Image description

অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কাসহ আরও কিছু দেশ দাতা সংস্থাদের কাছ থেকে ঋণ চেয়েও পাচ্ছে না। সেখানে আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য দাতা সংস্থা ও দেশ বাংলাদেশের জন্য একরকম ঋণের ডালি খুলে বসেছে। গত বছর আইএমএফের সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণের পর এবার বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে ২ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণ দিতে চুক্তি করেছে। এডিবি এবং জাইকাসহ অন্য দাতা সংস্থাগুলোও এগিয়ে আসছে বাংলাদেশকে ঋণ দিতে। বাংলাদেশ কি সক্ষমতার প্রমাণ দিয়ে দাতাদের নজর কাড়ছে নাকি দাতা সংস্থাগুলোর ঋণ দেওয়ার দরকার তাই দিচ্ছে। 

এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, চলমান বৈশ্বি ক সংকটে অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত অনেক দেশের চেয়েও বাংলাদেশের অর্থনীতি মজবুত অবস্থানে আছে, ঋণ নিয়ে তা পরিশোধের সক্ষমতা রয়েছে। আর এ কারণেই বাংলাদেশকে ঋণ দিতে এগিয়ে আসছে দাতা সংস্থা ও দাতা দেশগুলো।

তবে দাতা সংস্থাগুলো যে আস্থার কারণে ঋণ দিচ্ছে সে আস্থার প্রতিদান দিতে হবে বাংলাদেশকেÑএমনটাও জানিয়েছেন অর্থনীতিবদরা। এ ক্ষেত্রে ঋণের সঠিক ব্যবহার করা, দুর্নীত রোধ করা ও সময়মতো প্রকল্পের কাজ শেষ করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

অন্যদিকে বাংলাদেশের এখন বিদেশি ঋণ কত এবং কোন দাতা সংস্থা কতটা অর্থ পাবে বাংলাদেশের কাছে সম্প্রতি তার হিসাবও তুলে ধরেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সংস্থাটির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা সবমিলে বাংলাদেশের কাছে ৭ হাজার ২২৯ কোটি ডলার পায়। প্রতি ডলারের বিনিময়মূল্য ১০৫ টাকা ধরে হিসাব করলে বাংলাদেশি মুদ্রায় এ অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৭ লাখ ৫৯ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ এ পরিমাণ অর্থ বিদেশিদের কাছে বাংলাদেশের ঋণ আছে। সংস্থাটি গত ৩০ জানুয়ারি বাংলাদেশের জন্য নতুন করে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করেছে। এরপর এ ঋণের প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬২ লাখ  ৭০ হাজার ডলার ইতিমধ্যে ছাড়ও করা হয়েছে।

প্রথম কিস্তির অর্থ ছাড়ের সময় আইএমএফ ঋণের শর্তসহ ১২৫ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে বাংলাদেশের ঋণের সার্বিক চিত্র তুলে ধরা হয়। সংস্থাটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছ থেকে বাংলাদেশের ঋণের পরিমাণ ৩ হাজার ৪৯০ কোটি ডলার, যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৮ শতাংশের বেশি। অন্যদিকে দ্বিপক্ষীয় বা বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ১৬৭ কোটি ডলার, যা জিডিপির ৫ শতাংশের বেশি।

আইএমএফের তথ্যে জানা যায়, বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছে বিশ্ব^ব্যাংকের কাছ থেকে। সংস্থাটির কাছ থেকে নেওয়া ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ৮১৬ কোটি ডলার। এর বাইরে নতুন করে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে আরও ২ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণ নিচ্ছে বাংলাদেশ। বিশ্ব^ব্যাংকের পরের স্থানে আছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। সংস্থাটির কাছে ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ৩২৮ কোটি ডলার। এরপর আছে যথাক্রমে জাপান, রাশিয়া ও চীন।

বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের বন্ধু জাপানের কাছ থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছে ৯২৩ কোটি টাকা। এ ছাড়া রাশিয়া ও চীনের কাছে ঋণের পরিমাণ যথাক্রমে ৫০৯ কোটি ডলার ও ৪৭৬ কোটি ডলার। আইএমএফের কাছে ঋণের পরিমাণ ৯৮ কোটি ডলার। নতুন করে সংস্থাটির কাছ থেকে আরও ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ নিচ্ছে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান গতকাল বুধবার সময়ের আলোকে বলেন, এখন পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কাসহ আরও কিছু দেশ রয়েছে যারা ঋণ নিলে শোধ করতে পারবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে দাতা সংস্থাগুলোর। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দাতাদের এ রকম কোনো সন্দেহ নেই। কারণ ওই সব দেশের অর্থনীতির চেয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন বেশ মজবুত অবস্থানে রয়েছে। ওই সব দেশের এখন ঋণ নিয়ে হয়তো পরিশোধ করার মতো সক্ষমতা নেই কিন্তু বাংলাদেশের সে সক্ষমতা রয়েছে। যেসব দাতা সংস্থা বা দাতা দেশ বাংলাদেশকে ঋণ দিচ্ছে তারা অনেক যাচাই-বাছাই করে তবেই দিচ্ছে। তবে দাতাদের ঋণ দেওয়ার অগ্রাধিকার ও বাংলাদেশের প্রয়োজনÑএ দুয়ের সমন্বয় ঋণপ্রাপ্তি আরও সহজ করে দিয়েছে। এ ছাড়া গত বছরের শেষের দিকে এসে আইএমএফ যে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণ অনুমোদন দিয়েছে-এটিও অন্য দাতাদের ঋণ দেওয়ার পথ খুলে দিয়েছে বা অন্যদের ঋণ দিতে উদ্বুদ্ধ করেছে। তা ছাড়া আইএমএফ যেসব শর্ত দিয়েছে সেগুলো ধাপে ধাপে পূরণ করায় বাংলাদেশের প্রতি দাতাদের আস্থা বেড়েছে।


তিনি আরও বলেন, যেখানে জিডিপির ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বৈদেশিক ঋণ নেওয়ায় কোনো ঝুকি নেই, সেখানে বাংলাদেশের এখন যা বিদেশি ঋণ রয়েছ তা জিডিপির ২০ শতাংশের মতো। সুতরাং এই দিক থেকে কিছুটা স্বস্তিও রয়েছে। তবে আসল কথা হচ্ছেÑশুধু ঋণ নিলেই হবে না, ঋণের সঠিক ব্যবহার করতে হবে এবং প্রকল্পের কাজ সময়মতো শেষ করতে হবে। তা হলে ঋণ পরিশোধ করতে কোনো সমস্যা হবে না।

আরেক অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিনও মনে করেন, ‘ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা আছে বলেই বিশ ব্যাংকসহ অন্য দাতা সংস্থাগুলো বাংলাদেশকে ঋণ দিচ্ছে।’

সময়ের আলোকে তিনি বলেন, আইএমএফের পর বিশ্বব্যাংকও ঋণ দিল বাংলাদেশকে। এটা অবশ্যই বাংলাদেশের জন্য স্বস্তির খবর। যেখানে অনেক দেশ চেয়েও ঋণ পাচ্ছে না সেখানে বাংলাদেশকে শীর্ষ সব দাতা সংস্থাই ঋণ দিচ্ছে। বাংলাদেশের সক্ষমতা রয়েছে বলেই দাতা সংস্থাগুলো ঋণ দিচ্ছে। তবে ঋণের অর্থের যাতে অপচয় না হয় এবং দুর্নীতি না হয় সেদিকে গুরুত্বসহকারে নজরদারি করতে হবে সরকারকে। সবচেয়ে বড় কথা হলোÑঋণের সঠিক ব্যবহার করতে হবে।

স্বাধীনতার ৫১ বছরে সাড়ে ৯৫ বিলিয়ন ডলারের বিদেশি ঋণ : অন্যদিকে স্বাধীনতার পর থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৫১ বছরে বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার কাছ থেকে ৯৫ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণ নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে পাইপলাইনে পড়ে আছে ৫০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। বিদেশ থেকে নেওয়া মোট ঋণের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নেওয়া হয়েছে বিদ্যুৎ খাতের জন্য; মোট ঋণের ১৯ দশমিক ৪৬ শতাংশ। সম্প্রতি প্রকাশিত অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের ‘ফ্লো অব এক্সটার্নাল রিসোর্সেস ইন টু বাংলাদেশ ২০২১-২২’ প্রতিবেদনেলে ধরা হয়েছে এ তথ্য।

মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণ এখন ৫৫৮ ডলার : এ ছাড়া বাংলাদেশে মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণ ৭ বছর আগের তুলনায় দ্বিগুণ হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে সরকারি ও বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রেই বৈদেশিক ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণ ছিল ৫৫৮ ডলার, যা ২০২০-২১ অর্থবছরে ছিল ৪৮২ ডলার। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশের মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল ২৫৭ ডলার। গত অর্থবছরে দেশের মোট বৈদেশিক ঋণ ছিল ৯৫ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার, যা ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ছিল ৪১ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার।