Image description

বর্ষার মৌসুম মানেই রাঙ্গামাটিতে পাহাড় ধসের শঙ্কা। পাহাড়ে থেমে নেই বৃষ্টি। চলতি মৌসুমে রাঙ্গামাটিতে থেমে থেমে ছোট, মাঝারি ও ভারি বর্ষণ হচ্ছে। ২০১৭ সালের ভয়াবহ পাহাড় ধসের পর রাঙ্গামাটিতে বৃষ্টি শুরু হলেই প্রতি বছরই পাহাড় ধসে অনাকাঙ্খিত মৃত্যু এড়াতে শুরু হয় মাইকিং সহ প্রশাসনের পক্ষ থেকে নানা কর্মসূচি। কিন্তু তা কেনো কাজেই আসছে না। মৃত্যুর ঝুঁকি জেনেও এক শ্রেণির মানুষ পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে গড়ে তুলছে নতুন নতুন বসতি।‘ মৃত্যুকূপে’ বসবাস করছে হাজারো পরিবার।

প্রশাসনের নজরদারি অভাবে প্রতি বছরই পাহাড়ের পাদদেশে অনায়সে গড়ে উঠছে নতুন নতুন বসতি এবং তারা মৃত্যুও ঝুঁকি জেনেও বসবাস করছেন। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে স্বল্প সময়ের জন্য প্রশাসন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও কর্তৃপক্ষ ঢাকঢোল পিটিয়ে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারীদের অন্যত্র সরে যাওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করেই দায়িত্ব শেষ করে। ঘূর্ণিঝড় বা বৃষ্টিপাতজনিত কারণে ২০১৭ সালের মতো আরও একটি বিপর্যয় ঘটার আশঙ্কা একেবারেই অমূলক নয়। এ অবস্থায় ‘মৃত্যুকূপে’ বসবাসকারীদের সেখান থেকে সরিয়ে অন্য কোথাও পুনর্বাসন করার দাবি জানান সচেতন ব্যক্তিরা।

জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, রাঙ্গামাটিসহ ১০টি উপজেলায় ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে এবং উপজেলা পর্যায়েও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে নিকটবর্তী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান সমূহ প্রস্তুত রাখা হয়েছে। রাঙ্গামাটি জেলায় ২৪৬টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। রাঙ্গামাটি জেলায় প্রায় ৩শতাধিক  ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় চিহ্নিত করা হয়েছে। এতে পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে হাজারো পরিবার। ঝুঁকিতে বসবাসরত পরিবারকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রতিনিয়ত মাইকিং করা হচ্ছে। এতে পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সহ রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেটগণ এক সাথে কাজ করছেন।

ভেদভেদী লোকনাথ মন্দির এলাকার বাসিন্দা মোঃ জসিম জানান, যখন বর্ষা মৌসুম আসে, তখন পাহাড় ধসের ঝুঁকি থাকে রাঙ্গামাটিতে। এই এলাকায় প্রায় ১১৩টি পরিবার আছে। যারা সবাই ঝুঁকি জেনেও পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করছেন। 
তিনি আরো জানান, প্রশাসন থেকে বারবার আমাদের সহায়তার কথা বলে এবং পুনর্বাসনের কথা বলে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না।

একই এলাকার বাসিন্দা রাশেদা বেগম জানান, পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকি জেনে বসবাস করছেন। তাদের আর কোনো জায়গা নেই। মরলেই এখানে মরবো, বাঁচলেও এখানে বাঁচবো। 
তিনি আরো জানান, সরকার যদি আমাদের অন্য কোথাও জায়গায় পুনর্বাসন করে তাহলে সেখানে চলে যাবো।

ভেদভেদী শিমুলতলী এলাকার বাসিন্দা মোঃ শামিম জানান, ২০১৭ সালে যখন পাহাড় ধস হয়,তখন তিনি পরিবার নিয়ে প্রায় ৬ মাস আশ্রয়কেন্দ্রে ছিলেন। মৃত্যুও ঝুঁকি জেনে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করছেন তিনি। অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। তবে সবারই তো জীবনের নিরাপত্তা দরকার। নিরুপায় হয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে হবে। 
তিনি আরো জানান, যদি সরকার তাদের নিরাপদ জায়গার ব্যবস্থা করে দেন, সেক্ষেত্রে চলে যাবেন।

রূপনগর এলাকার বাসিন্দা মোঃ সাকিব হোসেন জানান, জেলা প্রশাসনের পক্ষ হতে নিরাপদ স্থানে বা আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য মাইকিং করা হচ্ছে। যত দ্রুত সম্ভব আমরা সবাই আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যাবো।

একই এলাকার বাসিন্দা আকবর জানান, বর্ষা মৌসুমে জেলা প্রশাসন ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় চিহ্ন দিয়ে চলে যান। পাহাড়কে ঝুঁকিমুক্ত করে বসবাসের উপযোগী করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

ভেদভেদী পশ্চিম মুসলিম পাড়ার বাসিন্দা আবুল বাশার জানান, তারা এখানে নিরাপদে আছেন। যদি বেশি পরিমাণ বৃষ্টি হয়,তাহলে আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যাবেন।

এ প্রসঙ্গে রাঙ্গামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিব উল্লাহ জানান, রাঙ্গামাটির ১০টি উপজেলায় হাজারো পরিবার পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে বসবাস করছেন। পাহাড় ধস মোকাবেলায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ স্থান থেকে সরে যেতে প্রতিনিয়িত মাইকিংও করা হচ্ছে। যারা পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিতে বসবাস করছে তাদের ঝুঝিয়ে আশ্রয়কেন্দ্র নিয়ে আসা হচ্ছে।

তিনি আরো জানান, পাহাড়ি এলাকার এখানকার ভূমি ব্যবস্থাপনার জটিলতার কারনে এই মানুষ গুলো সরকারি জমির উপর বসবাস করছে। আইনগতভাবে তারা অবৈধভাবে বসবাস করছে। কিন্তু এই মুর্হুতে মূল গুরুত্ব হচ্ছে তাদের জীবন বাঁচানো। আর তাদেরকে পুনর্বাসন এটি একটি আইনী প্রক্রিয়া। এই আইনী প্রক্রিয়া একটি লম্বা প্রক্রিয়া। সেটি হচ্ছে সরকার যখন সিদ্ধান্ত দিবে সেই বিষয়ে আমরা কাজ করবো।

উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের (১৩ জুন) প্রবল বর্ষণে ভয়াবহ পাহাড় ধসে রাঙ্গামাটিতে ১২০ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এতে দুই শতাধিক মানুষ আহত হন। ব্যাপক ক্ষতি হয় পুরো জেলায়। ফলে যোগযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে রাঙ্গামাটি জেলা। তিন মাস আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছিলেন প্রায় তিন হাজার মানুষ। পরের বছর ২০১৮ সালে একই সময়ে রাঙ্গামাটির নানিয়ারচর উপজেলায় প্রবল বর্ষণে মৃত্যু হয় ১১ জনের। 

এছাড়াও ২০১৯ সালে পাহাড় ধসে কাপ্তাই উপজেলায় দুইজনের মৃত্যু হয়েছিল। বারবার এত হতাহতের পরও থেমে নেই পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস।