
রাজধানীর মোহাম্মদপুরে মোবাইল ফোন ছিনতাইয়ের অভিযোগ জানাতে গিয়ে পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে 'গড়িমসির' অভিযোগ তুলেছেন এক ভুক্তভোগী।
ভুক্তভোগীর অভিযোগ অনুযায়ী, মোহাম্মদপুর থানার ওসি আলী ইফতেখার হাসান তাকে বলেন, "আমি ওসি হয়েও এই কমদামি ফোন ব্যবহার করি, আপনি এত দামি ফোন নিয়ে ঘুরলে ছিনতাই তো হবেই!" এই মন্তব্য নিয়ে ইতোমধ্যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে।
অভিযোগকারী আরও জানান, থানায় যাওয়ার পর ‘অভিযোগ লেখার জন্য অতিরিক্ত মানুষ’ নেই বলেও তার সঙ্গে ‘অসহযোগিতা’ করা হয়। পরে তাকে কাগজ দেওয়া হলেও দায়িত্বরত পুলিশ সদস্য বলেন ‘কলম নেই’। এই ঘটনা পুলিশের দায়িত্ব পালনে অবহেলা এবং নাগরিকদের প্রতি তাদের মনোভাব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
বৃহস্পতিবার রাতে ওই ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনায় আসে। এরপর 'দায়িত্বে অবহেলার' অভিযোগে এসআই জসিম উদ্দীন, এএসআই মো. আনারুল ইসলাম ও দুই কনস্টেবল মো. মাজেদুর রহমান এবং মো. শিহাব উদ্দিন শিহাবকে প্রত্যাহার করার কথা জানান ডিএমপির মোহাম্মদপুর জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার জুয়েল রানা।
শুক্রবার দুপুরে মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ এলাকায় অভিযান চালিয়ে ভুক্তভোগীর ফোনটিসহ তিন ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তারের তথ্য দিয়েছেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।
গ্রেপ্তাররা হলেন- মূল ছিনতাইকারী ইউসুফ (২৬), তার সহযোগী সিয়াম (২৩) ও জহুরুল (২২)।
ভুক্তভোগীর সঙ্গে ওসির এমন 'আচরণ' নিয়ে জুয়েল রানা বলেন, "বিষয়টি তদন্তাধীন, তদন্ত শেষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।"
আহমাদ ওয়াদুদ নামে ওই ভুক্তভোগী বৃহস্পতিবার রাত ১১টায় ছিনতাইয়ের তথ্য দিয়ে ফেইসবুকে লেখেন। দীর্ঘ লেখার শিরোনামে তিনি লেখেন, ‘মোহাম্মদপুর থানা পুলিশের সাথে এক ঘণ্টা’।
ওয়াদুদ লিখেছেন, "ছিনতাইকারীরা আমার একটি মোবাইল ফোন এবং কিছু টাকাপয়সাসহ মানিব্যাগ নিয়ে যায়। আমাকে চাপাতি দিয়ে কিছু আঘাত করে। সৌভাগ্যবশত আঘাত গুরুতর নয়। আমার সঙ্গে আমার স্ত্রী ছিলেন। একটু দূরে থাকায় তিনি নিরাপদ ছিলেন।"
ঘটনাস্থল থেকে মোহাম্মদপুর থানার দূরত্ব ৩ মিনিট। ৫ মিনিটের মধ্যেই তিনি স্ত্রীসহ থানায় যান জানিয়ে ওয়াদুদ লিখেছেন, "সোজা ডিউটি অফিসারের রুমে গিয়ে বলি, ৫ মিনিট আগে তিন রাস্তার মোড়ে আমার সাথে একটি ছিনতাই হয়েছে। তারা আমাকে বললেন, একটু অপেক্ষা করেন। দেখছি।
"ডিউটি অফিসারের নাম এসআই জসিম। তার পাশে সাদা পোশাকে একজন পুলিশ সদস্য কাগজে অন্য একজনের অভিযোগ লিখছেন। সাদাপোশাকের ওই পুলিশ সদস্য আমার দিকে আঙুল তাক করে উগ্রভাবে বলেন ‘আপনার শার্টের বোতাম লাগান’।
“আমি তখনই খেয়াল করলাম, ছিনতাইকারীদের আঘাতের সময় আমার একটি বোতাম খুলে গিয়েছিল। আমি ওই অফিসারের কথায় আহত হলেও কোনো ঝামেলায় না গিয়ে সরি বলে বোতামটি লাগিয়ে নিলাম। এরপর তিনি আমাকে আমার সবগুলো বোতাম লাগাতে বললেন। আমার তখন শুধু টাই-বাটন, অর্থাৎ একদম গলার সঙ্গে থাকা বোতামটি খোলা ছিল, যেটা সাধারণত আমরা কখনো লাগাই না। আমি বললাম, প্লিজ আমার অভিযোগটি নিন।"
তখন তারা 'অভিযোগ লেখার লোক নেই' জানালে ভুক্তভোগী নিজেই অভিযোগ লিখে দিতে চেয়ে কাগজ ও কলম চান।
ওয়াদুদ লিখেছেন, থানা থেকে তাকে কাগজ দিলেও 'এক্সট্রা কলম নেই' বলে জানিয়ে দেয়। অথচ সেখানে অনেকগুলো কলম পড়ে ছিল বলে তার ভাষ্য।
তিনি লিখেছেন, "আমার স্ত্রী নিজের ব্যাগ খুঁজে আমাকে একটি কলম দিলেন। আমি সেটা দিয়ে আমার অভিযোগ লিখলাম। ডিউটি অফিসার আমার অভিযোগের কোনো কপি দিলেন না। শুধু আমাকে একটি ফোন নম্বর দিয়ে বললেন, এটা এএসআই আনারুলের নাম্বার। উনি এখন নবোদয় হাউজিংয়ে ব্যস্ত আছেন। আপনি ফোনে উনার সাথে কথা বলেন।
"আমি তখন তাকে বিনীতভাবে বললাম, আমার মনে হয় এখন ঘটনাস্থলে গেলে ওদের পাওয়া যাবে। দয়া করে এমন কাউকে বলুন, যিনি আমাদের সঙ্গে এখন সেখানে যেতে পারবেন।"
এসআই জসিম 'প্রচণ্ড বিরক্ত' হয়ে বললেন, "এটা সম্ভব নয়। ওই এলাকায় ইনি ছাড়া আর কেউ যেতে পারবে না। এটা তার এলাকা। আপনি এখান থেকে এখন চলে যান। ওখানে গিয়ে ছিনতাইকারীদের পাবেন না। আবার অনুরোধ জানাতে এসআই জসিম বললেন, ‘আপনার কমন সেন্স নাই’? ছিনতাইকারী আপনার-আমার জন্য বসে থাকবে নাকি? আমি তবু তাকে অনুরোধ করলাম, কাছেই যেহেতু, যেন একবার বিষয়টি বিবেচনা করা হয়।"
ভুক্তভোগীর ভাষ্য, "আমি সেখান থেকে বের হয়ে ওসি সাহেবের রুমে যাই। ওসি ইফতেখার হাসান সাদা পোশোকে ছিলেন। আমি তাকে ছিনতাইয়ের ঘটনাটি বললাম। তিনি বললেন, আমি ওসি হয়েও এই কমদামি ফোন ব্যবহার করি, আপনি এত দামি ফোন নিয়ে ঘুরলে ছিনতাই তো হবেই!
"আমি তার কথায় কোনো উত্তর দিলাম না। আমি তাকে অনুরোধ করলাম, যেন এখনই আমার ছিনতাইয়ের বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেন। তিনি এএসআই আনারুলের সাথে যোগাযোগ করে আমাকে তার জন্য বাসস্ট্যান্ড মোড়ে অপেক্ষা করতে বলেন।"
মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডসহ মোট তিনটি পয়েন্ট ঘুরে এএসআই আনারুলের সাথে দেখা করার কথা জানিয়ে ভুক্তভোগী লিখেছেন, "তার সঙ্গে আরো সাত-আটজন পুলিশ সদস্য ছিল। আনারুল সাহেব আমার কথা শুনে বলেন, ‘চলেন আমরা ঘটনাস্থলে যাই।’ আমি তার সঙ্গে গাড়িতে করে ঘটনাস্থলে যাই। এর মধ্যে প্রায় ৪০ মিনিট পার হয়ে গেছে।
"তবে ঘটনাস্থলে যাওয়ার পর আমি ওই ছিনতাইকারীদের সেখানেই বসে থাকতে দেখি। আমি দূর থেকে তাদের দেখিয়ে দিলেও এএসআই আনারুল সেখানে না গিয়ে একটু দূরে অন্য একটি জায়গায় গিয়ে কিছু লোকের সাথে কথোপকথন করেন। মিনিট দুয়েক পরে তিনি ফিরে আসলে আমি এএসআই আনারুলকে আবার ওই সন্ত্রাসীদের দেখিয়ে দেই।
"তবে আনারুল সেখানে না গিয়ে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। এ সময় সন্ত্রাসীরাও পুলিশসহ আমাকে দেখে আস্তে আস্তে ঘটনাস্থল থেকে সরে যেতে থাকে। আমি অবাক হয়ে এএসআই আনারুলের দিকে তাকিয়ে থাকি!"
ছিনতাইকারীরা চলে যাওয়ার পর এএসআই আনারুল ভুক্তভোগীকে বলেন, "এখন তো ওদের পাওয়া যাবে না। আমরা গভীর রাতে এসে এখানে অভিযান চালাবো। আপনারা এখন বাসায় চলে যান।"
ওয়াদুদের অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে মোহাম্মদপুর থানার ওসি আলী ইফতেখার হাসানকে ফোন করা হলে তিনি ধরেননি।
Comments