Image description

বৃক্ষ মানুষের পরম বন্ধু। বৃক্ষ ছায়া দেয়, ফুল-ফল দেয়, ঘরবাড়ি ও আসবাবপত্র তৈরির উপকরণ দেয়। শুধু তাই নয়; মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য যে অক্সিজেন সে অক্সিজেনের যোগান দেয় বৃক্ষ। ফলে বৃক্ষের সঙ্গে মানবজীবনের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। এই নিবিড় ও নিরাপদ সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও কিছু বৃক্ষ মানুষ, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। দীর্ঘদিন যাবত গবেষকগণ বলে আসছিলেন যে, বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে রোপণ করা ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণি গাছ পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। 

গবেষকগণের এ কথায় মানুষ খুব বেশি কান দেয়নি। অল্প সময়ে অধিক লাভের আশায় দ্রুত বর্ধনশীল এসব গাছের বাগান করেছে। বাড়ির আনাচে-কানাচে, পুকুরের ধারে, এমনকি ফসলের ক্ষেতের আইল বরাবর লাগানো হয়েছে এসব আগ্রাসী গাছ। শুধু ব্যক্তি উদ্যোগে নয়; সরকারিভাবে বনায়ন করার ক্ষেত্রেও ক্ষতিকর এই গাছগুলোকেই নির্বাচন করা হয়েছে এতোদিন। উদ্দেশ্য একটাই। সেটা হলো অল্প সময়ে অর্থনৈতিকভাবে অধিক লাভবান হওয়া। তবে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে গিয়ে পরিবেশের যে ক্ষতি ডেকে আনা হয়েছে সেদিকে নজর দেয়া হয়নি। 

এ বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে যে সীমিত প্রচারণা দেখা গেছে তাতে কোনো কার্যকর ফল পাওয়া যায়নি। এই বাস্তবতায় সম্প্রতি সরকার ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণি গাছের চারা রোপণ, উত্তোলন ও বিক্রয় নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। গত ১৫ মে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের বন-১ অধিশাখা থেকে এ বিষয়ে এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের স্বার্থে এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার পূরণ করতেই এ দুটি প্রজাতির গাছের চারা তৈরি, রোপণ ও বিক্রয় নিষিদ্ধ করা হয়েছে। 

পরিবেশের ভারসাম্য ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার বিষয়টি বিবেচনায় আনলে সরকারের এই সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক হিসেবে দেখতে হবে। এ সিদ্ধান্তের সফল বাস্তবায়নের জন্য সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তিগত পর্যায়ের বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিতে এ দুটি গাছের চারা রোপণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। সরকারের এই পদক্ষেপকে এখন ব্যাপক প্রচারণার আওতায় নিয়ে আসা জরুরি। সর্বস্তরে জনসচেতনতা তৈরির জন্য ক্যাম্পিং ও কাউন্সিলিং কর্মসূচি পালিত হতে পারে দেশজুড়ে।

ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণি গাছের ক্ষতিকর দিক প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বন-১ অধিশাখার উপসচিব তুষার কুমার পাল বলেন, নানা গবেষণায় দেখা গেছে এসব গাছের পানি শোষণক্ষমতা অনেক বেশি এবং এসব গাছ মাটিকে রুক্ষ করে তোলে। রুক্ষ বা উর্বরা শক্তিহীন মাটিতে ফলমূল ও শাকসবজির চাষ ঠিকমতো হয় না। আমরা দেখি গ্রাম এলাকায় যেসব বাড়িতে বেশিমাত্রায় ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণি গাছ আছে সেসব বাড়িতে দেশীয় ফল গাছগুলো ভালো ফল দেয় না। শাকসবজিও ভালো আবাদ হয় না। এক সময়ে বাড়িতে উৎপাদিত ফলমূল ও শাকসবজি দিয়েই পরিবারের চাহিদা মিটে যেতো। প্রান্তিক কৃষকরা নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে অতিরিক্ত ফলমূল ও শাকসবজি বিক্রি করতে পারতেন। এটা গ্রামীণ নারীদের আয়ের একটি প্রধান উৎস ছিল। এখন বাড়ির ভিটায় কোনো শাকসবজি ঠিকমতো হয় না বলে শোনা যায়। 

ফলে গ্রামের প্রান্তিক কৃষক পরিবারকেও এখন ফলমূল ও শাকসবজি কিনে খেতে হয়। শুধু তাই নয়, বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত ও আমদানিকৃত ফলমূলে প্রচুর পরিমাণে প্রিজারভেটিভ ব্যবহার করা হয়। এসব প্রিজারভেটিভের বিষক্রিয়া জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ একটি অপরটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। পরিবেশের বিপর্যয় দেখা দিলে জনস্বাস্থ্যও হুমকির মুখে পড়ে যায়। তাই পরিবেশ রক্ষায় সরকারের এ সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাতে হয়। প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি দেশের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করাও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা করা গেলে জীববৈচিত্র্যও রক্ষা করা সম্ভব। কারণ প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে জীববৈচিত্র্যের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর ও নিবিড়। 

বিভিন্ন গবেষণা ও বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে জানা গেছে যে, ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণি জাতীয় গাছে কোনো পাখি বাসা বাঁধতে পারে না। বাসা বাঁধলেও বসবাস করতে পারে না। এর একটি কারণ হলো এসব গাছে পাখিদের খাওয়ার উপযোগী কোনো ফল ধরে না। শাখা-প্রশাখা, কাণ্ড-পাতা কোনোটাই পাখি বসবাসের উপযুক্ত নয়। দ্বিতীয় কারণটি হলো এসব গাছের বিষক্রিয়ায় পাখিদের ক্ষতি হয় এবং তাদের প্রজনন ক্ষমতা নষ্ট হয়। জীববৈচিত্র্য রক্ষার ক্ষেত্রে এই কারণটির ওপর বিশেষ জোর দেয়া প্রয়োজন। 

আরও জানা গেছে পুকুরপাড়ে রোপিত ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণি গাছ থেকে পাতা ঝরে পুকুরে পড়লে পুকুরের পানি বিষাক্ত হয়ে ওঠে এবং সে পানিতে মাছ বেঁচে থাকতে পারে না। তাহলে কেনো আমরা দ্রুত বর্ধনশীল, অতিমাত্রায় পানি শোষণকারী, মাটির উর্বরাশক্তি বিনষ্টকারী সর্বোপরি পরিবেশ ও প্রতিবেশের জন্য হুমকির কারণ হয়-এমন ক্ষতিকর বৃক্ষ রোপণ করবো? শুধু কি আর্থিক লাভের কথা ভেবে? সেটা ভাবলেও আমাদের এসব গাছ রোপণ করা থেকে বিরত থাকা উচিত। কারণ দেশি প্রজাতির ফলদ, বনজ ও ঔষধি গাছ রোপণ করা এখন আর্থিকভাবে অনেক লাভজনক হয়ে উঠেছে। 

বাজারে এখন দেশি ফলের দাম ও চাহিদা দুটোই বৃদ্ধি পেয়েছে। স্বাস্থ্য সুরক্ষায় মানুষ ক্রমশ সচেতন হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে দেশি ফলমূলের চাহিদা আরও বৃদ্ধি পেতে থাকবে বলে মনে করা যায়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামাল হোসেন, যিনি দীর্ঘদিন ধরে ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণি গাছ নিয়ে গবেষণা করেছেন। তার গবেষণা থেকে আমরা এ দুটি গাছের ক্ষতিকর দিক বিষয়ে জানতে পারি। 

এ বিষয়ে তিনি ‘ইউক্যালিপটাস ডিলেমা ইন বাংলাদেশ’ নামে একটি বই লিখেছেন। এই গবেষক গণমাধ্যমে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, দেশি প্রজাতির বৃক্ষকে প্রাধান্য দিয়ে বনায়নের সরকারি নির্দেশনা একটি ভালো উদ্যোগ। এ উদ্যোগ সফল হলে বাংলাদেশের পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য আবার ফিরে আসবে বলে আশা করা যায়। মিডিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে গবেষক কামাল হোসেন বলেন, ১৯২১ সালে সর্বপ্রথম সিলেটের চা বাগানের সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য অস্ট্রেলিয়া থেকে ইউক্যালিপটাস নিয়ে আসা হয়। 

১৯৬০ সালের দিকে আরও কিছু আনা হয়। ১৯৭৭-৭৮ সালের দিকে ব্যাপক আকারে নিয়ে আসা হয়। এ সময়ই দেশে আকাশমণি গাছও আসে। বাংলাদেশ ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট পরীক্ষামূলকভাবে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, হাটহাজারী, টাঙ্গাইলের মধুপুর ও দিনাজপুরের বিভিন্ন জায়গায় এটির উপযোগিতা পরীক্ষা করে। এ পরীক্ষা কার্যক্রমের ফলাফল দৃশ্যমান হওয়ার আগেই ব্যাপকভাবে সারা বাংলাদেশে এর বিস্তার ঘটে যায়। দ্রুতবর্ধনশীল ও কোনো প্রকার যত্ন করতে হয় না বলে এর আবাদ জনপ্রিয়তা পেয়ে যায়। কালক্রমে আগ্রাসী প্রজাতির এই বৃক্ষ দেশি প্রজাতির বৃক্ষের জন্য হুমকি হয়ে ওঠে।

ইউক্যালিপটাস গাছের গ্রোথ অনেক বেশি। এই বৃক্ষ মাটি থেকে অনেক বেশি পানি শোষণ করে। এতে মাটির আর্দ্রতা কমে যায়। এতে শুষ্ক অঞ্চলে মরুকরণ সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। এই গাছের পাতায় থাকা টক্সিন মাটিতে পড়ে মাটিকে বিষাক্ত করে তোলে। ফলে এই বৃক্ষ যেখানে লাগানো হয় তার আশপাশে অন্যান্য প্রজাতির গাছ জন্ম নেয়ার সুযোগ পায় না। জন্ম নিলেও সেগুলো পরিপুষ্টভাবে বেড়ে উঠতে পারে না। পাখি এমনকি পোকা-মাকড়ও এসব গাছে আশ্রয় নিতে পারে না। তাই সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার পূরণকল্পে সরকারি-বেসরকারি সংস্থা ও ব্যক্তি পর্যায়ের বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিতে নিষিদ্ধ এই দুটি গাছ লাগানো থেকে বিরত থাকতে হবে। 

শুধু এই দুটি গাছ নয়, দেশীয় প্রজাতির ফলদ, বনজ ও ঔষধি গাছকে নিরাপদে বেড়ে ওঠার জন্য যেকোনো আগ্রাসী প্রজাতির গাছের চারা উৎপাদন ও রোপণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। তবে ক্ষয়প্রবণ ও অনুর্বর মাটিতে এ দুটি প্রজাতির বৃক্ষ টিকে থাকতে পারে বলে দেশের যেসব এলাকার মাটি ক্ষয়প্রবণ ও অনুর্বর সেসব এলাকায় এ দুটি গাছ লাগানো যায় কিনা- সেটি ভেবে দেখা যেতে পারে। এসব গাছের শেকড় মাটির অনেক গভীরে প্রবেশ করে বলে দুর্যোগপ্রবণ ও উপক‚লীয় এলাকায় বেষ্টনী হিসেবে এগুলো রোপণ করা যেতে পারে।

ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণি নিষিদ্ধের এই সিদ্ধান্তকে সরকারের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের একটি সময়োপযোগী ও বাস্তবমুখী সিদ্ধান্ত বলা যায়। বিশ্বজুড়ে পরিবেশ রক্ষার যে আন্দোলন চলছে বর্তমান সরকারের এ সিদ্ধান্তকে সে আন্দোলনের অংশ হিসেবেও বিবেচনা করা যায়। আমার পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় আমাকেই এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো এখন এ বিষয়ে মনিটরিং কার্যক্রম আরো জোরদার করতে পারে।

লেখক: কলামিস্ট