Image description

শেখ হাসিনার সরকার পতন ও গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত আওয়ামী লীগসহ দলটির নেতাদের বিচারের দাবিতে নতুন গঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) একই সময় মাঠের আন্দোলনে সরব হয়ে উঠেছে। বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের মেয়র পদ নিয়ে দল দুটি এখন মুখোমুখি অবস্থানে। বিএনপি আন্দোলন করছে ইশরাককে শপথ পড়ানোর দাবি এবং স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা ও এনসিপির পাল্টা অবস্থানের কারণে। আর এনসিপি বিক্ষোভ করছে বিষয়টি নিয়ে বিএনপি ও নির্বাচন কমিশনের (ইসি) অবস্থানকে ঘিরে। মূলত ইশরাক ইস্যুতে দল দুটি যেন মাঠে শক্তি পরীক্ষায় নেমেছে। একে অপরের প্রতি বিষোদ্গার করার পাশাপাশি অন্তর্বর্তী সরকারের বেশ কয়েকজন উপদেষ্টাকে প্রতিপক্ষের দাবি করে তাদের পদত্যাগ চেয়েছে। 

গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর বিএনপি ও তৎকালীন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শীর্ষ নেতারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দেশ পরিচালনায় সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছিল। সে অনুযায়ী শুরুর দিকে একাধিক প্লাটফর্মে একই সুরে কথাও বলেন বিএনপি ও ছাত্র নেতারা। তবে নির্বাচনের দাবি নিয়ে বিএনপি সরব হওয়ার পর থেকে দূরত্ব বাড়তে থাকে। 

পরবর্তীতে ছাত্রদের নেতৃত্বে রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) গঠন হলে বিএনপির নির্বাচনের দাবির কড়া বিরোধিতা শুরু করেন নেতারা। বিএনপি যখন গুরুত্বপূর্ণ খাতের সংস্কার শেষে দ্রুত নির্বাচনের দাবি তুলছে তখন এনসিপির পক্ষ থেকে রাষ্ট্র সংস্কারের আগে নির্বাচনের বিরোধিতা করছে। ক্রমেই দুই দলের নেতারা নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে কথা বলতে গিয়ে রীতিমতো বাগযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। সবশেষ ইশরাকের শপথ গ্রহণের ইস্যুতে কেন্দ্র করে প্রকট আকার ধারণ করছে।

আইন, অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি এনসিপির: বিএনপিপন্থি আখ্যা দিয়ে আইন, অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী গতকাল বুধবার নির্বাচন কমিশন ঘেরাও কর্মসূচিতে বলেন, ইসি পুনর্গঠন না হলে বর্তমান ইসির অধীনে নির্বাচনে যাবে না এনসিপি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন, অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ‘বিএনপির মুখপাত্র’ বলে অভিযোগ করেন এনসিপির এই নেতা। সংস্কার সুপারিশ বাস্তবায়ন না হলে উপদেষ্টাদের মধ্যে যারা ‘বিএনপির মুখপাত্র’ তাদের পদত্যাগে বাধ্য করা হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেন নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী।

আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল ও অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সমালোচনা করে নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী বলেন, উপদেষ্টারা বিএনপির মুখপাত্র হিসেবে কাজ করছে, তাদের পদত্যাগ করাতে বাধ্য হব। বাংলাদেশের অর্থনীতি গুঁড়িয়ে দিতে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ ও অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ কাজ করছেন। আইন মন্ত্রণালয় গুঁড়িয়ে দিতে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল কাজ করছেন। আওয়ামী লীগকে জনগণ যেভাবে ছুড়ে ফেলেছে, আপনাদেরও ছুড়ে ফেলা হবে।

উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ও মাহফুজ আলমের পদত্যাগ দাবি ইশরাকের: এদিকে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ও উপদেষ্টা মাহফুজ আলমকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সকল দায়িত্ব থেকে পদত্যাগের দাবি জানিয়েছেন বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন। 

বুধবার সকালে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেয়া এক পোস্টে ইশরাক লেখেন, গণতান্ত্রিক ভাষায়, রাজনৈতিক শিষ্টাচার মেনে যৌক্তিক কারণে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ও উপদেষ্টা মাহফুজ আলমকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সব দায়িত্ব থেকে পদত্যাগের আহ্বান জানাচ্ছি। যেহেতু এটা প্রতীয়মান যে আপনারা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছেন, হয়ত আগামীতে সরাসরি যুক্ত হবেন এবং এটাও অনেকটা স্পষ্ট আপনারা নির্বাচন করবেন। তাহলে আপনাদের পদত্যাগের দাবি কি অযৌক্তিক? নাকি এটাই সঠিক পদক্ষেপ হবে এবং আপনাদের নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্কের অবসান ঘটবে। আপনাদেরই নাহিদ ইসলাম যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গিয়েছেন, সেটাই অনুসরণ করুন। উনি চাইলে হয়ত আরও কিছুদিন মন্ত্রিত্ব করে তারপর এনসিপিতে যেতে পারতেন। একটা সময় ছিল সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহরা জোরালোভাবে দাবি করলে ওনারাও হয়ত মন্ত্রিত্ব নিতে পারতেন। কিন্তু তারা রাজনীতি করবেন বলে সেই কর্মপন্থা বেছে নিয়েছেন। হয়ত একদিন জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করলে পূর্ণাঙ্গভাবে মন্ত্রীর দায়িত্ব, ক্ষমতা ও সম্মান আবার পাবেন।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি গণঅধিকার পরিষদের: অন্তর্বর্তী সরকারের ভেতর থেকে ‘আওয়ামী পুনর্বাসন প্রকল্প’ চালু আছে দাবি করে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে গণঅধিকার পরিষদ। ‘ডামি রাষ্ট্রপতি’ আবদুল হামিদের দেশত্যাগ এবং চারজন পুলিশ কর্মকর্তার প্রত্যাহারকে ‘প্রহসন’ আখ্যা দিয়ে সংগঠনটি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করেছে। রবিবার রাজধানীর পুরানা পল্টনে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত জরুরি সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মো. রাশেদ খান। 

লিখিত বক্তব্যে তিনি অভিযোগ করেন, ৮ মে রাতে সরকারের গ্রিন সিগনালের পর ‘হত্যা মামলার আসামি’ আবদুল হামিদ দেশ ছাড়েন। অথচ শুধুমাত্র চারজন পুলিশ কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করে মূল অপরাধীদের আড়াল করা হচ্ছে। ‘উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে’ চাপানোর এই চক্রান্তে আমরা লজ্জিত ও ক্ষুব্ধ। এ ঘটনার দায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এড়াতে পারেন না। তার গাফিলতি ছিল, নাকি সরাসরি সহায়তা-তা তদন্তসাপেক্ষে প্রমাণিত হোক। তার পদত্যাগই সরকারের ন্যূনতম দায় স্বীকারের প্রকাশ।

চলছে শক্তির পরীক্ষা- দাবি বিশ্লেষকদের: এদিকে ইশরাকের ইস্যুকে কেন্দ্র করে যা ঘটছে সেটিকে মূলত বিএনপির সাথে এনসিপির শক্তির পরীক্ষা বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। মেয়র নির্বাচনের পাঁচ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর মীমাংসিত ইস্যু নিয়ে বিএনপির এই মাঠে নামাকে শো-ডাউনের রাজনীতি বলে অভিহিত করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ। কারণ হিসেবে তিনি মনে করছেন নির্বাচন কমিশনের প্রজ্ঞাপন জারির পরই এই দ্বন্দ্বের সূত্রপাত।

তিনি বলেন, নির্বাচনের পর তো পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে। তখন তারা কারচুপির অভিযোগ এনে প্রার্থিতাই প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। অর্থাৎ সেক্ষেত্রে বলা যায় যে নির্বাচনটাই তাদের (বিএনপি) কাছে ভুয়া। অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনের ব্যাপারে কালক্ষেপণ করছে এই মনোভাব থেকেই বিএনপির এই রাজনৈতিক অবস্থান বলে মনে করছেন এই বিশ্লেষক। ইশরাক হোসেনকে মেয়র ঘোষণার ইস্যুকে কেন্দ্র করে দুই দলই নিজেদের শক্তি পরীক্ষার জন্য মাঠে নেমেছে বলে মনে করেন তিনি।