Image description

ঐতিহাসিক ভূগোলের বর্ণচ্ছটায় রঞ্জিত ভারত ও পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক চিরদ্বিধাগ্রস্ত একটি প্রণয়-প্রতিযোগিতা। এখানে প্রতিনিয়তই শান্তির প্রত্যাশা ও সংঘর্ষের প্রতিপাদ্য পরস্পরকে ছাপিয়ে যায়। সত্তর বছরের অধিককাল পেরিয়ে গেছে। এখনও এই দুই পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশী সময়ের পঞ্জিকায় বেদনাবাহী স্মৃতিচারণার ভারবাহী কাব্যগ্রন্থ হয়ে রয়ে গেছে। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে অনুশোচনাভরা এই দ্বন্দ্ব যেন মেঘমালার অন্তরালে বৃষ্টি না নামা কোনো অপেক্ষার নাম। প্রতিটি সামরিক সংঘর্ষ, প্রতিটি ক‚টনৈতিক বিপর্যয়, প্রতিটি ব্যর্থ সংলাপ এই সম্পর্ককে আরও দুর্বিনীত আরও দুর্বোধ্য আরও নৃশংস এক অনাস্থার গহ্বরে নিক্ষেপ করেছে। 

‘কম্পোজিট ডায়ালগ’ নামক কূটনৈতিক প্রয়াস আজ কেবল ইতিহাসের পাণ্ডুলিপিতে লেখা এক অধ্যায়মাত্র। বিভাজনের জন্মলগ্ন থেকেই ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্কে জড়িয়ে আছে কাশ্মীরের অমীমাংসিত প্রশ্ন। ইতিহাসের রক্তাক্ত পাতায় লিপিবদ্ধ হয়েছে যুদ্ধ, সংঘাত আর হানাহানির অধ্যায়। ১৯৪৭-এর ভূ-রাজনৈতিক বিভাজন দুই জাতিকে দিয়েছে আলাদা পতাকা। কিন্তু কেড়ে নেয়নি একই সাংস্কৃতিক ডিএনএ। কাশ্মীরের মাটিতে আজও রক্তপাত চলছে। শান্তির আলোচনা সেখানে মৃতপ্রায়। বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে আশার আলো জ্বলেছিল কম্পোজিট সংলাপের মাধ্যমে। আটটি ইস্যুকে সামনে রেখে গড়ে উঠেছিল সমাধানের কাঠামো। গড়ে উঠেছিলো কাশ্মীর থেকে সন্ত্রাসবাদ, পানি বণ্টন থেকে অর্থনৈতিক সহযোগিতা।
 
২০০৪-২০০৭ সাল ছিল স্বর্ণযুগ। মনমোহন সিং ও পারভেজ মোশাররফের নেতৃত্বে ব্যাকচ্যানেলে আলোচনা এগিয়েছিল চ‚ড়ান্ত মুহূর্ত পর্যন্ত। কাশ্মীর ইস্যুতে প্রস্তাবিত চার-সূত্রি ফর্মুলা ছিল যুগান্তকারী পদক্ষেপ। কিন্তু ২০০৮-এর মুম্বাই হামলায় ভেঙে পড়ে সব পরিকল্পনা। রাজনীতির অস্থিরতায় ম্লান হয় সম্ভাবনা। ২০১৪ সালে ভারতের রাজনীতিতে পরিবর্তন আসে। কঠোর নীতির রাজনীতি সংলাপের জায়গা দখল করে। কম্পোজিট সংলাপের আটটি ইস্যু ঢাকা পড়ে ধুলোয়। ২০১৯ সালে জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বিলোপ সম্পর্ককে ঠেলে দেয় নতুন অন্ধকারে। প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তান ক‚টনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যও স্থগিত করে। ভারতের দাবি কাশ্মীর এখন ‘অভ্যন্তরীণ ইস্যু’। ফলে আলোচনার দরজা রুদ্ধ। ২০২০-২১ সালে ব্যাকচ্যানেল যোগাযোগ পুনরুজ্জীবিত হয়। যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও তা কাগুজে সান্ত্বনায় পর্যবসিত। সীমান্তে গোলাবর্ষণ কমলেও হৃদয়ের দূরত্ব বাড়তেই থাকে। ২০২৩ সালে পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার পর ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সংঘর্ষ নতুন মাত্রা পায়। পারমাণবিক শক্তিধর দুই দেশ প্রথমবারের মতো একে অপরের মূল ভূখণ্ডে মিসাইল নিক্ষেপ করে। মার্কিন হস্তক্ষেপে যুদ্ধবিরতি তো হয় কিন্তু শান্তির পথ রয়ে যায় ধোঁয়াশায়। 

ভবিষ্যতের মানচিত্রে তিনটি সম্ভাব্য রেখা টানা যায়। প্রথমটি, অবিরাম উত্তেজনা ও সংঘাতের দুষ্টচক্র। বাকযুদ্ধ, সীমান্তে সংঘর্ষ, ক‚টনৈতিক অচলাবস্থা। নতুন সন্ত্রাসী হামলা এ চিত্রকে কে যুদ্ধে রূপ দিতে পারে। দ্বিতীয়টি নিষ্ক্রিয় সহাবস্থান। কূটনৈতিক সম্পর্ক নিন্ম মাত্রায় সামরিক উত্তেজনা নিয়ন্ত্রিত। তৃতীয়টি অসম্ভবের স্বপ্ন যা মুলত পুনরায় সংলাপের টেবিলে ফেরা। ইতিহাস বলছে দ্বিতীয় দৃশ্যপটই সবচেয়ে বেশি বাস্তবসম্মত। ২০২১-এর যুদ্ধবিরতিই এর প্রমাণ। এতে বড়জোর অস্থায়ী শান্তি মেলে, স্থায়ী সমাধান নয়। কাশ্মীর, সন্ত্রাসবাদ, পানি বণ্টনের মতো কঠিন ইস্যু থেকে চোখ ঘুরিয়ে নিলে সমস্যা জমতে থাকে। যেমন সিন্ধু নদীর পানি বণ্টন চুক্তি আজ সংকটে। ভারতের বাঁধ নির্মাণে পাকিস্তানের কৃষি হুমকির মুখে। সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কের সবচেয়ে বড় অন্তরায়। ভারতের দাবি পাকিস্তান মুজাহিদিন গোষ্ঠীগুলোকে প্রশ্রয় দেয়। ইসলামাবাদ এটা ‘কাশ্মীরের স্বাধীনতা সংগ্রাম’ বলে আখ্যা দেয়। 

এই দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য পূরণ হওয়া ছাড়া সংলাপ অর্থহীন। অর্থনৈতিক সহযোগিতা হতে পারত সুড়ঙ্গের শেষে আলো। কিন্তু বাণিজ্য বন্ধ পরিবহন রুট অচল। ২০০৪-০৭ সালে বাণিজ্য বাড়ার ইতিবাচক প্রমাণ থাকলেও, বর্তমানে তা শূন্য। সাংস্কৃতিক বিনিময়, ক্রিকেট ম্যাচ, যৌথ চলচ্চিত্র নির্মাণের মতো নরম ক‚টনীতি এখন শুধু স্মৃতি। পারমাণবিক অস্ত্র দুই দেশের জন্য অভিশাপ ও রক্ষাকবচ। মিউচুয়াল এস্যিউরড ডিসট্রাকশন তত্ত¡ যুদ্ধ ঠেকালেও, দুর্ঘটনার ঝুঁকি থেকেই যায়। ১৯৯৯-এর কার্গিল যুদ্ধ, ২০১৯-এর বালাকোট বিমান হামলা প্রমাণ করে, ভুল বোঝাবুঝি যেকোনো সময় অগ্নিস্ফুলিঙ্গ জ্বালাতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা এখন অনিশ্চিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মনোযোগ ইউক্রেন-মধ্যপ্রাচ্যে। চীন-ভারত সীমান্ত বিবাদে বেইজিং ইসলামাবাদের পক্ষে। রাশিয়া নিরপেক্ষতা বজায় রাখলেও তার প্রভাব সীমিত। জাতিসংঘের প্রস্তাবনা আজ শুধু নিষ্ক্রিয় দলিল। 

তবুও ইতিহাসের কিছু মুহূর্ত প্রমাণ করে যে সমাধান সম্ভব। ২০০৩ সালের যুদ্ধবিরতি ২০ বছর ধরে সীমান্তে শান্তি রেখেছে। ২০২১-এর চুক্তি প্রমাণ করে, ব্যাকচ্যানেল কার্যকর। প্রয়োজন শুধু রাজনৈতিক সদিচ্ছা। প্রয়োজন শুদ্ধ ও স্বচ্ছ মানসিকতা। কবি ফৈজ আহমেদ ফৈজের ভাষায় ‘যুদ্ধের পর, যুদ্ধের আগে শান্তি আসে নীরবে।’ প্রশ্ন হলো, ভারত-পাকিস্তান কি সেই নীরবতার অর্থ বুঝতে পারবে? নেতৃত্বের অহংকার, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক হিসাব সবকিছু ছাপিয়ে মানুষের আকাঙ্ক্ষা জাগে শান্তির। ১৯৯৯-এর কার্গিল যুদ্ধ থেকে ইতিহাসের শিক্ষা হলো, যুদ্ধ কাউকে বিজয়ী করেনি। সম্পর্কের বরফ গলাতে হলে প্রয়োজন ধৈর্য ও সাহস। কাশ্মীরের পাহাড় আর সিন্ধুর নদী সাক্ষ্য দেয় ভারত ও পাকিস্তান একটি জ্বলন্ত অতীতের দুই প্রহরী। 

কাশ্মীর এই একটি শব্দই উপমহাদেশীয় রাজনীতি কালো ছায়ায় ঢেকে রেখেছে। ভারত যখন কাশ্মীরকে অভ্যন্তরীণ অঙ্গ হিসেবে ঘোষণা করে পাকিস্তান তখন তাকে আন্তর্জাতিক বিতর্কে রূপ দিতে মরিয়া। ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট ভারতের সংবিধান থেকে অনুচ্ছেদ ৩৭০ অপসারণ, কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসনের অবসান ঘটিয়ে দেয়। এই সিদ্ধান্ত পাকিস্তানের হৃদয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। সেদিন থেকে দুই প্রতিবেশীর সম্পর্ক যেন নিঃশেষ হাওয়ায় ঝুলে থাকা এক চূর্ণ শিকড়। দুই দেশের মধ্যে ক‚টনৈতিক সংলাপ কার্যত স্তব্ধ। 

পাকিস্তানে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনারকে প্রত্যাহার করা হয়। বাণিজ্য বন্ধ, বিমান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা, সাংস্কৃতিক বিনিময়ে স্থবিরতা। বালাকোটে ভারতীয় বিমান হানার পর পাকিস্তানের পাল্টা জবাব ছিল জিঘাংসার নিদর্শন। সন্ত্রাসবাদকে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তান অবিরত দোষারোপের ধ্বনিতে মুখর। আন্তর্জাতিক তথ্যানুযায়ী, ২০২৪ সালের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে ৩২০০ বারেরও বেশি। ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের তথ্যমতে দুই দেশই প্রতিবছর তাদের জাতীয় বাজেটের ১৫% এর বেশি ব্যয় করে প্রতিরক্ষা খাতে। পাকিস্তানের পরমাণু অস্ত্রের সংখ্যা বর্তমানে ১৭০-এর অধিক। আর ভারতের ১৬০-র আশপাশে। দুই দেশই যদি এই সামরিক দম্ভকে বিকাশের পথ না ভেবে সহাবস্থানের সেতু হিসেবে বিবেচনা করত তবে এশিয়ার মানচিত্র হয়তো আজ অধিক সবুজ হতো।

১৯৯৯ সালে লাহোর ঘোষণাপত্রে দুই দেশ শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক গঠনের আশ্বাস দিলেও তার স্থায়িত্ব ছিল তুষারের মতো ক্ষণিক। বিখ্যাত ভারতীয় কূটনীতিক কে. সুব্রহ্মণ্যম একবার বলেছিলেন, ‘উইদাউট ট্রাস্ট ডিপ্লোমেসি ইস ডেড এন্ড ট্রাস্ট ইস দ্য ফার্স্ট ক্যাজুয়াল্টি ইন ইন্ডো-পাক রিলেশনস।’ এই শব্দগুলোই যেন আজকের প্রেক্ষাপটে আরও প্রাসঙ্গিক। রাজনৈতিক দলগুলোর উগ্র জাতীয়তাবাদী বক্তব্য, মিডিয়া প্রপাগান্ডা ও সামরিক প্রতাপ সব মিলিয়ে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক আজ ‘শান্তির মরুভূমিতে’ দাঁড়িয়ে বালুকণার মত টলমল করছে। মানবিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, ভিসা জটিলতা বৃদ্ধি, ক্রিকেট-সংস্কৃতি বন্ধ। 

অথচ এই দুই জাতির হৃদয় মেলে ধরলে দেখা যায় সাধারণ মানুষ চায় মৈত্রী, চায় সম্পর্কের বর্ষা। বাংলাদেশের মতো দেশ এই উত্তপ্ত প্রেক্ষাপটে অসহায় দর্শক। দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতা আজ এই দুই রাষ্ট্রের আচরণেই নির্ভরশীল। ২০২৫ সালের সূচনালগ্নে দাঁড়িয়ে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যে কূটনৈতিক শৈত্যপ্রবাহ বইছে তা নিরসন না হলে পরবর্তী প্রজন্ম উত্তরাধিকার সূত্রে পাবে অনাস্থা, অবিশ্বাস ও আতঙ্কের ধারাবাহিকতা। তথ্যপ্রযুক্তি, চিকিৎসা, কৃষি, শিক্ষায় যেখানে একযোগে কাজ করা সম্ভব, সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষবৃক্ষ রোপণ কেন? ইতিহাস যদি এক নির্মম শিক্ষক হয় তবে ভবিষ্যৎ তার শ্রেষ্ঠ ছাত্র। ভারত ও পাকিস্তান এই দুই রাষ্ট্রের কর্ণধারদের তাই ভাবতে হবে, দ্বিধার দেয়াল ভেঙে কীভাবে মৈত্রীর সেতু নির্মাণ করা যায়। বিষণ্ণ এই বাস্তবতায় প্রয়োজন এক আন্তরিক সহমর্মিতা, প্রজ্ঞাসম্পন্ন কূটনীতি ও জনগণের আত্মিক জাগরণ। অন্যথায় অনন্ত শত্রুতা আমাদের এক ভয়াবহ অন্ধকারে ঠেলে দেবে।

লেখক: গবেষক ও সংগঠক