Image description

স্মৃতির পাতা থেকে বাদ যাচ্ছে আরেকটি বছর। বাংলা বছরের প্রথম দিবস উদযাপনের সবচেয়ে বড় পরিচয়ই হলো অসাম্প্রদায়িকতা। ইদানিং বাংলা নববর্ষটি সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। উন্মোচন করেছে অসাম্প্রদায়িক চেতনার একটি গতিপথ। তবে বাঙালির নববর্ষ সব বাঙালির কাছে একভাবে আসেনি। কারো কাছে এসেছে খরা হয়ে, কারো কাছে খাজনা দেওয়ার সময় হিসেবে, কারো কাছে বকেয়া আদায়ের হালখাতা হিসেবে, কারো কাছে মহাজনের সুদরূপে আবার কারো কাছে এসেছে উৎসব হিসেবে।

বিশ্বজুড়ে এমন লোকায়ত এবং জনমানুষ সম্পৃক্ত ক্যালেন্ডার খুব কম আছে বলেই বাংলা নতুন বছর বাঙালিকে শিকড় চেনায়। দেশে দেশে জাতিতে জাতিতে নববর্ষ উদযাপনের বিভিন্ন রীতি রয়েছে। সে উদযাপনের প্রকৃতি, রীতি আলাদা বটে তবে দিনটিকে ঘিরে পুরনো জঞ্জাল ভুলে নতুন প্রত্যাশাকে স্বাগত জানানোর স্পৃহাটা চিরন্তন। তবে তার মাঝেও ঘটে যায় সাম্প্রদায়িকতার ঘটনা। 

আমি মুসলমান, আমি হিন্দু, আমি বৌদ্ধ, আমি খ্রিস্টান তার চেয়ে বড় পরিচয় আমি মানুষ। মানুষ না হলে আমার কোন ধর্ম থাকতে পারে বলে আমি মনে করি না। আর মানুষ হলে ধর্ম থাকলে আমি ধর্মকে ব্যবহার করে অন্যের ধর্ম কটাক্ষ করব, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করব তেমনটা কোনো ধর্ম হতে পারে না। কারণ, সকল ধর্মের মূল কথা এক। আমি যদি মানুষ হতে চাই তাহলে আমাকে ধর্ম রক্ষা করতে হবে। রক্ষক যেমন ভক্ষক হতে পারে না, বা হলে তা রক্ষা হয় না ঠিক ধর্মও তেমন। আমি ধর্ম মানলে অন্যের ধর্মকে নিয়ে কটাক্ষ করতে পারি না। ধর্মবিরোধী কোনো উস্কানিতে আমি কর্ণপাত করতে পারি না। ধর্ম রক্ষা করতে হলে  আমাকে অবশ্যই অসাম্প্রদায়িক হতে হবে। 

পহেলা বৈশাখ জাতির এক অনুপ্রেরণার দিন। সবচেয়ে বৃহত্তম অসাম্প্রদায়িক ও সার্বজনীন উৎসবও। এই দিনে সর্বস্তরের মানুষ হৃদয়ের টানে, বাঙালিয়ানার টানে মিলিত হয় এ উৎসবে। তাতে থাকে না কোনো ধর্ম-বর্ণের ভেদাভেদ, থাকবে না ধনী-গরিবের বৈষম্য। পহেলা বৈশাখ। পহেলা বৈশাখ বাঙালির জীবনে নতুন বছরের প্রথম দিন, নতুন বার্তা। পহেলা বৈশাখের বাংলা ঢোলের বাজনা বাজবে বাঙালির মনে মনে। পহেলা বৈশাখের উৎসব হবে বাংলার ঘরে ঘরে, নিজের মতো করে। ১৪৩০-এর আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্নার হিসাব চুকিয়ে শুরু হবে নতুন এক পথচলা। 

এখনও অনেকে বাংলা বর্ষবরণের সঙ্গে পৌত্তলিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সম্পর্ক আবিষ্কার ও তা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালালেও বাংলা সন ও নববর্ষ উদযাপন মূলত মুসলিম ঐতিহ্যজাত এবং মুসলিম শাসকরাই তা প্রবর্তন করেন। বাংলা সনের সঙ্গে বাংলার শাসনব্যবস্থার সংস্কারে মুসলমান শাসকদের ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। দিল্লি সালতানাতের সময়ে হিজরি বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করা হলেও কৃষিভিত্তিক সমাজ বাস্তবতায় হিজরি বর্ষপঞ্জি ও কর আদায়ের ক্ষেত্রে কিছু অসামঞ্জস্য দেখা দেয়ায় একটি নতুন সনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এই প্রেক্ষাপটে ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট আকবর হিজরি সনের ভিত্তিতে বাংলা বর্ষপঞ্জি প্রবর্তনের নির্দেশ দেন। মুঘল রাজদরবারের দার্শনিক ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেহ্উল্লাহ সিরাজী হিজরি সন ও সৌর সনের সমন্বয় করে বাংলা সন প্রবর্তন করেন। 

ব্রিটিশ আমলে খ্রিস্টীয় ক্যালেন্ডারের পাশাপাশি আমাদের সমাজে বাংলা সন ও বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রচলন ও প্রভাব অক্ষুণ্ণ ছিল। মুঘল আমলে প্রবর্তিত বাংলা বর্ষপঞ্জিতেও কিছু সমস্যা দেখা দেয়ায় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলা বর্ষপঞ্জিতে কিছু সংস্কার আনেন। তার সংস্কার অনুসারে এখন প্রতিবছর ১৪ এপ্রিলে বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখে বর্ষবরণের উৎসব হয়ে থাকে। 

ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং হাজার বছরের রাজনৈতিক বিবর্তনে আমাদের সংস্কৃতিতে যে বৈচিত্র্য এসেছে সেখানে সামাজিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলা, হিজরি এবং গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জি ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় সমভাবে গুরুত্ব বহন করছে। আমাদের ভাষার ঐতিহ্য ও ইতিহাস যেমন স্বকীয় অনুপ্রেরণায় দীপ্যমান, তেমনি আমাদের রয়েছে একটি নিজস্ব ক্যালেন্ডার, যা জাতি হিসেবে আমাদের সমৃদ্ধ ও গর্বিত করেছে। এ কারণে আমাদের জাতীয় জীবনে বাংলা নববর্ষের গুরুত্ব খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। 

এখনো আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর। আমাদের ঋতুবৈচিত্র্য, খাদ্যসংস্থান ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রভাব স্বমহিমায় বিদ্যমান রয়েছে এবং থাকবে। বিশ্বায়নের যুগে আমাদের জাতীয় অর্থনীতি ক্রমে বৈদেশিক বাণিজ্যনির্ভর হয়ে উঠলেও পহেলা বৈশাখের উৎসবমুখর আবাহন বাড়তি জৌলুস সৃষ্টি করেছে। বাংলা নববর্ষ পালন এখন জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। চির নতুনের বার্তা নিয়ে আমাদের জীবনে বেজে ওঠে বৈশাখের আগমনী গান। ফসলি সন হিসেবে মোঘল আমলে যে বর্ষগণনার সূচনা হয়েছিল, সময়ের পরিক্রমায় তা আজ সমগ্র বাঙালির অসাম্প দায়িক চেতনার এক স্মারক উৎসবে পরিণত হয়েছে। 

উৎসব শুরু হয় বৈশাখের প্রথম দিন সকালে। হিজরি সনের তারিখ গণনা করা হয় সন্ধ্যার পর থেকে। কারণ হিজরির দিন হিসাব করা হয় চাঁদ দেখার ওপর ভিত্তি করে। তাই চাঁদ উঠলেই সন্ধ্যা থেকে হিজরি নতুন দিন শুরু। আর বাংলা নববর্ষে নতুন বছরের দিন শুরু হয় সকালে সূর্যোদয়ের পর থেকে। এর অন্যতম কারণ হলো কৃষিকাজ। সূর্য ওঠার পর যেমন কৃষিকাজ শুর হয় তেমনই দিনটাও সেই ভিত্তিতেই গোনা শুরুর কারণেই দিনের আলোর সঙ্গে সঙ্গে বছর শুরুর রেওয়াজ।

বাঙালি জাতির অসাম্প্রদায়িক চেতনায় চিড় ধরাতে ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানি সামরিক সরকার বাংলা নববর্ষ উদযাপনসহ সকল গণমুখী সংস্কৃতির অনুশীলন সরকারিভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। সরকারের এই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ ধর্মীয় ও গোষ্ঠীগত ভেদাভেদ ভুলে নববর্ষ উদযাপনে এক কাতারে সামিল হন। উৎসবে শামিল হয়ে বাঙালি তার আপন ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিক নিজস্বতা ও গৌরবময় জাতিসত্তার পরিচয়ে আলোকিত হয়। 

১৯৬০-এর দশকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক সন্ত্রাসের প্রতিবাদে ১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানটের এই বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সূচনা। ছায়ানটের আয়োজনের পরপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে শুরু হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। এই শোভাযাত্রাটি বের হয়ে শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে পুনরায় চারুকলা ইনস্টিটিউটে এসে শেষ হয়। শোভাযাত্রায় সব শ্রেণি-পেশার বিভিন্ন বয়সের মানুষ অংশগ্রহণ করে। 

মাসব্যাপী কাজ করে শিক্ষার্থীরা শোভাযাত্রার জন্য তৈরি করে রঙ-বেরঙের মুখোশ ও বিভিন্ন প্রাণীর মূর্তি। যা কিছু অমঙ্গলজনক তা বিসর্জন দেওয়া হয় শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে। বাঙালির এ চেতনাই গোটা জাতিকে মিলিত করেছিল, মহান মুক্তিযুদ্ধে নিজস্ব অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে প্রেরণা জুগিয়েছিল। পহেলা  বৈশাখে তাই বাঙালি আনন্দ-উৎসবের মধ্য দিয়ে আবার জেগে ওঠে, এক সুরে গেয়ে ওঠে বাঙালির জয়গান।

নতুন অর্থই পুরনো দিনের শোক-তাপ-বেদনা-অপ্রাপ্তি-আক্ষেপ ভুলে অপার সম্ভাবনার দিকে, স্বপ্নের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়ার দিন। সকল ভয়কে জয় করার মানসে নতুন করে জেগে ওঠার উপযুক্ত সময়। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়: 
নব আনন্দে জাগো আজি নব রবি কিরণে
শুভ্র সুন্দর প্রীতি-উজ্জ্বল নির্মল জীবনে...। 

একই আনন্দের বহির্প্রকাশ ঘটিয়ে নজরুল লিখেছেন: 
‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর 
তোরা সব জয়ধ্বনি কর 
ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখির ঝড় 
তোরা সব জয়ধ্বনি কর...।’

ঘটে গেছে ঘটনার নামে অনেক সাম্প্রদায়িক দুর্ঘটনা। তবুও বাঙালি জাতির অসাম্প্রদায়িক চেতনায় চিড় ধরাতে পারেনি এটাই বাস্তবতা। প্রতিবাদ করেই শুধু অশুভকে রুক্ষে দেওয়া যায় তাই না, শুভকে জাগ্রত করেও অশুভকে বিদায় দেওয়া যায়। আমি মানুষ আমাকে মনে রাখতে হবে। একাত্তরের মতো ওঁৎ পেতে থাকা শেয়াল-শকুন হায়নাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকতে হবে। সবার আগে মানুষের পরিচয়ে পরিচিত হতে হবে। তবেই আমি আগে ধর্মপ্রাণ মানুষ হতে পারব তবেই আমি ধর্ম রক্ষা করতে পারব। নিজে ধর্ম পালন না করে শুধু ধর্মরক্ষার নামে ধর্মব্যবসা বন্ধ করতে হবে। অপরাধতো ধর্ম বোঝে না। করোনার মতো মহামারি তো ধর্মের দোহাই দিয়ে কাউকে ছাড় দেয় না। তাহলে আমরা কেন ধর্মের দোহাই দিয়ে স্বার্থ হাসিলের পাত্র হচ্ছি? 

বৈশাখই পারে মনকে নির্মল করতে। রুখে দিতে হবে ধর্মান্ধতা। নতুন বছর মানবিক ও নির্মল বিশ্বের প্রত্যাশা। মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে বিলীন হোক সাম্প্রদায়িকতার নামে জরাজীর্ণতা। তাই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে থাকতে হবে সোচ্চার। শুধু সোচ্চার নয়, অসাম্প্রদায়িক চেতনার করতে হবে বিস্তার।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।


মানবকণ্ঠ/এফআই