Image description

৭১ বছর বয়সী রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন সম্প্রতি শেষ হওয়া নির্বাচনে বিপুল বিজয়ে সেদেশের জোসেফ স্টালিনকে ছাড়িয়ে ইতিহাসের ২০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকা নেতা। নির্বাচনের ফলাফলে অধিকাংশ ভোটই পরেছে পুতিনের দিকে। নতুন রাশিয়ার দায়িত্ব পুতিনের হাতে নতুন না হলেও সময়টা নতুন। পৃথিবী বড় ধরনের সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। 

যেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এবারই প্রথম বারের মত প্রশ্ন এসেছে পরমাণু অস্ত্রের প্রয়োগের সম্ভাবনা এবং তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনার কথা। কারণ দুই বছরের ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে রাশিয়ার সাথে পশ্চিম ও ইউরোপের যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে তা ক্রমাগত বৃদ্ধিই পেয়েছে গত বছর ধরেই। উত্তেজনা প্রশমনের গন্ধমাত্র নেই। উল্টো প্রায় রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পর থেকেই ন্যাটোর সম্প্রসারণ বিষয়টি জোরেশোরে সামনে আসে এবং এর ফলে যে পুতিন অসন্তুষ্ট সেটিও সামনে আসে। একদিকে ন্যাটোর বিস্তার এবং অন্যদিকে ইউক্রেনের ক্রমশই দুর্বল হওয়া। 

একদিকে পশ্চিমা দেশগুলোর অগ্রসর এবং রাশিয়ার ক্ষমতা প্রদর্শন চলছে। মোট কথা এটি এখন এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বে পরিণত হয়েছে। যেখানে ন্যাটো বনাম রাশিয়া রয়েছে। পশ্চিমা সমর্থন ছাড়া ইউক্রেন একমুহূর্তও যুদ্ধক্ষেত্রে টিকে থাকতে পারবে না এই মুহূর্তে এটা স্পষ্ট। ইউরোপের দেশ ও পশ্চিমা মিত্র মিলে সহায়তা করছেও কিন্তু খুব বেশি অগ্রগতি কিন্তু হয়নি ইউক্রেনের। বিপরীতে ক্রমাগত রাশিয়াই এগিয়েছে। এভাবে কতদিন চলতে পারে সেটাই প্রশ্ন। 
.
সম্প্রতি রুশ বিমানবাহিনীর চালকদের উদ্দেশে পুতিন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে রাশিয়ার দিকে বিস্তৃত হয়েছে। কিন্তু রাশিয়ার তাদের ওপর হামলার কোনো পরিকল্পনা নেই। এ জোটভুক্ত দেশগুলোর প্রতিও কোনো আগ্রাসন দেখানো হবে না। পোল্যান্ড, চেক রিপাবলিক বা বাল্টিক রাষ্ট্রগুলোকে ভয় দেখানো হচ্ছে বলে যেসব কথা রটানো হয়েছে, সেগুলো সম্পূর্ণ বাজে কথা। নতুন এই মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে কোন দেশ অর্থাৎ আমেরিকা বা রাশিয়া কে শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হবে তা বলা যায় না। 

কিন্তু ন্যাটোর সম্প্রসারণ কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলোর আরও সুরক্ষা বলয় তৈরির ইঙ্গিত দিচ্ছে। বিপরীতে রাশিয়ার শক্তি বা সামর্থ্য থাকলেও বিশালাকার ন্যাটোর সাথে যুদ্ধ করার মতো কতটুকু সামর্থ্য রয়েছে সেটাও ভাববার বিষয়। কারণ ন্যাটো কোনো একক দেশ নয়, এটি এখন বিস্তৃত একটি সামরিক সংগঠন। সুতরাং এখানেই প্রশ্ন থাকে। যদি ন্যাটোর সাথে রাশিয়ার কোনোভাবে যুদ্ধ বাঁধে তাহলে অবধারিতভাবেই আসবে পরমাণু অস্ত্রের বিষয়। যা উভয় পক্ষেই রয়েছে। সেক্ষেত্রে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘটারও সম্ভাবনা রয়েছে। 

অর্থাৎ এই যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়া উচিত নয়। বিশ্বকে একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের কথা ভাবতে হবে। ২ বছর অপেক্ষার পর সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্যপদ পেয়েছে সুইডেন। গত ৭ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনে এক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সামরিক জোটে যোগদান করে দেশটি। এর মধ্য দিয়ে ন্যাটোর ৩২তম সদস্য রাষ্ট্র হল সুইডেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, ন্যাটোর জন্য সুইডেন এবং ফিনল্যান্ডের যোগদান গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্প্রসারণ। সুইডেন, ফিনল্যান্ড এবং রাশিয়ার মধ্যে ১,৩৪০ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। এখন থেকে সুইডেন ন্যাটোর কাছ থেকে প্রতিরক্ষা সহায়তা পাবে। তাছাড়া সুইডেন ন্যাটো বাহিনীতে অত্যাধুনিক সাবমেরিন এবং স্থানীয়ভাবে নির্মিত ফাইটার জেটগুলোর একটি বড় বহর যুক্ত করবে। ন্যাটো নিশ্চিতভাবেই এই মুহূর্তে বিশ্বের সবথেকে শক্তিশালী সামরিক জোট। আরও বহু বছর আগে থেকেই এই জোট আরও প্রসারিত করার চেষ্টাই করছে সদস্য রাষ্ট্রগুলো। 

এর আগে গত বছর ফিনল্যান্ড ন্যাটোর ৩১তম সদস্য হিসেবে ন্যাটোতে যোগ দিয়েছিল। রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ চালানোর পর নর্ডিক দেশ ফিনল্যান্ড ও সুইডেন একসঙ্গে ন্যাটোতে যোগদানের আবেদন করে। ফিনল্যান্ড যোগ দেয়ার ফলে রাশিয়ার সঙ্গে ন্যাটোর সীমান্ত প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। আর এবার সুইডেন যোগ দেয়ায় নর্ডিক অঞ্চল নিয়ে রাশিয়ার দুশ্চিন্তা আরও বৃদ্ধি পেল।

গত বছর ফিনল্যান্ডের যোগদান সম্পন্ন হওয়ার পর বাল্টিক অঞ্চল থেকে স্ক্যান্ডিনেভিয়া অঞ্চলের ওপর পর্যন্ত ন্যাটো-রাশিয়া সীমানা বিস্তৃত হয়। এই দেশগুলোর ক্রমবর্ধমান রাশিয়ার আক্রমণের ভয় ন্যাটোর সম্প্রসারণকে আরও ত্বরান্বিত করেছে। এই বিষয়টিকে আরও এগিয়ে দিয়েছে ইউক্রেন ইস্যু। এটি এখন বদ্ধমূল ধারণায় পরিণত হয়েছে যে ন্যাটোই তাদের নিরাপত্তা দিতে পারে। রাশিয়া-ইউক্রেনযুদ্ধ শুরুর পর থেকেই ন্যাটোর বিস্তার নিয়ে রাশিয়ার আপত্তি এবং ন্যাটোর এই যুদ্ধে জড়ানো বা না জড়ানো নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে। কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে এখনও যুদ্ধে জড়ায়নি এবং দ্রুত সেই সম্ভাবনা নেই। তবে একেবারেই যে সম্ভাবনা নেই সেটাও উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। 

প্রত্যক্ষভাবে ন্যাটোর যুদ্ধে জড়ানো অর্থ হলো একটি ব্যাপকার যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হওয়া। সেই ঝুঁকি এখনই নেবে না ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্রগুলো। ন্যাটো জোটভুক্ত কোনো দেশ আক্রান্ত হলেই তাকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে। ফলে ন্যাটো জোটভুক্ত কোনো দেশকে সহজেই আক্রমণ করা সহজ কথা নয়। বিষয়টি পশ্চিমা বিশ্বের সম্প্রসারণ বনাম রাশিয়া। ন্যাটো গঠিত হয়েছিল এমন একটি সময় যখন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে স্নায়ু যুদ্ধ চলছিল। বর্তমানে স্নায়ু যুদ্ধের সেই মাত্রা না থাকলেও প্রতিযোগিতা রয়েছে। ন্যাটো যদি ইউক্রেন যুদ্ধে সৈন্য পাঠায় তাহলে রাশিয়া তার শক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করবে এবং সেক্ষেত্রে তা পরমাণু যুদ্ধের দিকেই ঠেলে দিতে পারে। 

এমন আভাস পুতিন নিজেই দিয়েছেন। ন্যাটো সম্প্রসারণে রাশিয়ার সাথে পশ্চিমা বিশ্বের মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইউক্রেনের মিত্র দেশগুলো সম্মিলিতভাবেই রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইউক্রেনকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করবেই। এটি কতদিন পর্যন্ত করবে সেটি নিশ্চিত নয়। তবে রাশিয়ার আক্রমণ বন্ধ না করা বা যুদ্ধের কোনো গ্রহণযোগ্য সমাধান না হওয়া পর্যন্ত এটি চলতেই থাকবে। আর সেটি হলেও রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ বন্ধ করবে না। হয়তো নিকট ভবিষ্যতেই ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্যভুক্ত দেশ হবে। ইউক্রেনে এমনটাই ইচ্ছে। ন্যটোর সব সদস্য রাষ্ট্র রাজি হলেই ইউক্রেনকে সদস্য করে নিতে পারে। সেক্ষেত্রে কিছুটা সময় লাগবে। কারণ সদস্য না হলেও ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর সহায়তা ঠিক পাচ্ছে। 

রাশিয়ার আগ্রাসনের জেরে দুই বছর আগে শুরু হওয়া ইউক্রেন যুদ্ধ ১৯৬২ সালের কিউবান ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের পর থেকে পশ্চিমের সাথে মস্কোর সম্পর্কের গভীরতম সংকটের সূচনা করেছে। এরপর থেকে পুতিন প্রায়ই পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি সম্পর্কে সতর্ক করে এসেছেন। সোভিয়েত-পরবর্তী রাশিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জয়ের পর পুতিন সাংবাদিকদের বলেন, ‘এটা সবার কাছে পরিষ্কার, এটি (রাশিয়া-ন্যাটো সংঘর্ষ) হবে এমন কিছু যা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে এক ধাপ দূরে। আমার মনে হয় খুব কমই কেউ এতে আগ্রহী হবে।’ এটি প্রচ্ছন্নভাবে একটি সতর্কতা। রাশিয়ার দাবি হলো ফ্রান্স তাদের সেনা ইউক্রেনে যুদ্ধের জন্য পাঠাতে প্রস্তুত। এটি আরও উত্তেজনা বৃদ্ধি করছে। সেক্ষেত্রে এই দ্বন্দ্ব গড়িয়েছে পুতিন বনাম ন্যাটো। 

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

মানবকণ্ঠ/আরএইচটি