
স্পর্শকাতর প্রকল্পে দাবি আদায়ের নামে বিশৃংখলা সৃষ্টি, ব্যক্তি আক্রোশ ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে নিয়োগ প্রক্রিয়ার কারণে রূপপুর প্রকল্পের কাজ ফের পেছানোর আশংকা করা করছেন বিশেষজ্ঞরা। দফায় দফায় পিছিয়ে যাওয়া দেশের প্রথম এই পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিট থেকে চলতি বছরের শেষ নাগাদ বিদ্যুৎ উৎপাদনের ল্ক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু বর্তমানে হযবরল পরিস্থিতির কারণে আরও দেরি হতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে। সেইসাথে নির্মাণকাজ এবং নিরাপত্তার বিষয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এসব কারণে রাশিয়ানরাও উদ্বিগ্ন। রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত পারমাণবিক শক্তি সংস্থা রসাটম ইতোমধ্যে পরমাণু শক্তি কমিশনে চিঠিও দিয়েছে। রূপপুর প্রকল্পের বিভিন্ন জটিলতার বিষয় নিয়ে রসাটমের প্রতিনিধিরা প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে সাক্ষাতের প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন বলে রাশিয়ার একটি সূত্র জানিযেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র দেশের জন্য খুবই জরুরি, গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। যা বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের মর্যাদা বাড়িয়েছে। এমন প্রকল্পে অবশ্যই দক্ষ জনবল নিয়োগ দেওয়া উচিত। না হলে নানা রকম শঙ্কা থেকে যায়। হেলাফেলার সুযোগ নেই। এখনই সতর্ক না হলে প্রকল্পের নির্মাণকাজ ও পরিচালনায় ভবিষ্যতেও ঝুঁকি তৈরি করবে।
সম্প্রতি তিনজন জ্যেষ্ঠ এবং অভিজ্ঞ কর্মকর্তাকে ডিঙিয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পে নতুন পরিচালক হিসেবে যে ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তার নাম প্রাথমিক তালিকাতেই ছিল না বলে জানা গেছে। পিডি পদে নিয়োগপ্রাপ্ত কনিষ্ঠ এই কর্মকর্তার তুলনামূলক নির্মাণকাজের অভিজ্ঞতা নেই বললেই চলে। এ ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ উঠেছে। পাশাপাশি প্রকল্প পরিচালকের পর উচ্চ কারিগরি ও স্পর্শকাতর প্রকল্পে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদ চিফ সুপারিনটেনডেন্ট। যিনি প্রকল্পের সম্পূর্ণ কারিগরি বিষয়ের প্রধান। ওই পদেও একজনকে অর্ন্তবর্তীকালীন অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তার নিয়োগের বৈধতা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে ড. মো. জাহেদুল হাছানের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে গত ৭ মে ওই পদে নিয়োগের জন্য তিন কর্মকর্তার জীবন বৃত্তান্ত চেয়ে পরমাণু শক্তি কমিশনকে চিঠি দেয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। ওই তিন কর্মকর্তা হলেন পরমাণু শক্তি কমিশনের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. হাসিনুর রহমান, প্রধান প্রকৌশলী মো. আশরাফুল ইসলাম ও প্রধান প্রকৌশলী ড. মো. খালেকুজ্জামান। এই তিনজনই রূপপুর বিদ্যুৎ প্রকল্পের উপ-পরিচালক হিসেবে কর্মরত।
চিঠি পাওয়ার পর তিনজনের সাথে ড. মো. কবীর হোসেনের নাম যুক্ত করে চারজনের তালিকা মন্ত্রণালয়ে পাঠায় কমিশন। কবীর হোসেন কমিশনের মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা। শেষ পর্যন্ত গত ২৫ মে ড. কবীর হোসেনকেই প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চারজনের মধ্যে তিনজনের নির্মাণ কাজে অভিজ্ঞতা রয়েছে। সবচেয়ে কনিষ্ঠ কর্মকর্তা কবীর হোসেনের এ প্রকল্পে সরাসরি নির্মাণ কাজের তেমন কোনো অভিজ্ঞতা নেই। মূলত: তিনি মানবসম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত দায়িত্বের পাশাপাশি দেশ-বিদেশে কর্মীদের প্রশিক্ষণে পাঠানোর কাজ করতেন। কিন্তু গত বছর আগস্টে তাকে সেখান থেকে সরিয়ে সদ্য সাবেক প্রকল্প পরিচালক জাহেদুল হাছানকে চারটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের পাশাপাশি ওই দায়িত্বও দেওয়া হয়। এরপর থেকে কবীর হোসেন পরমাণু শক্তি কমিশনে কর্মরত আছেন।
মূলত নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত নানা অনিয়মের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিত কবীর হোসেনকে ওই দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় বলে গুঞ্জন রয়েছে। তার আমলে নিয়োগের শর্ত পূরণ না করেই একাধিক ব্যক্তিকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে নিয়োগ দেওয়ার তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ ছাড়াও কনিষ্ঠদের প্রশিক্ষণে পাঠিয়ে পরে জ্যেষ্ঠদের ওপর পদোন্নতি দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে।
পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যানের পছন্দের কর্মকর্তা কবীর হোসেনকে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দিতেই ওই তালিকায় নতুন করে তার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয় বলে অভিযোগ উঠেছে।
প্রকল্পের চিফ সুপারিনটেনডেন্ট পদে দায়িত্বে ছিলেন মো. হাসমত আলী। গত ৮ মে ১৮ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। যাদের মধ্যে রয়েছেন হাসমত আলী। ভুক্তভোগীরা বলছেন, কর্তৃপক্ষের নানা স্বেচ্ছাচারিতা ও অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলায় কোনো ধরনের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে অন্যায়ভাবে তাদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে সংকট তৈরি হয়েছে।
হাসমত আলীর পরিবর্তে অর্ন্তবর্তীকালীন ভারপ্রাপ্ত চিফ সুপারিনটেনডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন প্রকল্পের ডেপুটি চিফ সুপারিনটেনডেন্ট মুশফিকা আহমেদ। এসব বিষয় নিয়ে গত ২৭ মে পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যানকে চিঠি পাঠিয়েছে রসাটম। প্রতিষ্ঠানটির বাংলাদেশ প্রকল্পের ভাইস প্রেসিডেন্ট আলেক্সি ভি ডেইরি স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, মুশফিকাকে ওই পদে দায়িত্ব পালনের জন্য তাত্তিক, ব্যবহারিক এবং অন্যান্য বিষয় মিলে অবশ্যই ১২ মাসের প্রশিক্ষণ নিতে হবে। এরপরই তিনি চিফ সুপারিনটেনডেন্ট হিসেবে যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে পারবেন।
মুশফিকা আহমেদ প্রসঙ্গে প্রকল্প সূত্র জানায়, ২০২১ সালের প্রথমের দিকে ডেপুটি চিফ সুপারিনটেনডেন্ট পদে ২১৭৬ ঘন্টা Russian Federation Rosatom Technical Academy কর্তৃক প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেন। তিনি দক্ষতার সাথে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কাজ করছেন। অপরদিকে চিফ সুপারিনটেনডেন্ট পদের ট্রেনিং ১৪১২ ঘন্টা সম্পন্ন করা হয়। Rosatom Technical Academy কর্তৃক মুশফিক আহমেদের সুপারিনটেনডেন্ট পদের টেুনিং গ্যাপ এনালাইসিস সম্পন্ন করা হয়। উক্ত পদে পদায়নের ক্ষেত্রে Full Scope Sumulator ট্রেনিং সম্পন্ন করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
জানা গেছে, নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড ইতোমধ্যেই এমডি, চিফ সুপারিনটেনডেন্ট, ডেপুটি চিফ সুপারিনটেনডেন্টসহ চারটি পদে লোক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। যার আবেদনের শেষ তারিখ ৪ জুন। আগামী এক মাসের মধ্যেই এসব পদে নিয়োগ চুড়ান্ত হবে।
বিশেষজ্ঞ এবং প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, প্রকল্পের প্রথম ইউনিটের কাজ শেষে কমিশনিংয়ের কাজ চলছে। আর দ্বিতীয় ইউনিটের নির্মাণকাজও প্রায় শেষের দিকে। এমন পরিস্থিতিতে মাঠ পর্যায়ে রাশিয়ানদের কাছ থেকে পুরো কাজ বুঝে নেওয়া এবং ভবিষ্যতে কেন্দ্রটি পরিচালনার জন্য কর্মীদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেওয়াসহ পুরো কারিগরি বিষয়টি দেখভালের দায়িত্ব থাকে চিফ সুপারিনটেনডেন্টের। সেফটি, সিকিউরিটি দেখার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের ডকুমেন্টেশন তৈরি, অনুমোদন থেকে শুরু করে নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে হয়। আর এ কাজগুলো ঠিকমতো হচ্ছে কি না, তা দেখার পাশাপাশি জাতীয় গ্রীডে বিদ্যুৎ সরবরাহ, আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা-আইইএ ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগসহ কারিগরি এবং অন্যান্য নানান গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার দায়িত্ব প্রকল্প পরিচালকের। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ পদ দুটিতে নতুন নিয়োগপ্রাপ্তরা কতটা দক্ষতা দেখাতে পারবেন, তা নিয়েই উঠেছে প্রশ্ন।
সমসাময়িক সময়ে প্রকল্পে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলনের জের ধরে বিভিন্ন সময়ে অন্তত ৩০০ জনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ এবং ২৬ জনের প্রকল্প এলাকায় প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারী করে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান নিউক্লিয়ার পাওয়ার কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (এনপিসিবিএল)। গত ৬ মে সার্ভিস রুল পাস করার ২ দিন পর ১৮ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়। পরে আরও অন্তত নয়জনকে সাময়িক বরখাস্ত করে কর্তৃপক্ষ। এসব নিয়ে কর্মীদের মধ্যে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে। এদিকে কারণ দর্শানো ছাড়াই ১৫ প্রকৌশলীকে চাকরিচ্যুত করার ঘটনায় নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে পেশাজীবী প্রকৌশলীদের একমাত্র জাতীয় প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইইবি)।
প্রকল্প চালুর আগেই কর্মীদের এমন অসন্তোষ, বিশৃঙ্খলা আর কর্তৃপক্ষের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে সেখানে কর্মরত রাশিয়া, আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা-আইএইএসহ বিভিন্ন বিদেশির মধ্যে এক ধরনের উদ্বেগ, অস্বস্তি কাজ করছে। বিশ্বের কোথাও এমন নজির নেই। এতে দেশের ভাবমূর্তিও ক্ষুন্ন হচ্ছে।
রাশিয়ার একটি সূত্র জানায়, প্রকল্পের সার্বিক বিষয় নিয়ে রসাটমের একটি প্রতিনিধিদল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা চালাচ্ছে। অধ্যাপক ইউনূসের জাপান সফর শেষে এই সাক্ষাৎ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতো উচ্চ কারিগরি ও স্পর্শকাতর প্রকল্পে পরিচালক ও চিফ সুপারিনটেনডেন্ট দুটোই খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং দায়িত্বশীল পদ। এখানে অবশ্যই অভিজ্ঞ এবং দক্ষ প্রকৌশলী নিয়োগ দেওয়া দরকার। যাদের সরাসরি এসব কাজের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে। কারণ রাশিয়ার কাছ থেকে কেন্দ্রের বিভিন্ন যন্ত্রপাতির গুণগত মান এবং এর সেফটি, সিকিউরিটি ও সেফগার্ডের বিষয়গুলো ভালোভাবে বুঝে নেওয়া তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, দক্ষ জনবল নিয়োগ দেওয়া না হলে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পটি ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে।
এসব বিষয়ে জানতে পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান (চলতি দায়িত্ব) ড. মো. কামরুল হুদার সাথে মোবাইলে কল করে এবং ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
Comments