Image description

১৯৭৩ সালের অক্টোবরে জাপান সফরকালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘আমরা দুই দেশই এশীয়। এশিয়াতে শান্তি, প্রগতি এবং স্থিতিশীলতার প্রশ্নে আমাদের দুই দেশের লক্ষ্যও এক। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিষয়ে জাপানের মতোই আমরা সমন্বিত নিয়মশৃঙ্খলার পক্ষপাতী। আবার ভাষা, সংস্কৃতি এবং জাতিগত উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে জাপানের জনগণের মতোই আমরা ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ। জনগণের মধ্যে এই ঐক্যবোধ আমাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতির সহায়ক হবে। আমাদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার সংরক্ষণের জন্যও আমরা উদগ্রীব। এসব বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুই দেশের এত সাদৃশ্যের জন্যই আমরা আমাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে জাপানের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে চাই।’
 
জাপান বাংলাদেশের সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু। এর পেছনে ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি জাপানিদের অপরিসীম ভালোবাসা। তৎকালীন সময়ে জাপান সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যরা যেমন প্রধানমন্ত্রী কাকুইয়ে তানাকা, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাসাইয়েশি ওহিরা, তাকাশি হায়াকাওয়া সবাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বন্ধু ও তাঁর রাজনীতির অনুরাগী ছিলেন। তারা বঙ্গবন্ধুকে একান্ত আপন মনে করতেন। তারা বঙ্গবন্ধুকে জাপানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিরোবুমি ইতো, আধুনিক জাপানের অন্যতম নেতা তাকামোরি সাইগোর সঙ্গে তুলনা করতেন।
 
জাপানের বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ওশিমা নাগিসা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। তার নির্মিত জোই বানগুরা (জয়বাংলা) এবং বেনগারু নো চিচি রা আমান (দ্য ফাদার অব বাংলাদেশ) চলচ্চিত্র জাপানিদের বাংলাদেশ বা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি আকৃষ্ট করে। বাংলাদেশ সম্পর্কে জাপানিদের আগ্রহ স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ পুনর্গঠনে সাহায্য করে।
 
বাংলাদেশের প্রতি আবেদন জাপানের এখনও আগের মতোই আছে। জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদার আমন্ত্রণে চার দিনের সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২৩ সালের ২৫ এপ্রিল জাপান যান।
 
প্রথম থেকেই এশিয়া মহাদেশের দুই প্রান্তের সঙ্গে সদিচ্ছা আর অর্থনৈতিক শরিকানার একটি প্রশস্ত সেতু রচনা করা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান সফরের লক্ষ্য ছিল। দুই দেশের বন্ধুত্বের সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর আগে ১৯৯৩ (বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে), ১৯৯৭, ২০১০, ২০১৪, ২০১৬ এবং ২০১৯ সালে বন্ধুপ্রতিম দেশটিতে গেছেন।
 
দুই দেশের বন্ধুত্বের সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যতবারই জাপান সফরে গেছেন, ততবারই তিনি জাপানের প্রতি অংশীদারত্ব সহযোগিতা কামনা করেছেন। এখানে দুয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। যেমন ২০১০ সালের ২৯ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন জাপান সফর করেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী জাপানে সফররত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্মানে এক নৈশভোজের আয়োজন করেন। ওই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আমরা স্থিতিশীল অর্থনীতি, পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং একটি চমৎকার ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করেছি। এর ফলে বাংলাদেশ উদীয়মান অর্থনীতির পরবর্তী এগারো হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। আমাদের মধ্যে একটি অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি হলে সুপ্ত সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে উভয় দেশই লাভবান হতে পারে।’ 
ঠিক একইভাবে ২০১৪ সালে জাপানের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী শিনজো অ্যাবে বাংলাদেশ সফর করেছেন। ২০১৪ সালের ৬ সেপ্টেম্বর তার সম্মানে দেওয়া নৈশভোজে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ-জাপান সম্পর্ককে উচ্চমাত্রায় নিয়ে যাওয়ার অভিলাষ ব্যক্ত করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আগামী দিনগুলোতে দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান বন্ধুত্ব এবং সুসম্পর্ক অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাবে। সমন্বিত অংশীদারত্ব নীতির ওপর ভিত্তি করে আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাব।’ বলা বাহুল্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সেদিনের সমন্বিত অংশীদারত্ব নীতির বাস্তবায়ন ২০২৩ সালের ২৬ এপ্রিল জাপান প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা এবং জাপান সফররত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর কৌশলগত অংশীদারত্ব ঘোষণার মাধ্যমে এর যথার্থতা প্রমাণিত হলো।
 
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপানের প্রতি আগ্রহের ফলে আমরা দেখতে পাই জাপানের সহযোগিতামূলক আচরণের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই বাংলাদেশ তার কূটনীতির অতিমাত্রার পশ্চিমমুখী নির্ভরতাকে কিছুটা হলেও কাটিয়ে ওঠে প্রথমবারের মতো পূর্বমুখী হওয়ার চিন্তাকে গুরুত্ব দিতে শুরু করে। ফলে বাংলাদেশ ও জাপানের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এখন কৌশলগত অংশীদারত্বে উন্নীত হয়েছে। গত ২৬ এপ্রিল জাপান প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা এবং জাপান সফররত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতিতে এই ঘোষণা দেওয়া হয়। 
 
ঘোষণাতে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘কৌশলগত অংশীদারত্ব ও সহযোগিতা’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা কৌশলগত অংশীদারত্ব হলো একাধিক দেশের মধ্যকার একটি অংশীদারত্ব যেখানে তারা তাদের সম্পদগুলো যেমন আর্থিক, পরিচালনামূলক, প্রযুক্তিগত পাশাপাশি তাদের বিদ্যমান স্বতন্ত্র প্রতিযোগিতামূলক সুবিধার সমন্বয়ে পারস্পরিক লক্ষ্যগুলো যেন আরও ভালোভাবে অনুসরণ করতে পারে। অনেক কূটনীতিবিদরা মনে করেন-স্বাস্থ‌্য, শিক্ষা, যোগাযোগ, অবকাঠামো বা অর্থনৈতিক সহযোগিতার মতো বিষয়গুলোও কৌশলগত অংশীদারত্বের বাইরে নয়। ইতিপূর্বে ভারত এবং চীনের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারত্ব ছিল এখন জাপানের সঙ্গেও যুক্ত হলো।
 
আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে জাপানের সঙ্গে এই সহযোগিতা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এ সম্পর্কে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশ-জাপান বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ‘ব্যাপক অংশীদারত্ব’ থেকে সফলভাবে ‘কৌশলগত অংশীদারত্বে’ পৌঁছেছে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী কিশিদা এবং আমি আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের আদ্যোপান্ত আলোচনা করেছি। আমরা খুব খুশি যে, আমরা বাংলাদেশ-জাপান বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় সম্পকর্কে ব্যাপক অংশীদারত্ব থেকে কৌশলগত অংশীদারত্বে পৌঁছাতে পেরেছি। অনুরূপভাবে জাপানের প্রধানমন্ত্রী কিশিদা বলেন, ‘আমরা আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক কৌশলগত অংশীদারত্বে উন্নীত করেছি। আগামীতে এ সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হবে। পাশাপাশি বিভিন্ন ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক গভীর করতে এবং আন্তর্জাতিক ফোরামে সহযোগিতা বাড়াতে দুই দেশ একসঙ্গে কাজ করবে।’
 
এই কৌশলগত অংশীদারত্বের ফলে এখন জাপান এবং বাংলাদেশ দুটি দেশই যৌথভাবে নিজেদের জনগণকে উন্নয়ন ও মঙ্গলজনক সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে সক্ষম হবেন বলে ধারণা করা যায়। বাংলাদেশ ও জাপানের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক কৌশলগত অংশীদারত্বে উন্নীত হওয়ায় আগামী ৫০ বছরে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের রূপরেখা এক নতুন গতিপথের দিকে ধাবিত হবে।
 
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কৌশলগত অংশীদারত্ব ও সহযোগিতা নীতি যেন সহযোগিতার বিনিময়ে সহযোগিতা পাওয়া। এ শুধু সাহায্য প্রাপ্তির আশায় নয়। পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সমঝোতা এবং সহমর্মিতার ভিত্তিতে জাপানের সহযোগিতা পেতে চায় বাংলাদেশের জনগণ। অপরিমেয় প্রাকৃতিক সম্পদ এবং জনশক্তি আছে বাংলাদেশের। এর সদ্ব্যবহারের জন্যই আমাদের দরকার প্রযুক্তি বিদ্যায় উন্নত দেশ জাপানের সহায়তা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কৌশলগত অংশীদারত্ব ও সহযোগিতা নীতিতে বলিষ্ঠ প্রতিফলন ঘটেছে বাংলাদেশের অনুসৃত আদর্শের, বিশেষ করে সমান মর্যাদা ও শরিকানার সহযোগিতা নীতির।
 
জাপানের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্কের ফলে বাংলাদেশ যেসব সুবিধা পাবে তার বিবরণ তুলে ধরতে গিয়ে জাপানে বাংলাদেশ দূতাবাসে এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘এই বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে দ্রুততম সময়ে ইকোনমিক পার্টনারশিপ চুক্তি সম্পন্ন, বিগ-বি প্রকল্পের মাধ্যমে আঞ্চলিক যোগাযোগ জোরদারকরণ, অর্থনৈতিক অবকাঠামোর উন্নয়ন, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি, জাপান ওভারসিজ কো-অপারেশন ভলান্টিয়ার প্রকল্প পুনরায় চালুকরণ, বাণিজ্য, বাংলাদেশের বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চলে জাপানি বিনিয়োগ, মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক, ঢাকা-টোকিও সরাসরি বিমান চলাচল ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা হয়। এ ছাড়া জাপান সরকার বাংলাদেশকে বাজেট সহায়তা প্রদানের আশ^াস দিয়েছে।’ উজ্জ্বল ভবিষ‌্যৎ গড়ার যে সাধারণ আকাক্সক্ষা তার ভিত্তিতে দুই দেশ তাদের সম্পর্ককে কৌশলগত অংশীদারত্ব ও সহযোগিতার পর্যায়ে উন্নীত করতে ঐকমতে‌্য পৌঁছেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে বিবৃতিতে। বলা চলে, ২০২৩ সালের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান সফর উভয় দেশের বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা আরও স্থায়ী ও ইস্পাত কঠিন হয়েছে, সহযোগিতার নতুন ক্ষেত্র প্রসারিত হয়েছে।
 
এবারের সফরে সহযোগিতা এগিয়ে নিতে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর দুই দেশের সরকারের মধ্যে ৮টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। খুবই গুরুত্বপূর্ণ চুক্তিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-কৃষি ও শুল্ক বিষয়ক, প্রতিরক্ষা, আইসিটি এবং সাইবার নিরাপত্তা, শিল্প আপগ্রেডিং, বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ, জাহাজ রিসাইক্লিং এবং মেট্রোরেল বিষয়ক। দুই প্রধানমন্ত্রীর সফল ও ফলপ্রসূ আলোচনা বাংলাদেশ জাপানের একটি যৌথ ইশতেহারে প্রকাশিত হয়েছে। ৩০টি অনুচ্ছেদে রচিত এই ইশতেহারের আলোচনায় স্থান পেয়েছে দ্বিপক্ষীয় থেকে আন্তর্জাতিক অনেক ইস্যুও। 
রোহিঙ্গাদের প্রসঙ্গে জাপানের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে বলে যৌথ বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে। রাজনীতি বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় নেতৃত্বের অবদান থাকবে সমাজ জীবনের প্রতিটি স্তরে। রাষ্ট্রে, সমাজে, পরিবারে, কলকারখানায়, অফিস-আদালতে, খেলার মাঠে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অর্থাৎ সর্বস্তরে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব অসামান্য রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও ব্যক্তিগত পরিশ্রমের ফলে জাপানের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার যে নতুন দিগন্ত বা কৌশলগত অংশীদারত্বের নীতি উন্মোচিত হয়েছে, তা সর্বতোভাবে সার্থক ও সাফল্যমণ্ডিত হয়ে বাংলাদেশের যাবতীয় সুখ-সমৃদ্ধি আসুক এবং উভয় দেশের বন্ধুত্ব অমর ও অটুট থাকুক আমরা সর্বান্তঃকরণে সেই কামনাই করি।
 
অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়