Image description

বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানামন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া লন্ডন ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন। গত ৮ জানুয়ারি থেকে তিনি ওই ক্লিনিকে ভর্তি রয়েছেন। এরপর থেকে লন্ডন ক্লিনিকে তার চিকিৎসা চলছে। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর চিকিৎসায় দুনিয়া বিখ্যাত ডাক্তারদের সমন্বয়ে গঠন করা হয়েছে মেডিকেল বোর্ড। দল মত নির্বিশেষে বাংলাদেশের মানুষের এখন একটাই প্রত্যাশা বেগম খালেদা জিয়া সুস্থ হয়ে আবার বাংলাদেশের জনগণের মাঝে ফিরে আসবেন।

বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধের বিশ্বাসী রাজনীতির আস্থার প্রতীক। দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব এবং সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির চেয়ারপারসন। তার নেতৃত্বে দেশের রাজনীতির বাঁকে বাঁকে হয়েছে ‘রাজনীতির মেরুকরণ’। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে পেয়েছেন ‘আপোষহীন নেত্রীর’ খেতাব। শুধু দলের নেতাকর্মীই নয় দেশজুড়ে রয়েছে তার লাখো-কোটি অনুসারী, অনুরাগী, ভক্ত। এমনকি জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহলেও রয়েছে তাকে নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। তিনি হাসলে লাখ লাখ মানুষ উৎফুল্ল হন; তিনি কাঁদলে লাখো মানুষ কান্নায় ভেঙে পড়েন। যার অসুস্থতায় মোনাজাতে উঠে কোটি কোটি হাত।

তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী এবং দুইবারের বিরোধীদলীয় নেতা বেগম জিয়া মিথ্যা ও বানোয়াট মামলায় দীর্ঘ দুই বছরেরও বেশি সময় ছিলেন কারাবন্দি। প্রায় সাড়ে ৪ বছর ছিলেন গৃহবন্দি (নির্বাহী আদেশে মুক্ত থাকলেও রাজনৈতিক  কর্মকাণ্ড ও বিদেশ যেতে নিষেধাজ্ঞা ছিল)। দীর্ঘ প্রায় সাড়ে ৬ বছর ধরেই তিনি ছিলেন চিকিৎসা বঞ্চিত। কয়েকবার গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেও পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকার বেগম জিয়াকে যথাযথ চিকিৎসার সুযোগ দেয়নি। চিকিৎসকদের পক্ষ থেকে বার বার বিদেশে উন্নত চিকিৎসা কেন্দ্রে পাঠানোর অনুরোধ এবং পরিবার আবেদন জানালেও তাতে সাড়া দেয়নি হাসিনা সরকার। বরং বেগম খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নিয়ে তুচ্ছ্য-তাচ্ছিল্য করে ভারতে পালিয়ে যাওয়া স্বৈরাচার হাসিনা বলেছিলেন, ‘খালেদা জিয়ার বয়স এখন আশির ওপরে। রোজই শুনি এই মরে মরে, এই যায় যায়। বয়স তো আশির ওপরে। এমনিই তো সময় হয়ে গেছে। তার মধ্যে অসুস্থ। এখানে এত কান্নাকাটি করে তো লাভ নাই।

এমন রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে চিকিৎসা বঞ্চিত থাকলেও বেগম খালেদা জিয়া দমে যাননি। মনের জোর হারাননি। গৃহবন্দি থেকেও মানুষের ভোটের অধিকার, গণতন্ত্র ও মানুষের মুক্তির জন্য অসুস্থ অবস্থায় লড়াই করেছেন। কোন অন্যায় শর্তের কাছে মাথা নত করেননি। জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে সর্মথন দিয়েছেন নিজের অবস্থান থেকে। অবশেষে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর তার কাক্সিক্ষত মুক্তি মিলেছে। গত ৭ জানুয়ারি নানা জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে কাতারের আমিরের পাঠানো বিশেষ এয়ার অ্যামুলেন্সে চড়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাড়ি দিয়েছেন লন্ডন।

এদিকে লন্ডন ক্লিনিকে এক ছাতার নিচে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসা চলছে। তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন জানান, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে যাতে বিভিন্ন স্থানে নেয়ার প্রয়োজন না পড়ে, সেজন্য এক ছাতার নিচে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তিনি বলেন, গত ৮ জানুয়ারি থেকে ম্যাডাম লন্ডন ক্লিনিকে ভর্তি আছেন। উনার সর্বশেষ যে রিপোর্টগুলো তার প্রফেসর জন প্যাট্রিক কেনেডির নেতৃত্বাধীন মেডিকেল বোর্ড পর্যালোচনা করেছেন এবং পরবর্তীতে আরো কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সিদ্ধান্ত হয়েছে। আগামী দুই-একদিনের মধ্যে লন্ডনের আরও দুজন চিকিৎসক উনাকে দেখবেন। গতকাল বুধবার গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি এ কথা বলেন।

জাহিদ হোসেন বলেন, উনার চিকিৎসার ব্যাপারে আমাদের যে পদ্ধতি অর্থাৎ উনাকে তো এখন ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা চলছে লিভারের জন্য, কিডনির জন্য, হার্টের জন্য, ডায়াবেটিস, প্রেসার, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসÑ প্রত্যেকটির জন্য। এর বাইরেও আরও যদি কোনো চিকিৎসা করা যায়, সেজন্য যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিন্স হসপিটালের মেডিকেল টিমের সদস্যরা এখানে মেডিকেল বোর্ডের সভায় অংশগ্রহণ করেছিলেনÑ যাতে আমরা এটাকে এক ছাদের নিচে চিকিৎসা যেটা বলে, ওয়ান আমব্রেলার নিচে অর্থাৎ ওয়ান স্টপ সার্ভিসের মতো সেটা করার ব্যাপারে উনারা উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। জাহিদ বলেন, তারপরে উনার সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে উনার বয়স, উনার রোগের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যে যে ধরনের ক্ষতি গত সাড়ে ৫ বছর যাবত বাংলাদেশে বন্দি থাকা অবস্থায়-সুচিকিৎসা কম পাবার জন্য যা হয়েছে, বাইরে নিতে না পারার জন্য যা হয়েছে সেগুলো বিবেচনায় রেখে- উনার বয়সের কথা বিবেচনায় রেখে উনার জন্য যেটা সবচেয়ে মঙ্গলজনক হবে, সেই ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি অনুসরণ করবে বলে আমরা আশা করি এবং উনারা (লন্ডন ক্লিনিক) সেই ধরনের চিন্তা করছেন। সেটা হয়তো আগামী দুই-তিন দিন পরে যখন আবার মেডিকেল বোর্ডের এক্সটেন্ডেড মেম্বার আছেন, উনারাও এদেশের (যুক্তরাজ্যের) এবং দেশের বাইরের তারা এই ব্যাপারে মতামত দেবেন; পরবর্তীতে সেই অনুযায়ী ইনশাআল্লাহ উনার চিকিৎসা চলবে।

‘দেশবাসীর কাছে দোয়া প্রার্থনা’: অধ্যাপক জাহিদ বলেন, শুধু লন্ডনসহ প্রবাসীরা নয়, বাংলাদেশের মানুষ উদগ্রীব হয়ে আছেন ম্যাডামের সুস্থতার জন্য। উনার সুচিকিৎসার জন্য আমরা দেশবাসীর কাছে দোয়া চাইÑ উনার সুস্থতার জন্য। আপনাদের মাধ্যমে ম্যাডামের জন্য পরিবারের পক্ষ থেকে দোয়া কামনা করছি, আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সাহেবও দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছেন। বিএনপি নেতা জাহিদ বলেন, বেগম খালেদা জিয়ার পরিবারের সদস্যরা সার্বক্ষণিকভাবে, নিকট আত্মীয়রা বিশেষ করে উনার দুই পুত্রবধূ জোবাইদা রহমান, সৈয়দা শামিলা রহমান সিঁথি, তিন নাতনি জাইমা রহমান (তারেক রহমানের মেয়ে), জাফিয়া রহমান ও জাহিয়া রহমান (আরাফাত রহমান কোকোর মেয়ে) সবসময়ই এবং দেশের (লন্ডন) বাইরে যারা আছেন, তারা ওভার টেলিফোন সার্বক্ষণিকভাবে ম্যাডামের খোঁজ-খবর নিতে যোগাযোগ রাখছেন। খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় লন্ডন বিএনপির সভাপতি এম এ মালেক, সাধারণ সম্পাদক কয়সর এম আহমেদসহ কয়েকজন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করছেন বলে জানান জাহিদ। ৭৯ বছর বয়সী সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে লিভার সিরোসিস, কিডনি, হার্ট, ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিসসহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন।

দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পাঁচ মাস বাদে চিকিৎসার জন্য গত ৭ জানুয়ারি যুক্তরাজ্যে নেয়া হয় বিএনপি চেয়ারপারসনকে। প্রাথমিক পরিকল্পনায় তার লন্ডন হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার কথা বলা হলেও এখন যুক্তরাজ্যের হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়াই চ‚ড়ান্ত হয়েছে। সবশেষ সাড়ে সাত বছর আগে যুক্তরাজ্যেই চিকিৎসা নিতে গিয়েছিলেন ৭৯ বছর বয়সী খালেদা জিয়া। সেবার চোখ ও পায়ের চিকিৎসা নিয়েছিলেন। লিভার সিরোসিস, হƒদরোগ, ফুসফুস, আর্থ্রাইটিস, কিডনি, ডায়াবেটিসসহ নানা জটিলতায় তিনি ভুগছেন। মাঝে কারাবন্দি জীবনের পর শর্তসাপেক্ষে মুক্তি মিললেও বিদেশে তার চিকিৎসার অনুমতি দেয়নি তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। এই অনুমতির জন্য তার দল আন্দোলন-সংগ্রাম করেও সুবিধা করতে পারেনি। সেই কারণে ২০১৭ সালের ১৫ জুলাই বিএনপি চেয়ারপারসনের লন্ডনযাত্রার পর আর কোনো বিদেশ সফর হয়নি।

মানবকণ্ঠ/আরআই