Image description

চলতি মাসের ৩ তারিখে টাঙ্গাইলের গোপালপুরের বাসিন্দা মারুফা আক্তারকে পরিবারের অমতে বিয়ে করে স্থানীয় মিঠাছরা বাজারে বাসা ভাড়া নেন মধ্যম সোনাপাহাড় গ্রামের ড্রামট্রাক চালক আনিসুর রহমান। পরিবারকে মানিয়ে মাত্র ৫ দিন আগে রবিবার (১৫ জুন) রাতে ভালোবাসার মানুষকে ঘরে তুলেছিলেন। সেদিন রাতে পরিবারের সদস্যরা ছোট আয়োজন করে নতুন বউকে ঘরে তুলেছিলেন। কে জানতো দুই হাতের মেহেদির রং মুছার আগে বিধবা হবেন মারুফা খাতুন।

জানা গেছে, মিরসরাই উপজেলার মধ্যম সোনাপাহাড় গ্রামের তিন বন্ধু মো. আনিসুর রহমান, রিয়াজ ও আরাফাত স্থানীয় ইস্পাত কারখানায় কাজ করতেন।

বৃহস্পতিবার রাত ৮টার দিকে ১৮ বছর বয়সী ওই তিন বন্ধু চট্টগ্রামমুখী রেল লাইনের উপর দিয়ে হেঁটে কারখানায় কাজে যাচ্ছিল। এ সময় ডাউন লেনে আসা ঢাকামুখী একটি ট্রেন পিছন দিক থেকে তাদের ধাক্কা দিলে ঘটনাস্থলেই তিনজনের মৃত্যু হয়। ওই দিন রাতেই মধ্যম সোনাপাহাড় গ্রামের বাড়িতে তাদের মরদেহ নিয়ে আসা হয়। রাতে ২টায় বাড়ির উঠানে জানাজা শেষে তাদের লাশ পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। নিহতরা সবাই হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান।

সোনাপাহাড় গ্রামে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী নিহত রিয়াজ উদ্দিনের চাচা রায়হান উদ্দিন বলেন, ঢাকামুখী ট্রেন গুলো আপ লাইন (ঢাকামুখী লেইন) দিয়ে চলাচল করে। রিয়াজ, আরাফাত ও আনিস চট্টগ্রামমুখী লেইন দিয়ে উত্তর দিকে হেঁটে যাচ্ছিল। তাদের ১০-১৫ হাত পিছনে ছিলেন তিনি। কিন্তু আপ লাইনের ট্রেনটি ডাউন লাইন (চট্টগ্রামমুখী লাইন) দিয়ে আসছে দেখতে পেয়ে তিনি দ্রুত লাফ দিয়ে লাইনের বাহিয়ে চলে যান। সামনে থাকা রিয়াজসহ অন্যদের বিষয়টি জানাতে চাইলেও তারা শুনতে পায়নি বলে দুরর্ঘটনা শিকার হয়। দুর্ঘটনার পর তাদেরকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়া হয়।

নিহত মো. আনিসুর রহমানের বোন আইরিন সুলতানা পপি বলেন, দুর্ঘটনা নিয়ে ভুল তথ্য ছড়াচ্ছে। তার ভাই ও ভাইয়ের বন্ধুরা কেউই রেল লাইনের উপর বসে গেম খেলেনি ৷ তারা লাইনের উপর দিয়ে হেঁটে বিএসআরএম কারখানায় বকেয়া বেতন আনতে যাচ্ছিল। কিন্তু বেতনও নেয়া হল না, তাদের ঘরেও আর ফেরা হল না।

শোকে পাথর হয়ে যাওয়া আনিসের বাবা আবু তাহের বলেন, ছেলেটি ছিল তাদের সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম। তারা আয়ে চলত সংসার। এরমধ্যে মাত্র ১৭ দিন আগে বিয়ে করেছিলেন। গত ৪ দিন আগে আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন বৌকে ঘরে তুলেন। আনিসের অকাল মৃত্যুতে ঘরের আনন্দ এখন বিষাদের পরিণত হয়েছে।

নিহত রিয়াদ উদ্দিনের বাবা জিয়াউর রহমান বলেন, ঝুঁকি ও দুর্ঘটনার কথা চিন্তা করে তার একমাত্র ছেলেকে গাড়ি চালানোর পেশা থেকে সরিয়ে এনে বিএসআরএম কারখানায় একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অধীনে নিরাপত্তা কর্মীর কাজে দেন। কিন্তু এমন দুর্ঘটনায় ছেলে যে তাদেরকে রেখে চলে যাবে ভাবতেও পারছেন না। তার এক ছেলে দুই মেয়ের মধ্যে রিয়াজ সবার বড় ছিল।

রিয়াজের খালাত ভাই মো. রিফাত বলেন, রিয়াজ বিএসআরএমে কাজ করত। বৃহস্পতিবার রাতে বকেয়া বেতন তোলার জন্য তিন বন্ধু মিলে কর্মস্থলে যাওয়ার পথে ট্রেনের ধাক্কায় সে মারা যায়।

প্রায় ১৭ বছরে আগে দুই বছরের আরাফাতকে এতিম করে দিয়ে মারা যায় তার মা রোকসানা আক্তার। এরপর আরাফাতকে মামার বাড়িতে নিয়ে আসেন মামা জামাল উদ্দিন। মামার বাড়ির সকলের আদরে বড় হয় আরাফাত। কিন্তু লেখাপড়া বেশি দূর না করায় গাড়ির সহকারী হিসেবে কাজে দেয়। দুর্ঘটনায় নিহত আনিসুর রহমানের গাড়ির সহকারী হিসেবে কাজ করতো আরাফাত। বৃহস্পতিবার রাতে কারখানায় বকেয়া বেতন নিবে এবং কাজে যেতে বাড়ি থেকে বের হয়। কিন্তু পথে ট্রেনের ধাক্কায় মারা যায় আরাফাত। ভাগিনার এমন মৃত্যুতে ভেঙ্গে পড়েন মামা জামাল উদ্দিন।

তিনি বলেন, বোনের রেখে যাওয়া এতিম সন্তানকে তিনি বাঁচাতে পারলেন না। আরাফাতের মৃত্যু যেন একটি বংশের পরিসমাপ্তি। ট্রেনটি ডাউনলেনে পথে আসার কারণে দুর্ঘটনার শিকার তিনজন বুঝতে পারেনি ট্রেন আসছে। কারণ তারা যে লাইনের হাঁটছে সে লাইনে তখন ট্রেন আসার কথা নয়। আসলেও ঢাকার দিক থেকে আসা কথা।

সীতাকুণ্ড রেলওয়ে থানায় আইসি উপ-পরির্দশক আশরাফ সিদ্দিকী বলেন, রেললাইনের বড়তাকিয়া অংশে একটি কালভার্ট কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় মিরসরাইয়ের কিছু অংশে চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা ট্রেন আপ লাইনের পরিবর্তে ডাউন লাইনে চলছিল। বৃহস্পতিবার রাতে ট্রেনের ধাক্কায় মধ্যম সোনাপাহাড় এলাকায় তিনজনের মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে তদন্ত চলছে। এ বিষয়ে পুলিশ বাদী হয়ে একটি অপমৃত্যুর মামলাও দায়ের করা হয়েছে বলে জানান তিনি।