চান্দহর-জয়মন্টপ কোল: অযত্নে বিলুপ্তের পথে প্রাকৃতিক মৎস্য ভাণ্ডার

এক সময়ের ধলেশ্বরী নদীর অংশ, মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার চান্দহর ও জয়মন্টপ (নয়ানী) কোল দুটি এখন কচুরিপানার দখলে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি ও মিঠা পানির সুস্বাদু মাছের ভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত এই বিশাল আয়তনের প্রাকৃতিক জলাধার দুটি দীর্ঘ ৮-১০ বছর ধরে অবহেলা আর অযত্নে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। সবুজ কচুরিপানায় ঢেকে যাওয়ায় কোল দুটিকে এখন ফসলের মাঠের মতো মনে হয়।
স্থানীয়রা জানান, কয়েক বছর আগেও এই কোল দুটি ছিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। এখানকার সুস্বাদু মাছের খ্যাতি ছিল সর্বত্র। শীতকালে হাজার হাজার অতিথি পাখির কলকাকলীতে মুখরিত থাকত পুরো এলাকা। দুই পাড়ের শত শত পরিবার কোল দুটির পানি গোসল, থালা-বাসন ধোয়া, রান্নাসহ নানা কাজে ব্যবহার করত। কিন্তু কালের বিবর্তনে এবং যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে কোল দুটি এখন কচুরিপানার পুরু আস্তরণে ঢেকে গেছে।
কচুরিপানার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কোলের মাছের ওপর নির্ভরশীল শতাধিক মৎস্যজীবী পরিবার। মাছ ধরতে না পেরে তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। কমলনগর গ্রামের সুজন ও আনেছ খা জানান, "আগে আমরা এ কোলের মাছ ধরে সংসার চালাতাম। কিন্তু ৮-১০ বছর ধরে কচুরিপানার কারণে মাছ ধরতে পারি না। জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।"
জানা গেছে, জয়মন্টপ ইউনিয়নের খেলেশ্বর ও কমলনগর মৌজায় অবস্থিত জয়মন্টপ (নয়ানী) কোলটি ৫৪ একর আয়তনের অর্ধচন্দ্রাকৃতির প্রায় ২ কিলোমিটার লম্বা এবং আধা কিলোমিটার চওড়া। অপরদিকে, চান্দহর ইউনিয়নের চান্দহর মৌজার ৭৮.০৭ একর আয়তনের চান্দহর কোলটিও প্রায় ৩ কিলোমিটার লম্বা এবং ৫'শ মিটার চওড়া। বর্ষা মৌসুমে উভয় কোলের আয়তন অনেক বৃদ্ধি পায় এবং ধলেশ্বরী নদীর সাথে সংযুক্ত হয়। চান্দহর কোলটি কালীগঙ্গা নদীর সাথেও যুক্ত। এক সময়ে এই কোল দুটিতে প্রতি বছর নৌকা বাইচ অনুষ্ঠিত হতো, যা এখন শুধুই স্মৃতি।
স্থানীয়রা আরও জানান, কচুরিপানার কারণে কোলের পানি দূষিত হয়ে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে, যা শুষ্ক মৌসুমে ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন পানিবাহিত রোগের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
চান্দহর কোল পাড়ের বাসিন্দা আব্দুল কাদের জানান, একসময় সরকারিভাবে এটি ইজারা দেওয়া হতো এবং তখন ইজারাদারদের পরিচর্যার কারণে কচুরিপানা জমতে পারত না। কোটি কোটি টাকার মাছ পাওয়া যেত। কিন্তু ১৪-১৫ বছর আগে "জাল যার জলা তার" ভিত্তিতে উন্মুক্ত করার পর থেকেই কচুরিপানা বাসা বাঁধে।
জয়মন্টপ (নয়ানী) কোল পাড়ের বাসিন্দা ইঞ্জি. দেলোয়ার কবির টিপু জানান, একসময় এই কোল দিয়ে যাত্রীবাহী লঞ্চ ও মালামালবাহী বড় নৌকা চলাচল করত। নদ-নদী, খাল-বিল ভরাট হওয়ার কারণে এখন সেসব কেবলই স্মৃতি। তিনি দ্রুত কচুরিপানা অপসারণ করে এই নান্দনিক প্রাকৃতিক জলাধারের নৈসর্গিক সৌন্দর্য ফিরিয়ে এনে পর্যটন শিল্প গড়ে তোলার জোর দাবি জানান।
এ বিষয়ে সিংগাইর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) এস.এম. আব্দুল্লাহ বিন শফিক বলেন, "সরেজমিনে চান্দহর কোল দেখেছি। গত মাসের উপজেলা রাজস্ব সভায় কোল দুটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। দখল ও কাগজপত্র পর্যালোচনা করে জলমহাল নীতিমালা ২০০৯ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।"
Comments