ পেশার মানুষ পেশাগত কাজে কিছু বিশেষ সুবিধা পেতে পারে। যেমন কোনো আগুন লাগার খবর পেলে রং সাইড দিয়ে দ্রুত কর্তব্যরত যানবাহন ঘটনাস্থলে যেতে পারে।  অ্যাম্বুলেন্সের জন্য সবসময় সবকিছু ছাড়া থাকে।  কিন্তু কোনো বিশেষ পেশার মানুষ যখন ব্যক্তিগত কাজের সময়ও স্টিকার লাগিয়ে বিশেষ সুবিধা নিতে চায়, তখন তা বেআইনির মধ্যে পড়ে। ঈদের সময় যখন প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যেও কোনো মার্কেটের সামনে বিভিন্ন স্টিকার সম্বলিত গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে, তখন তা জট তৈরি করে। এমনিতে কোনো জরুরি কাজে আপনি কোথাও যেতে চাইলে বা অসুস্থ কাউকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে চাইলে ট্রাফিক পুলিশকে বুঝিয়ে বললে, তিনি অবশ্যই আপনাকে সাহায্য করবেন, এই জন্য আলাদা স্টিকার দরকার নেই।

স্টিকার থাকুক আর নাই থাকুক, ট্রাফিক পুলিশ সব গাড়িকে সমান দৃষ্টিতে বিবেচনা করবে। এটা মানতে হবে মন্ত্রী থেকে শুরু করে সাংবাদিক সবাইকে। তখন তা প্রয়োগ করা সহজ হবে। ট্রাফিক পুলিশ যখন সামনের এমপির গাড়িকে ছেড়ে দেবে, তখন পেছনের গাড়িকে আটকানোর নৈতিক জোর তার থাকে না। তাছাড়া যে গাড়িতে যে স্টিকার লাগানো আছে, সেই স্টিকার সত্যি কিনা, গাড়িতে যিনি আছেন, তিনি সত্যিই সাংবাদিক কিনা, সেই গাড়িতে বেআইনি কিছু বহন করা হচ্ছে কিনা, তার নিশ্চয়তা কে দেবে? তাই সন্দেহ হলে পুলিশের সব গাড়ি থামানোর, তল্লাশি করার অধিকার কাজে লাগাতে হবে কঠোরভাবে। জরুরি প্রয়োজনে কেউ বিশেষ কোনো ছাড় চাইলে কর্তব্যরত পুলিশ পরিস্থিতি বুঝে প্রয়োজনটা শুনে ব্যবস্থা নিতে পারে। 

স্টিকারের প্রয়োজন নেই এটা বলা ঠিক হবে না। তবে যখন স্টিকারের অপব্যবহার তখন নিশ্চয় স্টিকার ব্যবহার ক্ষতিকর। নকল স্টিকার ব্যবহারকারীদের অধিকাংশের গাড়ির রেজিস্ট্রেশন অথবা ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। তারা বাড়তি সুযোগ গ্রহণ, অবাধ বিচরণ, ক্ষমতার দাপট এবং ট্রাফিক পুলিশের তল্লাশি থেকে বাঁচতে এসব নকল স্টিকার ব্যবহার করছেন। এছাড়া সরকারি কর্মচারি সংশ্লিষ্ট অফিসের স্টিকার কেউবা নিজের পদবিও ব্যবহার করছেন গাড়িতে। ২০১৬ সালের দিকে রাজধানীজুড়ে হাইড্রোলিক হর্ন, হুটার লাইট, বিকন লাইট, নকল স্টিকার, পুলিশ-ডিএমপি, সাংবাদিক লেখা, অসচ্ছ কাঁচ টিন্টেড পেপার ব্যবহারের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। তবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অভিযানের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে জানালেও পূর্ব থেকেই এসব অভিযান চলছিল। ট্রাফিক বিভাগের প্রতি ডিএমপি কমিশনারের স্পষ্ট নির্দেশনা থাকলেও রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে নকল স্টিকার লাগানো গাড়ি ও মোটরসাইকেল। সারাদেশের চিত্রও একই। আদেশ বাস্তবায়নে পুলিশের তৎপরতা প্রথম দিকে ছিল দৃশ্যমান। পরবর্তীতে তাদের অভিযানে দেখা দেয় ধীরগতি। 

অভিযানের প্রথম দিকে তারা মোটরযান আইনের ধারায় ৯ হাজার ৮ শত ৫১টি মামলা দায়ের করে। অন্যান্য যানবাহনের বিরুদ্ধেও ২১ হাজার ৪১৫টি মামলা দায়ের করে তারা। একই বছর বাংলাদেশ রুট ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরিটএ) চালিত এক সমীক্ষা মতে দেশের প্রায় ৫ লাখ চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স জাল। আর মহানগরীর যানবাহনের ৮০ শতাংশ লাইসেন্স এবং ফিটনেস নেই বলেও সেই সমীক্ষায় উঠে আসে। একই বছর গণমাধ্যমে উঠে এসেছিল নকল স্টিকার ব্যবহারের কারণে পুলিশ বিভ্রান্ত হয়। ফলে ওই গাড়িতে করে মাদক পাচার, অপহরণসহ নানা ধরনের অপরাধ করা সহজ হয়ে পড়ে। গাড়িতে স্টিকার না থাকলে সন্দেহজনক যেকোনো গাড়িতে পুলিশ তল্লাশি করতে পারলে এ ধরনের অপরাধ কমানো যাবে। নকল স্টিকার ব্যবহার করে মাদক পাচার, চোরাই চালান, ছিনতাই, গুম, খুন, ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে পুলিশ এ অভিযান শুরু করে। 

গাড়িতে স্টিকার লাগিয়ে অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে। ২০১৬ সালের ৪ মে এ ধরনের অপরাধ রোধে ডিএমপির পক্ষ থেকে ব্যক্তিগত যানবাহনে পুলিশ, সাংবাদিক, আইনজীবীসহ বিভিন্ন পেশাগত পরিচয় সংবলিত স্টিকার ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। একইসঙ্গে সন্দেহজনক যেকোনো গাড়ি তল্লাশির নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে কোনো সাংবাদিক দায়িত্ব পালনকালে প্রতিষ্ঠানের নামে স্টিকার লাগালে সমস্যা নেই বলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া জানিয়েছিলেন। স্টিকার থাক, তবে যেন সঠিক ব্যক্তি এবং সঠিক প্রয়োগ হয়। স্টিকারের যেন অপব্যবহার না হয় সেটা যথাযাথ কর্তৃপক্ষকে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। প্রশ্ন যেন না ওঠে ‘স্টিকারের ক্ষমতার দাপট রুখবে কে?

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।


মানবকণ্ঠ/এফআই