অবশেষে কিছুটা হলেও মাংসের দাম কমাতে বাধ্য হয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ব্যবসাকে টিকিয়ে রাখতে ও ক্রেতাদের মাংসমুখী করতে দাম কমানো হয় এমনটি ভাষ্য তাদের। এর আগে টানা ৯ বছর বৃদ্ধি পাওয়ার পর দেশে প্রথমবারের মতো মাংসের উৎপাদনও কমেছে। ফলে উচ্চ মূল্যস্ফীতির বা উচ্চ মূল্যের কারণে খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছেন দেশের মানুষ।
খরচ মেটাতে খাদ্যতালিকায় করতে হচ্ছে ব্যাপক কাটছাঁট। মধ্যবিত্তের খাদ্যের তালিকায় প্রায়ই গরু, খাসি, মহিষসহ বিভিন্ন গবাদিপশুর মাংস থাকলেও এখন তা কমিয়ে আনা হয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সঙ্গে মাংসের দামও বেড়ে যাওয়ায় আমিষের চাহিদা মেটাতে মানুষ বিকল্প খাবারে ঝুঁকছে। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ. এইচ. এম. সফিকুজ্জামান বলেছেন, চাঁদাবাজিসহ নানা হয়রানির বন্ধ হলে ৫০০ টাকার নিচে এক কেজি গরুর মাংস বিক্রি করা সম্ভব।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, কোরবানি বাদে এক বছরের ব্যবধানে এ বছর গরু-ছাগল জবাই উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। ফলে খামারিদের গরু শুধু খামারেই থাকছে। ক্রেতারা মাংসবিমুখ হওয়ার ফলে খামারি ব্যবসায়ীদের ব্যবসা লস হচ্ছে। আর মাংস ব্যবসায়ীদের বেচাকেনা কমে গেছে। মাংসের উচ্চ দাম হওয়ার কারণে মাংস ব্যবসায় টানা ধস নামছে। এই ধস নামার কারণে ব্যবসায়ীরা ক্রেতাদেরকে মাংসমুখী করতে গরুর মাংসের দাম কমিয়েছে। এখন বাজারে মাংসের চাহিদ ধীরে ধীরে বাড়তেছে। সোমবার (১৮ মার্চ) রাজধানীর একাধিক বড় বড় বাজার ঘুরে মাংস ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে এতথ্য পাওয়া যায়।
মাংস বিক্রেতারা আরও জানিয়েছেন, দাম বেড়ে যাওয়ায় পরিবারের জন্য মাংস কেনা মানুষের সংখ্যা অনেকাংশেই কমেছে। হোটেলগুলোই এখন তাদের মূল ক্রেতা। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে দীর্ঘদিন ধরে গরুর মাংস বিক্রি করছেন হাসান। তিনি বলেন, ‘আগে ৩০০-৪০০ কেজি গরুর মাংস অনায়াসেই বিক্রি করা যেত। হোটেলগুলোই নিত ১০০-১৫০ কেজি। বাকি মাংস কিনত সাধারণ মানুষ। কিন্তু এখন বড়জোর ১০০-১২০ কেজি মাংস বিক্রি হয়, যার প্রায় সবটাই হোটেলগুলো কিনে নেয়। সারা দিনে ২০-২৫ কেজির মতো বিক্রি হয় সাধারণ ক্রেতাদের কাছে। অর্থাৎ আগে যেখানে প্রতিদিন ৪-৫টা গরু জবাই করতাম, এখন একটা বা দুইটা জবাই করি। এর মধ্যেও বিক্রি না হওয়ায় অনেক মাংস থেকে যায়।
বিক্রি কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে এ মাংস বিক্রেতা বলেন, ‘মানুষের সব ধরনের খরচ বেড়েছে। বাজারে এখন ৬০-৭০ টাকার নিচে কোনো সবজি নেই। মানুষকে তো আর প্রতিদিন মাংস খেতে হয় না। ভাত-তরকারি তো খেতে হয়। তাই মাংস খাওয়া কমিয়ে দিয়েছে অনেকেই। কেউ কেউ আবার জমা করে রাখা কোরবানির মাংস খাচ্ছে। তারা আরও বলেন, ক্রেতাদেরকে মাংসমুখী করতে মাংসের দাম কমিয়েছে মাংস ব্যবসায়ী সমিতি।
এদিকে কেজিপ্রতি মাংসের যে নির্ধারিত বিক্রয়মূল্য সেটি উৎপাদন খরচ থেকে ৭৭ টাকা বেশি। যারা ৭৫০ টাকায় মাংস বিক্রি করছেন, সেটি উৎপাদন খরচ থেকে ১৬৩ টাকা বেশি। রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে বিভিন্ন দামে বিক্রি হচ্ছে গরুর মাংস। কোনো বিক্রেতা গরুর মাংস কেজি প্রতি বিক্রি করছেন ৫৯৫ টাকায়, আবার কেউ কেউ বিক্রি করছেন ৭৫০ টাকায়। এতে কিছু দোকান কীভাবে এত কম দামে মাংস বিক্রি করেও লাভ করতে পারছে, এ নিয়ে জেগেছে প্রশ্ন। রাজধানীর ব্যস্ততম মালিবাগ এলাকার মাংসের দোকান খোরশেদ গোশত বিপণি।
সরেজমিনে দেখা গেল, দোকানটিতে একইসঙ্গে দুই দামে মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ এবং ৬০০ টাকা কেজি দরে। একপাশে গরুর বিভিন্ন অংশের মাংস ঝুলিয়ে রাখা, সেখান থেকে পছন্দ অনুযায়ী কেনার সুযোগ রয়েছে। দাম ৭৫০ টাকা কেজি। অন্যপাশে পিস করে কাটা বিভিন্ন অংশের মাংস একসঙ্গে বিক্রি করা হচ্ছে ৬০০ টাকা কেজি দরে। এখানে অবশ্য ক্রেতার সংখ্যা বেশি, যাদের বেশিরভাগই নি¤œ ও মধ্যম আয়ের মানুষ।
বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, রমজানে নিম্ন আয়ের মানুষের কথা চিন্তা করেই ৬০০ টাকায় মাংস বিক্রি করছে দোকানটি। সাশ্রয়ী মূল্যে দেয়ায় মাংস বিক্রি হচ্ছে তুমুল। দোকানের কর্মচারীরা জানালেন, সকাল থেকে দোকানটিতে মোট ১৪টি (দুপুর দেড়টা পর্যন্ত) গরু বিক্রি শেষ পর্যায়ে। আরও চারটি গরু জবাইয়ের জন্য রাখা আছে, যা শেষ হলে আরও নিয়ে আসা হবে। ৬০০ টাকায় মাংস বিক্রি করে লোকসান গুনছেন কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে দোকানটির সুপারভিশনের দায়িত্বে থাকা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, দুই দামে মাংস বিক্রি হচ্ছে, কিন্তু কোনোটিতেই লস নেই। মূলত উচ্চ থেকে নিম্ন আয়ের সব ক্রেতাকে টানতেই এই পদ্ধতি।
অন্যদিকে উত্তর শাহজাহানপুরের আরেক মাংস বিক্রেতা খলিলুর রহমান প্রথম রোজা থেকেই ৫৯৫ টাকায় গরুর মাংস বিক্রি করছেন। শুধু কম দামের কারণেই দিনে কোটি টাকার মাংস বিক্রি করছেন এই বিক্রেতা। গত রবিবার খলিল গোস্ত বিতানের সাপ্তাহিক ছুটির দিন। এই সুযোগে পাশের মাংসের দোকান হালাল মিটে বেশ ভিড় দেখা গেল বিকেল পৌনে ৪টার দিকেও। কেউ কেউ আধঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েও মাংস কিনতে না পেরে বিরক্তি প্রকাশ করছেন। তবে দোকানটিতে মাংস বিক্রি করা হচ্ছে ৭৫০ টাকায়। পাশের এক দোকানি জানালেন, সকালে দোকানটিতে ৭২০ টাকায় মাংস বিক্রি করা হয়েছে। খলিলের দোকান বন্ধের কথা জানার পর তারা নতুন দাম ৭৫০ টাকা নির্ধারণ করেছেন।
খোরশেদ ও খলিলুরের মতো যেসব ব্যবসায়ীরা খুচরা পর্যায়ে ৬০০ টাকায় গরুর মাংস বিক্রি করছেন, তারা মাংস বড় টুকরো করে বিক্রি করেন না। এর পরিবর্তে তারা মাংসকে ছোট ছোট টুকরো করে হাড় ও মাংস একসাথে মিশিয়ে বিক্রি করেন। খলিলুর রহমান বলেন, ৬০০ টাকায় গরুর মাংস বিক্রি করে লাভ কম হয়। তবে কম দামে বেশি বিক্রি করার ফলে তাদের সার্বিক লাভও বেশি হয়।
ঢাকায় কিছু ব্যবসায়ী কম দামে গরুর মাংস বিক্রি করলেও সেটা সংখ্যার বিচারে কম। তবে তাদের কেউই লোকসান গুনছেন না। কম লাভে বেশি বিক্রি করে মুনাফা বৃদ্ধিই তাদের ব্যবসায়িক পদ্ধতি।
চলতি বছরের শুরু থেকেই রাজধানীর বাজারে বেড়েছে গরুর মাংসের দাম। তবে নির্বাচনের আগে মাংসের দর বেঁধে দেয়া হয়েছিল ৬৫০ টাকা। নির্বাচনের পর ঢাকায় কোথাও সেই মাংস বিক্রি হয় ৫৯৫ টাকা, কোথাও ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কম দামে মাংস সরবরাহ করতে দফায় দফায় চেষ্টা করছে। সর্বশেষ দাম নির্ধারণও করে দিয়েছে সরকার। তবুও দাম কমছে না বলে অভিযোগ করছেন ক্রেতারা।
সোমবার রাজধানীর মিরপুরে উজ্জ্বল গোশত বিতান পরিদর্শনকালে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ. এইচ. এম. সফিকুজ্জামান বলেন, চাঁদাবাজিসহ নানা হয়রানির বন্ধ হলে ৫০০ টাকার নিচে এক কেজি গরুর মাংস বিক্রি করা সম্ভব। সফিকুজ্জামান বলেন, চামড়ার দাম যৌক্তিক মূল্যে বিক্রি এবং হাট থেকে গরু কিনে বাজারে আনা পর্যন্ত চাঁদাবাজি বন্ধ হলে, মাংসের দাম অনেক কমবে।
এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন জেলায় কম দামে মাংস বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছেন অনেকে। অতি মুনাফা না করে সাধারণ মানুষের কষ্ট লাঘবে দেশের অন্য ব্যবসায়ীরাও এমন উদ্যোগ নিতে পারেন। রাজধানীর শাহজাহানপুরের আলোচিত মাংস ব্যবসায়ী খলিলের দেখানো পথে হেঁটে ৫৯৫ টাকায় গরুর মাংস বিক্রি করছেন মিরপুর ১১ নম্বরের উজ্জ্বল গোশত বিতানের উজ্জ্বল। সকাল থেকেই তার দোকানে মাংস নিতে ভিড় জমিয়েছেন অনেকে।
এ সময় ভোক্তা অধিকারের মহাপরিচালক আরও জানান, রোজায় কোনো ব্যবসায়ীর মাধ্যমে যেন ক্রেতারা প্রতারিত না হয়, সেজন্য সারাদেশে প্রতিদিন ৫০-এর বেশি টিম কাজ করছে। অভিযানের ফলে বাজারে শসা, লেবু ও বেগুনের দাম কমছে। অন্যদিকে ঢাকার অধিকাংশ ব্যবসায়ী সরকার-নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দরে গরুর মাংস বিক্রি করছেন।
বনশ্রীর স্বপন নামে এমনই এক ব্যবসায়ী ৭৫০ টাকায় গরুর মাংস বিক্রি করছিলেন। তিনি বলেন, প্রতিদিন দুইজন কর্মচারীর খরচ আর দোকান ভাড়া মিলিয়ে ৬০০ টাকায় গরুর মাংস বিক্রি করা আমাদের জন্য টেকসই নয়। কারণ আমরা এক বা দুটির বেশি গরু বিক্রি করতে পারছি না।
বেসরকারি বিক্রেতাদের পাশাপাশি প্রথম রোজা থেকেই সরকার ২৫টি স্পটে ৬০০ টাকায় এবং ৫টি স্পটে ৬৫০ টাকায় গরুর মাংস বিক্রি করছে। পরিমাণে খুব বেশি না হলেও প্রতিদিন আড়াই হাজারের মতো মানুষ এসব অস্থায়ী দোকান থেকে মাংস কিনতে পারছেন। এর চাপটা অল্প হলেও অন্য বিক্রেতাদের ওপর পড়েছে। সে কারণে প্রথম রোজায় বেশিরভাগ জায়গায় ৭৮০ টাকা দরে মাংস বিক্রি করতে দেখা গেলেও এখন সেটা ৭৫০ তাকায় নেমে এসেছে। কোথাও কোথাও বিক্রেতারা ৭২০-৭৩০ টাকাতেও বিক্রি করছেন।
দেশের গরুর খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) নেতারা বলছেন, গরুর মাংসের দামটা এত বেশি হওয়ার সুযোগ নেই। এখানে মাংস বিক্রেতারা অতি মুনাফা করছেন। এ থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে সামনে বিপদে পড়তে হবে।
বিডিএফএর সভাপতি মো. ইমরান হোসেন বলেন, বাজারে যে দামে গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে, তা হওয়ার কথা নয়। কারণ গরুর দাম খামারি পর্যায়ে স্বাভাবিক রয়েছে। যেমনটা ছিল ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে, যখন ঢাকায় একযোগে ৬৫০ টাকায় গরুর মাংস বিক্রি হয়েছে। কিন্তু এখনকার দামটা কোনোভাবেই যৌক্তিক তো নয়ই, বরং অনেকটাই বেশি।
মানবকণ্ঠ/এফআই
Comments