Image description

বাস্তবতা মানুষকে ঘর ছাড়তে বাধ্য করে সেটি হতে পারে যুদ্ধ, সহিংসতা কিংবা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ। ঘর ছাড়া মহান কিছু নয়; তবে জীবন-প্রাণ বাঁচাতে মানুষকে ঘর ছাড়তে হয় কখনও কখনও। বর্তমানে রোহিঙ্গা শরণার্থীর ক্ষেত্রেও হয়েছে তাই। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ধরা হয় বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠী মধ্যে একটি। সময় পরিক্রমায় মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও সরকার কর্তৃক পরিকল্পিত নির্মম ও নিষ্ঠুর নির্যাতন তাদেরকে বেশ কয়েকবার বাংলাদেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছে।

একথা সত্য যে, সারা পৃথিবীতেই মানুষ শরণার্থীদের প্রয়োজনে সুরক্ষার হাত বাড়িয়ে দেয়। প্রশংসনীয় হলো, বাংলাদেশ তার মানবিকতার জায়গা থেকে নিপীড়িত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় ও নিরাপত্তা প্রদান করেছে। তবে জনসংখ্যাগত দুর্বলতা এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থা সত্ত্বেও এগারো লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থান করছে। যা বাংলাদেশকে সামাজিক, পরিবেশগত, আইনি ও আর্থিক প্রভাবের পাশাপাশি অনেক চ্যালেঞ্জ ও সমস্যার সম্মুখে ফেলছে। হ্যাঁ, শরণার্থী সংকট থেকে উত্তরণে বাংলাদেশ সরকারের নানা উদ্যোগ ছিল প্রশংসনীয়, তবে ফলপ্রসূ তেমন কিছু আদতে হয়নি। মিয়ানমার বর্তমানে একটি দীর্ঘস্থায়ী অস্থিতিশীলতার দিকে যাচ্ছে। 

রাখাইনের অন্তত ৬০ শতাংশ এলাকা আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। মিয়ানমারের যুদ্ধ পরিস্থিতি চীন, জাপান ও ভারতের মতো দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে। তাই তারাও সেখানে যুদ্ধ বন্ধ করার চেষ্টা করছে। রাখাইন রাজ্যে চীনের গভীর সমুদ্রবন্দর ও গ্যাস পাইপলাইনসহ বড় অঙ্কের বিনিয়োগ রয়েছে। রাখাইন অঞ্চলে চীন তার স্বার্থ অক্ষুণœ রাখতে চাইলে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া স্থবির হয়ে গেছে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে কিছু রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসন করার উদ্যোগ এখনো সফল হয়নি। চলমান পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিবদমান দলগুলোর অগ্রাধিকার তালিকায় না থাকলেও মিয়ানমারে স্থিতিশীলতা ফিরে এলে এ সংকট সমাধান যেন গুরুত্ব পায়, সেজন্য এখন থেকেই প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। 

একটু পেছনের গল্প বলা যাক, বার্মা তথা মিয়ানমারে ১৯৭৭-৭৮ সালের ড্রাগন কিং (নাগা মিন) নামক এক চিরুনি অভিযান চালানো হয়। উদ্দেশ্য, রাখাইন খালি করা আর সেখানকার ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের স্বদেশ ছাড়তে বাধ্য করা। সত্যিকার অর্থে, হয়েছেও তাই। রাতারাতি অগণিত মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়ে। সে অভিযানে হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল; যদিও পরে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্ভব হয় এবং উত্তেজনার সাময়িক প্রশমন হয়। তবে সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনা অসংখ্যবার হয়, বিশেষ করে নব্বইয়ের দশকের প্রথমদিকে। কিন্তু সবথেকে বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর আগমন শুরু হয় ২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ গণ্ডগোলের শিকার হয়ে।

সংকট নিরসনে, ২০১৭ সালের ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সরকার একটি প্রত্যাবর্তন চুক্তি স্বাক্ষর করে। তবে প্রত্যাবাসনের সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া বা নির্দিষ্ট সময়সীমা সংক্রান্ত জটিলতার দরুন তা আর এগোয়নি। এরপর ২০১৮ সাল এবং ২০১৯ সালে মোট দু’বার মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতার ভিত্তিতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করার উদ্যোগ ব্যর্থ হয়।

এরপর, ২০২১-এর জানুয়ারিতে চীনের মধ্যস্থতায় বাংলাদেশ মিয়ানমারের একটি ভার্চুয়াল মিটিং হয়। আপাতদৃষ্টিতে বৈঠক বেশ ফলপ্রসূ বলেই মনে হয়েছিল। কিন্তু এর মাত্র কিছুদিন পরই মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে এবং পুনর্বাসন প্রক্রিয়া আর হয়নি। এখনও মিয়ানমার অভ্যন্তরীণ সংঘাত ও সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ২০২২ সালের ২৭ জানুয়ারি মিয়ানমার এবং বাংলাদেশ আবারও ভার্চুয়ালি দ্বিপাক্ষিক সংলাপে বসে। সেসময় রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের জন্য তালিকা প্রণয়নের পরও আশাব্যঞ্জক কিছু হয়নি। সব মিলিয়ে গত ৬ বছরে বাংলাদেশ সরকার শরণার্থী প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে আশাবাদী হলেও মিয়ানমার সরকারের আচরণ ও কাজে বিন্দুমাত্র এর কোনো প্রতিফলন ঘটেনি।

মিয়ানমারের জান্তা সরকার সহসাই যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের দিকে যাবে না, সে ব্যাপারে মোটামুটি নিশ্চিত করে বলা যায়। বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশে তদবির করেছে, যাতে করে এ সমস্যার শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করা যায়। তন্মধ্যে প্রতিবেশী ভারত এবং মিয়ানমারের বন্ধুরাষ্ট্র চীন রয়েছে। কিন্তু কোনো দেশই সেভাবে বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়ায়নি। এর অন্যতম কারণ, বাংলাদেশের ভূকৌশলগত অবস্থান এবং মিয়ানমারে চীন ও ভারতের অর্থনৈতিক স্বার্থ। গাম্বিয়া ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অফ জাস্টিস (আইসিজে) মামলা করেছিল। তবে আইসিজের কার্যকারিতাহীনতার কারণে মামলাতেও কোনো অগ্রগতি হয়নি।

স্পষ্টভাবে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিল সামরিকভাবে হস্তক্ষেপ করবে না তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। চীন ও রাশিয়ার কারণে সেটা সম্ভব নয়। তাছাড়া ইউএনএইচসিআরের মতো বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা খুব একটা শক্তিশালী নয়। কোনো দেশের সরকার যখন স্বেচ্ছায় তার জনগোষ্ঠীর নাগরিকত্ব দেওয়া নিয়ে অনীহা প্রকাশ করে এবং সরকার নিজেই পদ্ধতিগতভাবে মানুষের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার ব্যাপারে সচেষ্ট হয়- সেসব বিষয়ে ইউএনএইচসিআরের করার মতো কিছু থাকে না। 

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ যা করতে পারে- প্রথমত, মিয়ানমার এমন একটি রাষ্ট্র, যার সঙ্গে কোনো ধরনের কূটনৈতিক আলোচনা কখনোই সহজ নয়। বাংলাদেশ সরকার বারবার বলে আসছে, তারা কোনো সামরিক সংঘাত চায় না, শান্তিপূর্ণ সমাধান চায়। তা সত্ত্বেও মিয়ানমার সরকারের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ এর বিপরীত ইঙ্গিত দেয়। মিয়ানমার সবসময়ই সামরিক বাহিনী কর্তৃক প্রভাবিত একটি রাষ্ট্র। তবে সম্প্রতি দেশটির অভ্যন্তরীণ অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। বিশেষ করে গেল সামরিক অভ্যুত্থানের পর বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের প্রতি মিয়ানমারের সাধারণ জনগণের বৈরী মনোভাবে পরিবর্তন লক্ষণীয়।

মনে রাখতে হবে, সামরিক সংঘাত কোনোভাবেই কাম্য নয়, আলোচনার টেবিলে সমস্যার সমাধান করতে হবে। বাংলাদেশকে আরও একটি বিষয় লক্ষ রাখতে হবে-মিয়ানমারের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়িক অংশীদার হলো চীন, ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়া। রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন কার্যকর করতে এসব ব্যবসায়িক অংশীদার দেশের সঙ্গে জোরালো কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে, যাতে করে তারা মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে সচেষ্ট হয়। পাশাপাশি প্রত্যাবাসনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হলে আমাদের অবশ্যই মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নিরাপদে, স্বেচ্ছায় ও টেকসই প্রত্যাবাসনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। এটিই চলমান সংকটের সর্বোত্তম সমাধান এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অবিচল আকাঙ্ক্ষা।  

২০১৭ সালে রোহিঙ্গা সংকটের সময় রাখাইন বৌদ্ধ সংঘগুলো এবং জনগণ রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ ছিল। ২০১২ সালে তারাই জাতিগত দাঙ্গার সূত্রপাত করেছিল। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক অধিকার বঞ্চিত করতে সেসময় তারা জোরালো আন্দোলন করেছিল। প্রত্যাবাসন কার্যকর করতে রোহিঙ্গা ও রাখাইন জনগণের মধ্যে দীর্ঘদিনের উত্তেজনা ও ব্যবধান কমাতে হবে। এ সংকট সমাধানে রাখাইন-রোহিঙ্গা সম্পর্ক উন্নয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশকে রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধানের জন্য সব স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলমান এ সংকট সমাধানের রোডম্যাপ প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ চালিয়ে যেতে হবে।

বলে রাখা ভালো, রোহিঙ্গা শরণার্থী পুনর্বাসনে বাংলাদেশ সরকার গত ছয় বছর দ্বিপাক্ষিক, ত্রিপক্ষীয় ও বহুপাক্ষিকভাবে একটি কার্যকর সমাধানের চেষ্টা করে আসছে। তবে প্রত্যাবাসনের বিষয়টি এখনও ‘যদি-কিন্তু’ হিসেবেই ঝুলছে। সীমিত সম্পদের অতি জনবহুল বাংলাদেশে সাড়ে ১১ লাখ শরণার্থীর বড় বোঝা দেশের জন্য ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’। সর্বোপরি, আবাসন, খাদ্য, পানীয় ওষুধ সরবরাহ, সামাজিক নিরাপত্তা, ভবিষ্যৎ মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনাসহ পরিবেশ বিপর্যয় সবকিছু আমলে নিয়ে রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসন খুবই জরুরি।

লেখক: শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।


মানবকণ্ঠ/এফআই