Image description

দেশের উচ্চশিক্ষায়তন নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই আলোচনা চলছে। দেশের পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষা বা গবেষণা নয়, অন্য কিছুর জন্য বারবার সংবাদের শিরোনাম হচ্ছে। কোনোটিতে চলছে তুমুল তর্ক-বিতর্ক। সর্বশেষ তর্কের কেন্দ্রে ঢুকে পড়েছে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। বিষয়–রাজনীতি। কিন্তু আসলেই কি রাজনীতি নিয়ে আলোচনা চলছে, নাকি রাজনীতি শব্দটির আড়ালে ক্ষমতা ও আধিপত্য নিয়ে বিতর্ক চলছে?

প্রসঙ্গটিতে যাওয়ার আগে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে গত কয়েক মাসে যে পরিমাণ আলোচনার-সমালোচনা দুর্নীতি, স্বজন প্রীতি, ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের মতো ঘটনার সংবাদ শিরোনাম হয়েছে তা নজিরবিহীন এবং দুঃখজনক।

দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, এখানে অভিযোগের তালিকায় রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কিছু শিক্ষক ও শিক্ষার্থী। অথচ এসব বিশ্ববিদ্যালয় আলোচনায় আসার কথা ছিল গবেষণা বা লেখাপড়া-বিষয়ক কোনো কারণে। এরই ধারাবাহিকতায় আলোচনায় এসেছে বুয়েট। বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছেন। আন্দোলনের বিষয়- বুয়েট ক্যাম্পাসকে রাজনীতিমুক্ত রাখা। এর বিপরীতে সভা-সমাবেশ করছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। তাদের ভাষ্য, রাজনীতি থাকতে হবে। বিষয়টি আদালত, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। তর্কে যোগ দিয়েছেন বুয়েটের বর্তমান তো বটেই, সাবেক শিক্ষার্থীরাও। 

সংবাদমাধ্যম থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সবখানে এ সম্পর্কিত আলোচনায় একটা দ্বিধাবিভক্তি দেখা যাচ্ছে। কেউ বলছেন, রাজনীতি করার অধিকার সবার আছে। তো কেউ বলছেন, যে রাজনীতি সংঘাতের শিক্ষা দেয়, শিক্ষার্থীদের কাউকে হত্যাযোগ্য, আবার কাউকে হন্তারকে পরিণত করে, সে রাজনীতি থাকার কোনো দরকার নেই।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা বুয়েট, এক মেধাভাণ্ডার। দেশসেরা মেধাবীদের বিদ্যাপীঠ। শিশুশ্রেণি থেকে দ্বাদশ পর্যন্ত ক্লাসের সেরা মেধাবীরা সেখানে ভর্তির যোগ্য। তারপর ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া। সচরাচর বিবেচনাটা এমনই। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি কিভাবে চলবে তা এখন ঠিক করে দিচ্ছেন আদু ভাইরা। অথবা বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে নামকাওয়াস্তে পড়ুয়া বা পাস করা ছাত্ররা। এটিই ছাত্ররাজনীতির নিয়তি বা পরিণতি। 

কঠিন-নিষ্ঠুর এক ঘটনার জেরে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয় বুয়েটে। এর একটা পার্ট ছিল বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ। আবরার ফাহাদকে নির্যাতন ও হত্যার জেরে প্রায় সাড়ে চার বছর ধরে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ বুয়েটে। ছাত্রলীগ টের পাচ্ছিলো ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ বলা হলেও এটি প্রকারান্তরে হয়ে যায় ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধের মতো। সেখানকার সাধারণ শিক্ষার্থীরা রাজনীতি চায় না, নাকি ছাত্রলীগকে চায় না-এ প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে। এ বাস্তবতায় বুয়েটে ঢোকার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে ছাত্রলীগ। রোজার মাসে সগৌরবে মধ্যরাতে ঢুকেও পড়ে। গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনের আনা-গোনাও ব্যাপক। এর মাঝেই বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি চলবে বলে নির্দেশনা জারি হয়েছে উচ্চআদালত থেকে। ছাত্রলীগের এক নেতার রিটের প্রেক্ষিতেই নির্দেশনাটি জারি হয়। এ নিয়ে নতুন করে থমথমে পরিস্থিতি প্রতিষ্ঠানটিতে। 

পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার শঙ্কা সাধারণ শিক্ষার্থীদের। বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা বরাবরই একটি নিরাপদ এবং সুপ্ত ক্যাম্পাস চেয়ে এসেছে। মাঝেমধ্যে পেয়েছেও। রাজনীতিবিহীন নিরাপদ ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য সারাদেশব্যাপী জনগণের কাছে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত এবং সমাদৃত হয়েছে। কখনো কখনো তা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ২০১৯ এর ৭ অক্টোবর আবরার ফাহাদ হত্যার পর এখানে ছাত্ররাজনীতি স্থগিত করে দেয়া হয়। ছাত্রলীগ তা আর সইতে পারছিল না। সংগঠনটির সভাপতি সাদ্দাম হোসেনের সাফকথা- বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের নাটক বন্ধ করতে হবে। 

বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের নামে ‘অন্ধকারের রাজনীতি’র চাষাবাদ হচ্ছে দাবি করে তিনি বলেন, ছাত্রলীগ সেখানে রাজনীতি করতে না পারলেও হিযবুত তাহরীর, জেএমবি ও ছাত্র শিবিরের প্রশিক্ষিত ক্যাডাররা বুয়েটে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। 

বুয়েটে অনুপ্রবেশের অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেছেন, অনুপ্রবেশের রাজনীতি ছাত্রলীগ করে না। ছাত্রলীগ প্রবেশ করে, পরিবর্তন করে। শুধু বুয়েট কেন সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যাওয়ার অধিকার তাদের রয়েছে। 

আমি রাজনীতি করি, সে জন্য বুয়েটে যেতে পারব না- এ প্রশ্ন তুলে দলের সাধারণ সম্পাদক হেবিওয়েট মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনা অপকর্ম-অন্যায়ের বিরুদ্ধে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করেন এবং সেই নীতিতেই আমরা এগিয়ে চলছি। আজকে বিশ্বজিৎ হত্যার বিচার করতে গিয়ে আমাদের অনেক কর্মী দণ্ডিত হয়েছে। তারপর বুয়েটে আবরার হত্যাকাণ্ডে আমরা কাউকে ছাড় দেইনি। শেখ হাসিনা কাউকে ছাড় দেননি। 

গড়ে হরিবল যতো কথাই বলা হোক, বুয়েটের একটি ভিন্নতা রয়েছে। এর পুরো পদ্ধতিটাই অন্যরকম, পরিবেশ ভিন্ন। পড়াশোনার চাপ বেশি থাকায় বুয়েট শিক্ষার্থীদের দম ফেলার সময় হয় না।

রাজনীতি, ছাত্ররাজনীতি, শ্রমিক রাজনীতি কী? তা কাদের জন্য, কাদের নিয়ে, কাদের দিয়ে? রাজনীতি থাকলেই তো ছাত্র, শ্রমিক ইত্যাদি রাজনীতির প্রশ্ন। এসব প্রশ্নের জবাব কারও জানার বাইরে নয়। বিশেষ করে ছাত্ররাজনীতি ভালো কিছু হয়ে থাকলে বিইউপি, এমআইএসটি, আদমজীর মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কেন এ ‘ভালো’ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে? ক্যাডেট কলেজগুলোকেও কেন ভালোর বাইরে ফেলে রাখা হচ্ছে? এ ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও বড় ভাইরা আছেন। ওই বিষয়-আশয়ই নেই সেখানে। অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ, হার্ভার্ড, ক্যালিফোর্নিয়া প্রভৃতি বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনোদিনও ছাত্ররাজনীতি ছিল? বা আছে? 

চলমান ছাত্ররাজনীতিতে চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, খুন, অরাজকতা, মাদকবাণিজ্য, সিট দখল হাসিল হয়। বড় ভাই ও মুরব্বি দলগুলোর ছাত্ররাজনীতি খুব দরকারি। লড়াকু-সাহসী আতিপাতি ভীষণ জরুরি। নইলে পেছনে পেছনে স্লোগানের দোহারি মিলবে কোথায়? আগে ছাত্ররাজনীতি হতো ছাত্রদের স্বার্থরক্ষার জন্য আর বর্তমান ছাত্ররাজনীতি নিরীহ ছাত্রদের জীবন সংহার করে। এখানে আদর্শ অবান্তর। আদর্শে তারা কাছাকাছি। উদ্দেশেও বেশ মিল। আদর্শ থাকলে আদর্শকে আদর্শ দিয়ে মোকাবিলার বিষয় থাকত। হাতুড়ি, হেলমেট, রামদা, গুলি-বন্দুকের দরকার হতো না।

তবে দেশে ছাত্ররাজনীতিতে পচন ধরেছে আরও আগেই। হালে সেটা দুর্গন্ধে উৎকট। এর সুবাদে আছে কেবল দলীয় স্বার্থ হাসিলের লাঠিয়াল হওয়ার গ্যারান্টি। বর্তমানই আগামীর ইতিহাস ও সম্বল। শিক্ষাঙ্গনে ছাত্ররাজনীতি থাকা না থাকা নিয়ে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটা নির্মোহ জরিপ চালানো গেলে প্রকৃত অবস্থাটা বোঝা যেত। সব অভিভাবকই তার সন্তানদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শুধু শিক্ষার জন্যই পাঠান। রাজনীতির নামে মাস্তানি দলবাজি চাঁদাবাজি গুন্ডামি শেখাতে চাইলে ঢাকায় গুলিস্তান-পল্টন বা ঢাকার বাইরে কোনো স্টেশন-টার্মিনাল বা নেতার বাড়ির আশপাশে পাঠালেই পারতেন। 

তবে, শিক্ষক কমিউনিটিতে গোলমাল আছে। তাদের অনেকেরই নিজ নিজ পছন্দের ও নিয়ন্ত্রণের ছাত্ররাজনীতি ভীষণ পছন্দের। ছাত্রদের তারা নিজেদের বাহিনীর মতো খাটান। লাল-নীল-সবুজের বাহারে শিক্ষক সমিতি, সিন্ডিকেট, সিনেটসহ নিজেদের নির্বাচনগুলো তারা ঠিকঠাক মতোই করেন-করান। যথারীতি কর্মচারী ইউনিয়নের নির্বাচনও হয়। এসব নির্বাচনে ছাত্র নেতাদের বেশ খাটাখাটুনি করানো হয়। বছরের পর বছর যায়, ডাকসুসহ ছাত্রসংসদ নির্বাচন কিন্তু হয় না। শিক্ষাগুরুদের এদিকে বেশ অনীহা।

দেশ স্বাধীনের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নতুন অধ্যাদেশ করে শিক্ষকদের রাজনীতি ইত্যাদির অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটের জন্য বলা হয়েছিলো যে, এই দুটো বিশ্ববিদ্যালয় নষ্ট করা চলবে না। ‘নষ্ট’ শব্দটির রহস্য বা মাহাত্ম্য কারো না বোঝার মতো নয়। 

এভাবে সব দিকে শীর-মাথা নাড়া তার কৌশল না আরেকটি রাজনীতি- এ নিয়ে নানা কথার কচলানি আছে। এই মাথা নাড়ার মাঝে বাড়তি হিসাবে বলেছেন, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের রাজনীতি ফিরলে শিক্ষার্থীদের জীবন জিম্মি হবে বলে দাবি অনেকের, আবরার হত্যার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেছেন, বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের রাজনীতি ফিরিয়ে এনে শত শত মেধাবী ছাত্রের জীবনকে জিম্মি করতে দেওয়া ঠিক হবে না, কারণে শিক্ষার্থীদের মনে ভয় রয়েছে। 

এখন ছাত্রলীগের ভালো কাজ দেখলে ওই ভয় কেটে যেতে পারে ভিসির এই মন্তব্যে আরো বলা হয়, ছাত্রলীগের ভালো ভালো কাজ বুয়েটের শিক্ষার্থীরা আগে দেখেছে। গত ক’দিনে আরো দেখছে। বাকি আর কী দেখতে পারে?  মধ্যরাতে ছাত্রলীগের বুয়েট ক্যাম্পাসে বীরবিক্রমে প্রবেশের মধ্য দিয়ে নতুন করে যে ভয় ঢুকেছে এর ডালপালা কেবল ছড়ছেই। তাদের নতুন এ ভয় সামনে কোন পরিস্থিতি ডেকে আনে কে জানে! এ ভয় বুয়েটের পাঠদান বা পড়াশোনারই বা কী হাল করে ছাড়ে?

পরিশেষে, ছাত্ররাজনীতির বিলোপের বদলে অপছাত্ররাজনীতি এবং আধিপত্যবাদী ছাত্ররাজনীতির সাথে বিরোধ হোক। রাজনীতি নামের শব্দটি নিজের সত্যিকারের অর্থ ফিরে পাক এবং জন বা গণনীতিতে রূপান্তরিত হোক। আর এই রূপান্তরের দায়টি মেধাবীদেরই কাঁধে নিতে হবে। তাঁদেরই ঠিক করতে হবে যে, তাঁরা অমেধাবীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবেন, নাকি নিজেদের নিয়ন্ত্রণ নিজেরা নেবেন।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।


মানবকণ্ঠ/এফআই