Image description

পাইপলাইনে থাকা ৩১ বিলিয়ন ডলার বিদেশি ঋণের সিংহভাগই পরিবহন খাতের। সে হিসেবে সরকারের শীর্ষ অগ্রাধিকার খাত হিসেবেই রয়ে যাচ্ছে এ খাত। উন্নয়ন সহযোগীদের সম্মতি পাওয়া প্রকল্পগুলোর জন্য বর্তমান ও আগামী দুই অর্থবছরে প্রত্যাশিত ৩০.৮৯ বিলিয়ন ডলার বিদেশি ঋণের এক-তৃতীয়াংশ বরাদ্দ রয়েছে এ খাতের জন্য। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তালিকাভুক্ত ১১৫টি প্রকল্পের মধ্যে ৩০টি সড়ক ও রেলওয়ে যোগাযোগ প্রকল্প। এগুলোর জন্য ১০.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ প্রস্তাব করা হয়েছে। এরপর রয়েছে জ্বালানি খাত। এ খাতের ৭টি প্রকল্পে বিদেশি অর্থায়ন থেকে ৪.৭৭ বিলিয়ন ডলার আশা করা হচ্ছে। 

বড় প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে ঢাকায় মেট্রো-৫, চট্টগ্রামের কালুরঘাট রেল-সড়ক সেতু, ঢাকা-কুমিল্লা রেললাইন, গাজীপুরের ধীরাশ্রমে রেলওয়ে কনটেইনার ডিপো এবং চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার টার্মিনাল। চুক্তি স্বাক্ষরের পাঁচ বছরের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ২০২৫-২৬ পর্যন্ত আগামী তিন অর্থবছরে এসব ঋণচুক্তির প্রত্যাশা করা হচ্ছে। অর্থব্যয়ের ক্ষেত্রে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের অবকাঠামোকে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। সড়ক ও রেলওয়ে সংযোগের জন্য ১০.৭ বিলিয়ন ডলার পরিকল্পনায় রাখা হয়েছে। অন্যদিকে শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবা তুলনামূলকভাবে কম অর্থায়ন পাবে। এ দুই খাতে প্রস্তাব করা হয়েছে যথাক্রমে ১.৬৪ বিলিয়ন ও ১.১৯ বিলিয়ন ডলার।

বার্ষিক উন্নয়ন বাজেটে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার জন্য কম বরাদ্দের প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে এসব প্রত্যাশিত ঋণেও। মানব পুঁজি উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ খাতগুলো বর্তমান অর্থবছরের উন্নয়ন বাজেটের ২৬ শতাংশ পাওয়া পরিবহন খাতের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম তহবিল পাচ্ছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ যথাক্রমে ৭ শতাংশ ও ৫ শতাংশ। তবে প্রস্তাবিত শিক্ষা প্রকল্পগুলোর বেশিরভাগই দক্ষতা প্রশিক্ষণকে কেন্দ্র করে। আর স্বাস্থ্য খাতের প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে একাধিক ঋণদাতার অর্থায়নপুষ্ট একটি পুষ্টি প্রকল্পের সম্প্রসারণে।

প্রকল্প নির্বাচনে বিচক্ষণতার আহ্বান: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক সেলিম রায়হান মনে করেন, বাংলাদেশ ভৌত অবকাঠামোকে অগ্রাধিকার দেয়া অব্যাহত রেখেছে, কিন্তু শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো সামাজিক অবকাঠামোতে প্রতিযোগীদের থেকে পিছিয়ে আছে। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য এবং শিক্ষার জন্যও মেগা প্রকল্পের প্রয়োজন, নাহলে আমরা এসডিজি, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ইত্যাদিতে পরিকল্পিত বিস্তৃত উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত হব। এ দুটি সামাজিক খাত যে পরিমাণ বরাদ্দ পায় তাও কাজে লাগাতে পারে না উল্লেখ করে তিনি এসব খাতের দক্ষতা বাড়াতে বড় ধরনের সংস্কারের ওপর জোর দেন। সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর নির্বাহী পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করা এ অধ্যাপক বলেন, ‘আমরা উন্নয়ন, উৎপাদনশীলতা এবং ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের কথা বলি। কিন্তু আমরা স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় খুব বেশি বিনিয়োগ করি না।’
ইআরডি ঋণচুক্তির অপেক্ষায় থাকা প্রকল্পগুলোর মাসিক হালনাগাদকৃত তালিকা বজায় রাখে। 

তার তথ্য অনুযায়ী, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক মোট ঋণের অর্ধেক প্রায় ১৪.৯৫ বিলিয়ন ডলার সরবরাহ করবে বলে আশা করা হচ্ছে। বিশ্বব্যাংক ইতোমধ্যে ৩.৭৩ বিলিয়ন ডলার অনুমোদন করেছে। আরও ১১.১২ বিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তি এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া ও নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকসহ অন্যান্য উন্নয়ন অংশীদারদের সঙ্গে স্বাক্ষর করার প্রস্তুতি রয়েছে।

ইআরডি’র সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেশের আসন্ন বাজেট চ্যালেঞ্জ এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবিলায় ৩.৬১ বিলিয়ন ডলারের বাজেট প্রস্তাবের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন অর্থনৈতিক সুবিধার সর্বোচ্চটুকু নিতে এবং ঋণ পরিশোধের চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রকল্প নির্বাচনে সতর্কতার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি সুস্পষ্ট অর্থনৈতিক সুবিধাসহ প্রকল্প নির্বাচনের গুরুত্বের কথা উল্লেখ করেন। 

তিনি বলেন, ‘বিদেশি ঋণ ব্যবহার করে ভ্যানিটি প্রকল্পে বিনিয়োগ করা ন্যায়সঙ্গত নয়। শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা আন্তর্জাতিক বন্দর প্রকল্পটিও একটি ভ্যানিটি প্রকল্প ছিল। আমাদের কর্ণফুলী টানেলও অনুরূপ প্রকল্প।’ বিশ্বব্যাংকের সাবেক এ অর্থনীতিবিদ বলেন, বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করে এবং বৈদেশিক মুদ্রার জোগান দেয় এমন প্রকল্পগুলোকে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত।

তিনি বলেন, ‘রপ্তানি উৎপাদনশীলতা বাড়াবে এমন প্রকল্প বাছাই করা উচিত। লজিস্টিক ব্যবস্থা এবং জ্বালানি সরবরাহ সংক্রান্ত প্রকল্পগুলোকেও অগ্রাধিকার দেয়া উচিত যেগুেেলা সরাসরি বৈদেশিক মুদ্রা বৃদ্ধিতে অবদান রাখবে।’

দ্বিপাক্ষিক ঋণের শেয়ার বাড়ছে: বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ পোর্টফোলিওতে দ্বিপাক্ষিক ঋণের শেয়ার বাড়ছে। এর মধ্যে কিছু উচ্চ-সুদের ঋণ রয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের ৪০ শতাংশ ছিল দ্বিপাক্ষিক ঋণ, যা ২০১৯-২০ অর্থবছরের ৩১ শতাংশ থেকে বেড়েছে। ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, বহুপাক্ষিক উৎস থেকে নেয়া মোট ঋণের পরিমাণ ৩৭.২৫ বিলিয়ন ডলার, যেখানে দ্বিপাক্ষিক উৎস থেকে ঋণ ছিল ২৫.১৫ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের বার্ষিক ঋণ পরিশোধের পরিমাণ চলতি অর্থবছরের আট মাসে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দুই বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৩ শতাংশ বেশি। বিদেশি উৎস থেকে অতিরিক্ত ঋণের এ পরিমাণ যোগ হবে তার সঙ্গে।
 
অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য বাজারভিত্তিক বৈদেশিক ঋণের ওপর বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান নির্ভরতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘সরকারের পরিচালন ব্যয় বাড়ছে, ঋণ পরিশোধও বাড়ছে। বিশ্বব্যাপী সুদের হারও বেশি। কঠিন শর্তে বাজারভিত্তিক ঋণ এখন কম ব্যবহার করা উচিত।’ তবে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের ঋণ টেকসইতা বিশ্লেষণ অনুযায়ী, বাংলাদেশ বাহ্যিক এবং সামগ্রিক ঋণ সংকটের কম ঝুঁকিতে রয়েছে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের সরকারি খাতের বাহ্যিক ঋণ ও জিডিপি অনুপাত ‘বেশ স্বস্তির’। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিদেশি ঋণ ও ঋণ সেবার দায় বৃদ্ধি উদ্বেগের কারণ।

পরিবহনে মনোযোগ এডিবি’র, স্থানীয় সরকারে বিশ্বব্যাংকের: এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি)-এর পাইপলাইন ঋণ প্রকল্পগুলোর মধ্যে ৪.৯৩ বিলিয়ন ডলারের প্রধান সড়ক, রেলপথ, অভ্যন্তরীণ ডিপো এবং কনটেইনরা টার্মিনালের কাজ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যা অন্য যেকোনো খাতের তুলনায় বেশি। সরকার ১২টি প্রকল্পের জন্য এডিবি থেকে ২.৬ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিশ্চিত করেছে। এর একটি মূল প্রকল্প হলো ৫.৪৭ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে ঢাকা মেট্রো (লাইন-৫) দক্ষিণ রুট, যা আগামী বছর শুরু হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এটি অনুমোদন প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে বলে পরিকল্পনা কমিশন জানিয়েছে। চলতি মাসে কমিটির বৈঠকের পর চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য তা জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) কাছে উপস্থাপন করা হবে।
গাবতলী-দাশেরকান্দির ১৭ কিলোমিটারের বেশিরভাগ ভূগর্ভস্থ মেট্রো রেললাইনটি এডিবি এবং দক্ষিণ কোরিয়ার যৌথ অর্থায়নে পরিচালিত হবে। এডিবি থেকে প্রথম ধাপে ৩০০ মিলিয়ন ডলার এ অক্টোবরে পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। ফিলিপাইনের ম্যানিলাভিত্তিক সংস্থাটি ঢাকা-চট্টগ্রাম ব্রডগেজ রেললাইন প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের জন্য ৬০০ মিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। রেলওয়ে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগামী বছরের মধ্যে এডিবির সঙ্গে দুটি ঋণচুক্তি স্বাক্ষর করার লক্ষ্য রয়েছে তাদের। গাজীপুরের ধীরাশ্রমে ২৫০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে অভ্যন্তরীণ কনটেইনার ডিপো প্রকল্পের জন্য এডিবি’র সঙ্গে ঋণচুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এ রেলওয়ে ডিপো চট্টগ্রাম ও মাতারবাড়ি বন্দরকে রেলপথে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে সংযুক্ত করবে।
১১টি প্রকল্পের জন্য বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে অনুমোদন পাওয়া গেছে, যার একটি বড় অংশ (১.৭৬ বিলিয়ন ডলার) স্থানীয় সরকার এবং গ্রামীণ উন্নয়নে ব্যয় হওয়ার কথা রয়েছে। বন্দর সম্প্রসারণে চট্টগ্রাম বে টার্মিনালের একটি অংশের জন্য সাড়ে ৩০০ মিলিয়ন ডলারের একটি ঋণচুক্তি এ বছর স্বাক্ষরিত হবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।

জোটবদ্ধ হচ্ছে এশীয় অংশীদারেরা: সরকার এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক, নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, জাপান, চীন এবং দক্ষিণ কোরিয়াসহ এশীয় উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে ২৯টি অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ঋণচুক্তি স্বাক্ষর করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। পরিবহন খাত পাঁচ বিলিয়ন ডলারের বেশি পাবে যার প্রায় অর্ধেক পরিমাণের জন্য সম্মতি পাওয়া গেছে বা আলোচনা চলছে। এ অর্থবছরে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে বঙ্গবন্ধু হাই-টেক সিটিতে ডিজিটাল সংযোগের জন্য চীনের সঙ্গে একটি ঋণচুক্তি প্রত্যাশা করা হচ্ছে। অন্যদিকে চট্টগ্রামের কালুরঘাটে কর্ণফুলী নদীর ওপর একটি রেল-সড়ক সেতুর জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার ঋণের প্রস্তুতি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এছাড়া জাপান ইতোমধ্যে এ বছরে ৩টি প্রকল্পের জন্য দুই বিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তি স্বাক্ষর করেছে।

স্বাস্থ্য-শিক্ষা খাতেও কিছুটা উন্নতি: ইআরডি কর্মকর্তারা আগামী বছরের জুন পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক, এডিবি, এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে ৫ম স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর কর্মসূচি, স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়ন প্রকল্প এবং বিএসএমএমইউ’র সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালসহ বেশ কয়েকটি জাতীয় ও নগর স্বাস্থ্য ও পুষ্টি প্রকল্পের জন্য ঋণচুক্তির আশা করছেন। ইআরডি’র তালিকা অনুযায়ী স্থগিত থাকা একাধিক প্রকল্পের জন্য ঋণচুক্তির মাধ্যমে শিক্ষা খাতও বড় তহবিল পেতে যাচ্ছে। এর মধ্যে নেক্সটজেন সেকেন্ডারি এডুকেশন প্রোগ্রাম, কারিগরি শিক্ষা আধুনিকীকরণ এবং পঞ্চম প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচির মতো কর্মসূচিতে সহায়তা করবে এডিবি। সৌদি ফান্ড ফর ডেভেলপমেন্ট হাওর এলাকায় ১০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় নির্মাণে সহায়তা করবে। তার জন্য এ বছর একটি ঋণচুক্তি হবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।

মানবকণ্ঠ/আরএইচটি