Image description

বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে প্রতি মাসের শুরুতে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দাম নির্ধারণ করে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। নিয়ম অনুযায়ী কখনো বাড়ে, কখনো কমে। যখন দাম বাড়ে খুচরা বাজারেও বাড়ে। তবে সরকার যখন দাম কমিয়ে দেয় তখন খুচরা বাজারে তেমন প্রভাব দেখা যায় না। বাজারে এলপি গ্যাসের অতিরিক্ত দাম রাখার অভিযোগ বেশ পুরনো। কিন্তু এমন অভিযোগের সুরাহা নেই যুগের পর যুগ ধরে। 

ভোক্তারা বলছেন, সংশ্লিষ্ট কমিশনে অভিযোগ করেও মিলছে না সুফল। ক্রেতারা বলছেন, প্রতি মাসেই বিইআরসি এলপিজির নতুন দাম ধরে দেয়। কিন্তু দোকানে গেলে আর ওই দামে পাওয়া যায় না। এমন দাম ঘোষণা নিষ্প্রভ।

দেশের কোথাও সরকার নির্ধারিত দামে এলপি গ্যাস বিক্রি হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন বেসরকারি কর্মকর্তা শফিকুল আলম। তিনি বলেন, জুলাই মাসে ১২ কেজি এলপিজি সিলিন্ডারের দাম ৩৯ টাকা কমিয়ে এক হাজার ৩৬৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আপনি বাজার ঘুরে কোথাও এই দামে পাবেন না। আমাদের বাধ্য হয়ে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, পরিবহন খরচ, পাইকারি পর্যায়ে পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকা এবং ডিলারদের কমিশন কমে যাওয়ায় তারা নির্ধারিত দামে বিক্রি করতে পারছেন না। তাদের দাবি, বাস্তবতার সঙ্গে মিল রেখে মূল্য নির্ধারণ না করলে ঘোষিত দাম শুধুই কাগজে-কলমেই থাকবে।

খুচরা দোকানগুলোতে ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে দাম নিয়ে বিতণ্ডা হচ্ছে। ক্রেতারা মনে করছেন, নির্ধারিত দামের বাইরে ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত দাম রাখছেন। আর ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকার দাম নির্ধারণ করে দেয় ঠিকই, কিন্তু আমরা তো সেই দামে পাচ্ছি না।

বিশেষজ্ঞরা জানান, দাম কমার সুফল ভোক্তাদের হাতে পৌঁছাতে হলে বাজার তদারকি জোরদার করতে হবে এবং বিতরণব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনতে হবে। এলপিজি খাতটি এখনো পুরোপুরি নিয়ন্ত্রিত নয়, ফলে অনিয়মে ভোক্তাদের ভুগতে হচ্ছে।

এদিকে দাম বেশি নেয়ার বিষয়ে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান, ডিলার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা পরস্পরকে দোষারোপ করছেন। কোম্পানিগুলো বলছে, ডিলার ও খুচরা বিক্রেতারা ভোক্তাদের কাছে দাম বেশি নিচ্ছে। অন্যদিকে ডিলার ও আমদানিকারকরা বলছেন, আমরা সরকার নির্ধারিত দামে কিনতেই পারছি না।

সর্বশেষ চলতি জুলাই মাসের শুরুতে ভোক্তা পর্যায়ে ১২ কেজি এলপিজি সিলিন্ডারের দাম ৩৯ টাকা কমিয়ে এক হাজার ৩৬৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর আগে জুন মাসে ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম ২৮ টাকা কমিয়ে এক হাজার ৪০৩ টাকা নির্ধারণ করা হয়। মে মাসে ১২ কেজি এলপিজি সিলিন্ডারের দাম ১৯ টাকা কমিয়ে এক হাজার ৪৩১ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এপ্রিল মাসের জন্য ১২ কেজি এলপিজির দাম এক হাজার ৪৫০ টাকায় অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।

এর আগে গত মার্চে ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম ২৮ টাকা কমিয়ে এক হাজার ৪৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এছাড়া ফেব্রুয়ারিতে ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম ১৯ টাকা বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয় এক হাজার ৪৭৮ টাকা। আর জানুয়ারি মাসের শুরুতে সেই মাসের জন্য অপরিবর্তিত রাখা হয়েছিল এলপিজির দাম। তবে গত ১৪ জানুয়ারি এই মাসের জন্য ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম চার টাকা বাড়িয়ে এক হাজার ৪৫৯ টাকা পুনঃনির্ধারণ করা হয়।

এছাড়া ২০২৪ সালে চার দফা কমে এলপিজি ও অটোগ্যাসের দাম। আর বেড়েছে সাত দফা। এক দফা ছিল অপরিবর্তিত। গত বছরের জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, মার্চ, জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর বাড়ানো হয়েছিল এলপিজি ও অটোগ্যাসের দাম। আর দাম কমেছিল এপ্রিল, মে, জুন ও নভেম্বরে। তবে দাম অপরিবর্তিত ছিল ডিসেম্বরে। বিইআরসির তথ্যানুযায়ী চলতি বছর চার মাস কমেছে এলপি গ্যাসের দাম। গত বছরেও চারবার কমানো হয়েছিল জ্বালানি এই পণ্যটির দাম।

খুচরা বাজারে ১২ কেজি এলপিজির দাম ১৩৬৪ টাকা নির্ধারণ করে দেয়া হলেও ১৫০০ টাকার কমে কোথাও মিলছে না গ্যাসের বোতল। এছাড়া বাসায় পৌঁছে দেয়া কথা বলে আরও অন্তত ৫০ টাকা বাড়তি নিচ্ছে খুচরা ব্যবসায়ীরা।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, খুচরা বাজারে এখনো ১২ কেজির একটি সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে ১৫০০ থেকে ১৬৫০ টাকায়। অনেক জায়গায় ডেলিভারিসহ মূল্য দাঁড়াচ্ছে আরো বেশি। ফলে সরকারি ঘোষণায় তৃপ্ত হলেও, মাঠে নেমে দেখা যাচ্ছে এর ভিন্ন চিত্র। এলপি গ্যাস ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. সেলিম মিয়াকে খুচরা বাজারে দামের পার্থক্যের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি সব কথা শোনেন। কিন্তু ব্যস্ততার কথা বলে জবাব দেননি।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, প্রথম কথা হচ্ছে, হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী গণশুনানির মাধ্যমে এলপিজি দাম নির্ধারণের কথা থাকলে বিইআরসি তা বরাবরই অমান্য করছে। ফলে আমরা আগে গণশুনানিতে অংশ নিলেও এখন আর যাই না। কারণ রাষ্ট্রীয় একটি প্রতিষ্ঠান আদালতে অর্ডার অমান্য করে চলছে। যেখানে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নাগরিকদের অধিকার সুরক্ষা দিতে পারে না সেখানে আমরা কী করে যাই?

বিইআরসি ব্যবসায়ীদের পকেট ভারী করতেই একপক্ষীয় দাম নির্ধারণ করা হয় বলে মন্তব্য করেন এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন,  লুটপাট, লুণ্ঠননীতির কারণে রাষ্ট্রের নাগরিকরা পদে পদে ঠকছে। কাঠামোগতভাবে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ভঙ্গুর ও দুর্বল হয়ে পড়েছে। সরকার পরিবর্তন হয়েছে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না, পারবেও না। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নাগরিকের অধিকার লুণ্ঠন আমাদের চরম দুর্ভাগ্য ও নিয়তি।

দেশের কোথাও নির্ধারিত দামে এলপি গ্যাস না পাওয়ার অভিযোগের কথা স্বীকার করে বিইআরসি চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ বলেন, আসলে আমরা চেষ্টা করছি। আমাদের লোকবল কম। বাজার মনিটরিংয়ের জন্য আমাদের তো আর্ম ফোর্স নেই৷ দায়িত্ব নেয়ার পর আমরা ৬৪ জেলা প্রশাসনকে দুইবার এ বিষয়ে বাজার মনিটরিংয়ের কথা বলেছি। বিভাগীয় কমিশনকে বলা হয়েছে যেন তারা জেলা প্রশাসনকে এ বিষয়ে তাগিদ দেন।

দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে গণশুনানির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা গণশুনানির মাধ্যমেই দামের বিষয়ে নীতি-নির্ধারণ করেছি। এখন প্রতি মাসে যেটা দেখছেন সেটি হচ্ছে এলপিজি তৈরির মূল উপাদান প্রোপেন ও বিউটেনের দাম প্রতি মাসে মূল্য প্রকাশ করে সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠান আরামকো। তা আমরা সমন্বয় করি মাত্র।

প্রসঙ্গত, ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে এলপিজির দাম নির্ধারণ করে আসছে জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিইআরসি। এর আগে এই দাম কোম্পানিগুলোর ইচ্ছাধীন ছিল। এরপর থেকে দাম ঘোষণার সময় বলা হয়, আমদানি-নির্ভর এই জ্বালানি সৌদি রাষ্ট্রীয় কোম্পানি আরামকো ঘোষিত দরকে ভিত্তিমূল্য ধরা হবে। প্রতি মাসেই সমন্বয় করা হবে। সৌদির দর ওঠানামা করলে ভিত্তিমূল্য ওঠানামা করবে।