Image description

‘আনআইডেন্টিফাইড ফ্লাইং অবজেক্ট’ অর্থাৎ অজ্ঞাত উড়ন্ত বস্তু-সংক্ষেপে ইউএফও। অনেকে বলেন ফ্লাইং সসার। দেখতে বিচিত্র আকারের নভোযানের মতো। অতি দ্রুতগতিতে উড়ে আসে। হঠাৎ আবার অদৃশ্য হয়ে যায়। এসব নিয়ে অনেক সাহিত্য, চলচ্চিত্র, টিভি ধারাবাহিক তৈরি হয়েছে। ধারণা করা হয়, এগুলো মহাকাশ থেকে আসা কোনো অজ্ঞাত বুদ্ধিমান প্রাণীর মহাকাশযান। বহুকাল আগে থেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময় এমন অবাক বস্তু দেখার খবর পাওয়া যায়।

বৈমানিক থেকে শুরু করে বহু সাধারণ মানুষ পর্যন্ত রহস্যময় এই উড়ন্ত যান নিজ চোখে দেখার কথা স্বীকার করেছেন। কিন্তু অনেকেই তাদের বর্ণনা বিশ্বাস করেন না। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক সাক্ষাৎকারে বলেন, এলিয়েন বা কথিত ভিনগ্রহের প্রাণীদের ব্যাপারে তিনি যা জানেন তা তিনি তার পরিবারের কাছেও প্রকাশ করবেন না। মি. বারাক ওবামা বলেন, যেটা সত্যি তা হলো, আমি সিরিয়াসভাবেই বলছি যে আকাশে উড়ন্ত কিছু বস্তুর ভিডিও ফুটেজ রয়েছে। কিন্তু সেগুলো কী? তা আমরা জানি না। আমরা ব্যাখ্যা করতে পারছি না যে কীভাবে এগুলো ওড়ে? তাই এগুলো কী তা বের করার জন্য গুরুত্ব দিয়ে চেষ্টা করা উচিত। প্রশ্ন উঠেছে সত্যি কি ইউএফও রয়েছে? 

দৃশ্যপট- এক। গত বৃহস্পতিবার সকালে তুরস্কের আকাশে দেখা মেলে অদ্ভুত মেঘের। লাল-কমলা রঙের ওই মেঘ দেখে বোঝা মুশকিল আদৌ মেঘ নাকি অন্য কিছু, যা তৈরি করে দৃষ্টিবিভ্রম। অনেকের কাছে এটা ইউএফও তথা ভিনগ্রহের প্রাণীদের মহাকাশ যানের মতো দেখতে লাগে। তবে দেশটির আবহাওয়া দফতর জানায়, পাহাড়ের ওপর প্রবল বাতাসের কারণে তৈরি হয় এমন মেঘ। তুরস্কের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর বুরসা থেকে এটা দৃষ্টিগোচর হয়। অনেক মানুষ মেঘের বিস্ময়কর এ গঠন দেখতে জড়ো হয়েছিলেন। অনেকে ছবি, সেলফি তুলেছেন। ভিডিও করেছেন। আর সেগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করেছেন। অদ্ভুত রঙিন এই মেঘের ভিডিও এবং ছবি বিশ্বজুড়ে ভাইরাল হয়েছে। শত শত সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীরা একযোগে বলেন-মেঘটি দেখতে ইউএফওর মতো। তবে তুরস্কের স্টেট মেটিওরোলজিক্যাল সার্ভিস বলছে, বিরল ঘটনাটি কেবল একটি ‘লেন্টিকুলার ক্লাউড’। এ ধরনের মেঘ তাদের বাঁকা ও ফানেল আকৃতির চেহারার জন্য পরিচিত।

দৃশ্যপট- দুই। আমেরিকার টেনিসি এলাকা। হাইওয়ে দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন বেসরকারি কোম্পানির মালিক জন উইনফিল্ড। সঙ্গে তার বন্ধু ডেভিড রথম্যান। রাত প্রায় ৯টা বাজে। রাস্তা একেবারে ফাঁকা। যতদূর চোখ যায় কোনো গাড়ি বা লোকজন নজরে পড়ে না। আকাশ পরিষ্কার। দুই বন্ধুতে গল্প করতে করতে প্যারিস (ফ্রান্সের প্যারিস নয়) শহর থেকে যাচ্ছেন ম্যাক কেনজি শহরের দিকে। হঠাৎ একটা জোরালো আলো এসে পড়ল গাড়ির উইন্ডশিল্ডে। চমকে উঠলেন দুই বন্ধু। এমন ফাঁকা জায়গায় আলো এলো কোত্থেকে! আলো লক্ষ করে একই সঙ্গে ওপরের দিকে দুজন তাকালেন। নাহ, কোনো কিছু দেখা যায় না। রাস্তার ধারে গাড়ি থামিয়ে নেমে এলেন।

এবার অবাক হওয়ার পালা। গাড়ির সোজা ওপরের দিকে চাকতির মতো একটা যান ভেসে রয়েছে আকাশে। তারই জানালা থেকে বেরিয়ে আসছে এই জোরালো আলো। ভিন গ্রহ থেকে আসা যান বা সসারের ছবি দেখতে যেমন, এও ঠিক তেমনি। গাড়ি থেকে খাড়া দেড়-দুইশ ফুট উঁচুতে এক জায়গায় স্থির হয়ে রয়েছে। চাপা গুনগুন আওয়াজ বেরোচ্ছে তা থেকে। ঘটনা সম্পর্কে জন উইনফিল্ড বলেন, মিনিট দেড়েক পর জোরালো আলোটা নিভে গিয়ে যানটার চারপাশে হালকা নীল আলো জ্বলে উঠল। তারপরই খানিকটা দক্ষিণ দিকে এগিয়ে গিয়ে বিদ্যুৎ গতিতে চলে গেল পূর্ব দিকে। আমরা দুজন ফিরে এলাম গাড়িতে। তবে মিনিট দশেক আমাদের কারও মুখ থেকে কোনো কথা ফোটেনি। সেদিন ওই এলাকার অন্তত ছয় জায়গায় এই বস্তু দেখা যায় বলে আমরা পরদিন খবর পাই।

গবেষকরা বলেন, এমন ঘটনার নানা ঐতিহাসিক উৎস রয়েছে। যেহেতু অনেকেই দাবি করেন ভিনগ্রহের প্রাণীরা পৃথিবীতে প্রায় নিয়মিত যাওয়া-আসা করে। তাদের দেখাও পাওয়া গেছে। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৪ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক কর্মকর্তারা ১৪০ বারের বেশি আকাশে ‘অস্বাভাবিক বস্তুর’ দেখা পাওয়ার দাবি করেছেন এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কাছে এ ব্যাপারে জানিয়েছেন। তাদের দেখা বস্তুর মধ্যে রয়েছে বেলুনাকৃতির বিশাল একটি স্তম্ভ। তাই এটা অসম্ভব নয় যে, পৃথিবীর আদি বাসিন্দারাও ভিনগ্রহের প্রাণী দেখেছেন। তাই ভিনগ্রহের প্রাণীর অস্তিত্বের প্রমাণ জোগাড়ে গবেষকরা এখন ঐতিহাসিক উৎসে ভিনগ্রহের প্রাণীর সন্ধান করছেন। 

ইউএফও বা ফ্লাইং সসারের অস্তিত্ব সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত কোনো তথ্য-প্রমাণ পাওয়া না গেলেও অনেক বিজ্ঞানী বিশ্বাস করেন, মহাকাশ থেকে অজ্ঞাত বুদ্ধিমান প্রাণীরা মাঝেমধ্যেই তাদের নিজস্ব মহাকাশযান বা ইউএফও চড়ে পৃথিবীতে আসে। বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বে বুদ্ধিমান প্রাণীর অস্তিত্বের সম্ভাবনাকে একেবারে উড়িয়ে দেন না। অধিকাংশ বিজ্ঞানী মনে করেন, পৃথিবীর বাইরে মহাকাশে বুদ্ধিমান প্রাণীর অস্তিত্ব মোটেও অসম্ভব কোনো ব্যাপার নয়। পৃথিবীর বাইরে অন্য কোনো গ্রহে প্রাণের (এলিয়েনের) অস্তিত্ব রয়েছে কি না? কিংবা থাকলেও সেগুলো পৃথিবীতে আসে কি না? এ নিয়ে সম্প্রতি গবেষণা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় পেন্টাগন। মূলত মার্কিন সামরিক কর্মকর্তারা একাধিকবার ভিনগ্রহের প্রাণীদের যান- ইউএফও দেখা পাওয়ার দাবি করার পরই তদন্তে নামেন পেন্টাগনের গবেষক দল। 

গবেষকরা বলেন, ইউএফও দেখতে পাওয়ার এসব খবর শতকরা ৯০ ভাগের কোনো ভিত্তি নেই। লোকজন আকাশে কোনো উজ্জ্বল তারা, বিমান, পাখি, বেলুন, ঘুড়ি, আতশবাজি, অদ্ভুত আকৃতির মেঘখণ্ড, উল্কা বা কৃত্রিম উপগ্রহ দেখে ইউএফও দেখেছে বলে রিপোর্ট করে। বাকি খবরেরও অধিকাংশ ধোঁকাবাজি। তবে তাদের সেসব দাবি যে একেবারে মিথ্যা, তা প্রমাণ করাও কঠিন কাজ। লোকজন সত্যি সত্যিই এমন কিছু দেখেছে কি না এবং তা আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তার ওপর হুমকি সৃষ্টি করতে পারে কি না তা খতিয়ে দেখার জন্য মার্কিন বিমান তদন্ত চালায়।

বিমান বাহিনীর গবেষকরা সাধারণ লোকজনের কাছ থেকে পাওয়া ইউএফও-সংক্রান্ত মোট ১২ হাজার ৬১৮টি রিপোর্টের একটি তালিকা করে এবং এর মধ্যে ৭০১টি ঘটনাকে রহস্যজনক বা ব্যাখ্যার অনুপযোগী হিসেবে চিহ্নিত করে। এসব রিপোর্ট সম্পর্কে তদন্ত চালানোর পর মার্কিন বিমান বাহিনী জানায়, প্রাপ্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে তদন্ত চালিয়ে ইউএফওর অস্তিত্বের কোনো প্রমাণ মেলেনি এবং আমেরিকার নিরাপত্তার ওপর হুমকি সৃষ্টি করতে পারে এমন কিছুও দেখা যায়নি। ওদিকে ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা দফতরও ইউএফও নিয়ে গবেষকদের চারশ পৃষ্ঠার এক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, প্রতিরক্ষা বিভাগ ৩০ বছর ধরে সংগ্রহ করা বিভিন্ন রিপোর্টের ভিত্তিতে ব্যাপক তদন্ত চালিয়েও ইউএফও বা ফ্লাইং সসারের কোনো আলামত পায়নি। সাধারণ মানুষ যাকে ইউএফও বলে মনে করছে তা কোনো উল্কা, মেঘ বা এ রকম কিছু হতে পারে। তবে ভিন্ন গ্রহ থেকে আসা কোনো যান কোনোমতেই নয়।

এদিকে মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতরের গবেষণায় বলা হচ্ছে যে একজন-দুজন নয়, ১০-২০ জনও নয়, শত শত লোক আকাশে এসব ইউএফও দেখেছে। কখনো কখনো সবাই একসঙ্গে দেখতে পেয়েছেন। বিশেষজ্ঞের ধারণা, এগুলো গোপন কোনো সামরিক বিমানের পরীক্ষামূলক উড্ডয়ন। বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলেন এগুলো ভিনগ্রহ থেকে আসা বুদ্ধিমান প্রাণীদের নভোযান।

পেন্টাগনের জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা রোনাল্ড মোলট্রি বলেন, আকাশে, মহাকাশে ও পানিতে অস্বাভাবিক বস্তু এলিয়েনের যান খুঁজতে গিয়ে তাদের কাছে অনেক প্রতিবেদন এসেছে। সেগুলো পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। পেন্টাগনের নবগঠিত অল ডোমেইন এনোমালি রেজ্যুলেশন অফিসের পরিচালক সিন কির্কপ্যাট্রিকের মতে, পৃথিবীর বাইরে অন্য কোনো প্রাণের অস্তিত্ব থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেন না তারা। 

তবে তারা এ ব্যাপারে বৈজ্ঞানিকভাবে এগিয়ে যেতে চান। পেন্টাগনের বিজ্ঞানীরা বলেন, আমরা জানি যে রাশিয়াও এ নিয়ে কাজ করছে এবং নেতৃত্ব দিচ্ছে কেজিবির ভেতরে থাকা একদল গবেষক। আমাদের পৃথিবীবাসীর নিজেদের ভালোর জন্যই এ ব্যাপারে অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। মার্কিন সামরিক বিশেষজ্ঞরা ইতিমধ্যে সতর্ক করেছেন, এসব ইউএফওর প্রযুক্তি যদি অন্য কোনো গ্রহের প্রাণীদের না-ও হয়, তবে এসব নিশ্চয়ই যুক্তরাষ্ট্রের বৈরী দেশ- রাশিয়া বা চীনের হতে পারে।

লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, এমফিল স্কলার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।