Image description

বাংলাদেশের চামড়া শিল্প দীর্ঘদিন ধরে একটি জটিল ও বিস্ময়কর বৈপরীত্যের মধ্যে আটকে আছে। এই শিল্প, যা দেশের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়, একদিকে ঈদুল-আজহার সময় কোরবানির মাধ্যমে প্রাপ্ত কাঁচা চামড়ার অযৌক্তিকভাবে কম দামের সমস্যায় জর্জরিত, অন্যদিকে চামড়াজাত পণ্যের আকাশছোঁয়া মূল্য এই শিল্পের বাজার ব্যবস্থাপনার গভীর ত্রুটিকে প্রকাশ করে। এই অসামঞ্জস্য শুধুমাত্র বাজারের অস্বচ্ছতা ও সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যের প্রতিফলন নয়, বরং নীতিগত অপ্রতুলতা, অবকাঠামোগত ঘাটতি ও পরিবেশগত সমস্যার জটিল সমন্বয়কে উন্মোচন করে। 

কোরবানির চামড়া বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী, মাদ্রাসা, এতিমখানা ও দাতব্য সংস্থাগুলোর জন্য আয়ের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উৎস। এই চামড়া সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা গেলে এটি দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে এবং সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জীবনমান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে বাজারে সঠিক মূল্য নির্ধারণের অভাবে এই সম্পদের প্রকৃত মূল্যায়ন হয় না, যা শুধুমাত্র আর্থিক ক্ষতির কারণ নয়, বরং চামড়া শিল্পের টেকসই উন্নয়নের পথে একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশে গঠিত উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আসন্ন ঈদুল-আজহার আগে এই সমস্যা সমাধানের জন্য আশার আলো জাগিয়েছে। 

তবে এই উদ্যোগের সফলতা নির্ভর করছে দ্রুত বাস্তবায়ন, কঠোর তদারকি, স্বচ্ছ নীতি প্রণয়ন ও সকল স্টেকহোল্ডারের সমন্বিত সহযোগিতার উপর। প্রতি বছর ঈদুল-আজহায় বাংলাদেশের বাজারে প্রচুর পরিমাণে কাঁচা চামড়া আসে, যা প্রধানত গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়ার চামড়া নিয়ে গঠিত। এই কাঁচা চামড়া শিল্পের জন্য একটি অপার সম্ভাবনাময় সম্পদ, যা সঠিকভাবে ব্যবহার করা গেলে দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে সক্ষম। বাংলাদেশে চামড়া শিল্প দীর্ঘদিন ধরে রপ্তানি আয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। 

এই শিল্পের মাধ্যমে জুতা, ব্যাগ, জ্যাকেট, বেল্ট ও আসবাবপত্রের মতো উচ্চমূল্যের পণ্য উৎপাদন করা হয়, যা দেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি হয়। তবে এই সম্পদের সঠিক ব্যবহার এবং মূল্যায়নের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, পরিকল্পনা ও নীতিগত কাঠামোর অভাবে এই সম্ভাবনা পুরোপুরি কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছে না।

উৎপাদন প্রক্রিয়ায় কাঁচা চামড়ার পাশাপাশি আমদানিকৃত রাসায়নিক, আধুনিক যন্ত্রপাতি, দক্ষ শ্রমিক, নকশা, ব্র্যান্ডিং ও বিপণনের মতো উপাদান জড়িত থাকে, যা উৎপাদন খরচ বাড়ায়। আন্তর্জাতিক ফ্যাশন শিল্পের প্রভাবে এই পণ্যগুলো উচ্চবিত্ত গ্রাহকদের লক্ষ্য করে বাজারজাত করা হয়, যার ফলে দামে ব্র্যান্ড মূল্য ও মার্কেটিং খরচ যুক্ত হয়। উদাহরণস্বরূপ, এক জোড়া ব্র্যান্ডেড চামড়ার জুতার দাম ১৫,০০০ টাকা হলেও, এর কাঁচা চামড়ার মূল্য মাত্র ৪০০-৫০০ টাকা। 

এই বিশাল মূল্যের পার্থক্যের কোনো অংশই প্রাথমিক সরবরাহকারীদের কাছে ফিরে আসে না। মধ্যস্বত্বভোগী ও বড় ব্যবসায়ীরা বিপুল মুনাফা অর্জন করলেও, কাঁচা চামড়া সরবরাহকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হন, যা বাজারের গভীর ত্রুটি ও সিন্ডিকেটের একতরফা প্রভাবের প্রমাণ।

চামড়া শিল্পে স্বচ্ছতা ও নিয়ন্ত্রণের অভাব এই সমস্যাকে আরো জটিল করে তুলেছে। সরকারের পক্ষ থেকে চামড়ার ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণের উদ্যোগ থাকলেও, তা বাস্তবায়নে ব্যর্থতা স্পষ্ট। ট্যানারি মালিকদের অর্থ পরিশোধে বিলম্ব, ক্রেতার সংখ্যা হ্রাস ও বাজারে চাহিদার অস্থিতিশীলতা দাম কমার অন্যতম কারণ। 

এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের চামড়ার নিন্মমানের দুর্নাম এবং রপ্তানিতে প্রতিযোগিতার অভাব কাঁচা চামড়ার দামকে আরো নিন্মমুখী করে। সাভারের চামড়াশিল্প নগরে পরিবেশ দূষণ ও কমপ্লায়েন্স সমস্যার কারণে ইউরোপীয় বাজারে রপ্তানির জন্য প্রয়োজনীয় লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের সনদ পাওয়া যায় না, যা রপ্তানির সম্ভাবনাকে সীমিত করে।

অথচ চামড়াজাত পণ্যের ক্ষেত্রে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় মানের সমস্যা সমাধান করে উচ্চ মূল্যে বিক্রি করা হয়, যা বাজারের দ্বৈত চরিত্রকে আরো প্রকট করে। সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সমস্যা আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ। কাঁচা চামড়া সঠিকভাবে সংরক্ষণ না করলে তা দ্রুত পচে যায়, যা এর মূল্যকে আরো কমিয়ে দেয়। লবণের মূল্যবৃদ্ধি ও সঠিক সংরক্ষণ পদ্ধতির প্রশিক্ষণের অভাব এই সমস্যাকে আরো তীব্র করে। 

এছাড়া, স্থানীয় বাজারে চাহিদার অভাব এবং রপ্তানি বাজারে প্রতিযোগিতার ঘাটতি চামড়ার দামকে আরো নিন্মমুখী করে। এই সকল সমস্যা মিলিয়ে কাঁচা চামড়া সরবরাহকারীরা তাদের শ্রম ও সম্পদের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হন, যা শিল্পের টেকসই উন্নয়নের জন্য একটি বড় বাধা।

কোরবানির চামড়ার ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা শুধুমাত্র অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের বিষয় নয়, বরং সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য একটি সামাজিক দায়বদ্ধতাও। চামড়া শিল্পের সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে এটিকে বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি শক্তিশালী খাতে রূপান্তর করা সম্ভব। এই লক্ষ্যে সরকার, বেসরকারি খাত ও সুশীল সমাজকে একযোগে কাজ করতে হবে। গঠিত উচ্চ পর্যায়ের কমিটির সুপারিশ দ্রুত বাস্তবায়ন, সকল স্টেকহোল্ডারের সমন্বয় ও কঠোর তদারকির মাধ্যমে চামড়ার বাজারে একটি ন্যায়ভিত্তিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। 

এই সুযোগ হাতছাড়া না করে একটি সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও টেকসই চামড়া শিল্প গড়ে তোলা গেলে তা বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সমাজ কল্যাণে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। এটি কেবল চামড়া শিল্পের উন্নয়ন নয়, বরং দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন যাত্রায় একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। এই শিল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতি শক্তিশালী হবে এবং সমাজের সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী তাদের প্রাপ্য অধিকার পাবে, যা দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে।

লেখক: সমাজকর্মী ও কলামিস্ট