Image description

বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৫০ শতাংশ পণ্য ও সেবা ভ্যাট অব্যাহতির আওতাভুক্ত থাকায় দেশে কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ছে না। দক্ষিণ এশিয়ায় জিডিপি অনুপাতে কর আদায়ে বাংলাদেশের নিচে রয়েছে একমাত্র শ্রীলঙ্কা। দ্বীপ দেশটির কর-জিডিপি অনুপাত ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ। এরপরেই রয়েছে বাংলাদেশ। কর-জিডিপি অনুপাত ৯ দশমিক ৬১ শতাংশ।
রোববার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে দুই দিনের রাজস্ব সম্মেলন-২০২৩ উপলক্ষে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আয়োজিত ‘জাতীয় উন্নয়নে ভ্যাটের ভূমিকা : বর্তমান ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক সেমিনারের মূল প্রবন্ধে এসব তথ্য উঠে আসে। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এনবিআরের কমিশনার (ভাট অনুবিভাগ) সৈয়দ মুশফিকুর রহমান ও কাস্টম এক্সসাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের কমিশনার শওকত আলী সাদী।
এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। মূল প্রবন্ধে বলা হয়, কৃষি, পশু সম্পদ, মৎস্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জনপ্রশাসন, প্রতিরক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষা সেবা খাতে বর্তমানে কোনো ভ্যাট আরোপ করা হয়নি। এসব খাত জিডিপিতে ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ অবদান রাখে। উৎপাদন খাতে পোশাক শিল্পে ভ্যাট অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে। এ ছাড়া বিদেশি পণ্যে নির্ভরতা কমিয়ে দেশীয় শিল্পের বিকাশ, টেকসই শিল্পায়ন ও বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য রেফ্রিজারেটর, ফ্রিজার, এয়ার কন্ডিশনার, লিফট, মোটর ভেহিকেল, মোবাইল ফোন সেট ও হোম অ্যাপ্লায়েন্স উৎপাদক প্রতিষ্ঠানকে আমদানি ও উৎপাদন পর্যায়ে এবং ক্ষেত্রবিশেষে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ প্রতিষ্ঠানকে শর্ত সাপেক্ষে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
ওষুধের প্রাথমিক কাঁচামাল উৎপাদনে স্বনির্ভরতা অর্জনে এপিআই এবং সাবান ও শ্যাম্পুর প্রাথমিক কাঁচামাল উৎপাদনে অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর বিভিন্ন পণ্য, যেমন-কম্পিউটার, ল্যাপটপ, সার্ভার, মাদারবোর্ড ইত্যাদি উৎপাদনে এবং সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টে অব্যাহতি সুবিধা প্রদান করা হয়েছে। এ ছাড়া আরও কিছু সেবা খাত ভ্যাটের আওতার বাইরে রয়েছে। এসব খাতের মোট ভ্যাট অব্যাহতির পরিমাণ জিডিপির ৫০ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ায় জিডিপি অনুপাতে কর আদায়ে বাংলাদেশের নিচে রয়েছে একমাত্র শ্রীলঙ্কা। দ্বীপ দেশটির কর-জিডিপি অনুপাত ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ। এরপরেই রয়েছে বাংলাদেশ। কর-জিডিপি অনুপাত ৯ দশমিক ৬১ শতাংশ।
অনুষ্ঠানে বলা হয়, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলের মতো মেগা প্রকল্পগুলো এই করের টাকায় করা হয়েছে। করোনার যে টিকা দেওয়া হয়েছে সেটাও এই করের টাকায়। সে জন্য ট্যাক্স জিডিপি রেশিও বাড়াতে হবে। যেসব খাতে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে সেগুলো পুনর্বিবেচনা করতে হবে। সীমিত হলেও ভ্যাট যুক্ত করতে হবে।ভ্যাট আহরণ বাড়ানোর প্রয়োজন হলেও ভ্যাটের গবেষণা অংশে কোনো কাজ করা হচ্ছে না। কীভাবে ভ্যাট বাড়ানো যায় সেটা যদি গবেষণা করা যায় তাহলে ভ্যাটের পরিধি আরও বাড়বে। রাজস্ব আহরণে প্রশাসনে কম বিনিয়োগ করা হয়েছে এটা বাড়াতে হবে।
জনবল সংকটের কথা উল্লেখ করে এ সময় আরও বলা হয়, এনবিআরে জনবল নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ অনেক জরুরি কিন্তু এখানে কাজ করা হচ্ছে না। মাত্র ৪০ শতাংশ জনবল নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে এনবিআর, আরও ৬০ শতাংশ জনবল ঘাটতি রয়েছে। জনবল না পেলে রাজস্ব আহরণ বাড়ানো সম্ভব নয়। জনবল সংকটের কারণে এনবিআর বাধ্য হয়ে নতুন নিয়োগ দেওয়াদের দিয়েই কাজ করাতে বাধ্য হচ্ছে। মাত্র বিশ্ববিদ্যালয় পাস করাদের নিয়োগ দেওয়ার পর প্রশিক্ষণ দেওয়ারও সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে না।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়নে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ভূমিকা অনেক। সফলভাবে ট্যাক্স ও ভ্যাট সংগ্রহ করার কারণেই সরকার আজস্ব আদায়ে সফলতা পেয়েছে। ডিজিটাল পদ্ধতিতে দক্ষতা ও সততার সঙ্গে কাজ করে রাজস্ব আদায় আরও বাড়াতে হবে এনবিআরকে। নিজের সক্ষমতার কারণেই বিশ্বকে কে চ্যালেঞ্জ করে নিজ অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পেরেছে বাংলাদেশ। এতে দেশের ভাবমূর্তি অনেক উজ্জ¦ল হয়েছে। দেশের অর্থনীতি এখন অনেক শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। বাংলাদেশ এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন করে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে, ২০২৬ সালে তা কার্যকর হবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ পরিকল্পনা করেছে ২০৩০ সালে সফলভাবে এসডিজি অর্জন করে, ২০৩১ সালে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে এবং ২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশ আত্মপ্রকাশ করবে। সর্বোপরি ২১০০ সালে বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চায়।
রাজস্ব আদায়ে সিস্টেম লস কমাতে হবে জানিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। ভ্যাট ও ট্যাক্স আদায়ের ক্ষেত্রে ডিজিটাল পদ্ধতিকে কাজে লাগাতে হবে বেশি করে। দেশের বাণিজ্য উন্নয়নে সহায়তা প্রদান করতে হবে, এ জন্য সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে সমন্বয় থাকতে হবে। ট্যাক্স আদায়ের পরিধি বৃদ্ধি করার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। পেশাদারত্বের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এনবিআরকে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে। এতে রাজস্ব আদায় বাড়বে কয়েকগুণ, একই সঙ্গে দেশের সক্ষমতা বাড়বে।
তিনি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নে সোনার বাংলা গড়তে আমাদের নিজ নিজ অবস্থানে থেকে সক্ষতা ও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। দেশের প্রায় ৮৫ ভাগ রাজস্ব আদায় করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, তাই রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে এ প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বও বেশি। ভ্যাট ও আয়কর আদায়ের ক্ষেত্রে সিসটেম লস কমাতে হবে, এ ক্ষেত্রে স্মার্ট কর প্রশাসন নিশ্চিত করতে হবে।
করজাল সম্প্রসারণ ও রাজস্ব আদায়ে গতি আনতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে ভেঙে দুইভাগ করার দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সিনিয়র সহ-সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু। তিনি বলেন, বাংলাদেশ এলডিসি থেকে গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর রাজস্ব আদায়ে গতি আনতে হলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে ভেঙে দুইভাগ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে রাজস্ব আহরণ এবং রাজস্ব সম্প্রসারণ নামের আলাদা দুটি বিভাগ গঠন করা যেতে পারে।অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মোহাম্মদ আমিন উদ্দিন, ফরেন ইনভেস্টর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট ও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নাসের এজাজ বিজয় এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য (অব.) সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া।