Image description

গাজার আকাশে এখন আর পাখি উড়ে না। বাতাসে শুধু বারুদের গন্ধ, আর মাঝেমধ্যেই শোনা যায়, শিশুদের কান্না। ধ্বংসস্তূপে পরিণত এক ভ‚খণ্ড সেখানে প্রতিটি ধূলিকণার ভেতর লুকিয়ে আছে ভাঙা স্বপ্ন, কবর হয়ে যাওয়া পরিবার, আর পৃথিবীর নীরবতা। এই সময়ের পৃথিবীতে, যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে মানুষ চাঁদের মাটি ছুঁয়ে ফেলে, সেই সময়ে গাজার মতো একটি ভূখণ্ডে মানুষ এখনো চিকিৎসার অভাবে, খাদ্যের অভাবে বা কখনো নিঃসঙ্গ শোকের মধ্যে প্রাণ হারায়। গাজার প্রতিটি ভোর যেন মৃত্যু নিয়ে আসে, আর প্রতিটি রাত বয়ে আনে অনিশ্চয়তা।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর, একটি ভয়াবহ অধ্যায় শুরু হয়। ইসরায়েলি বাহিনী গাজার ওপর এমন ধ্বংসযজ্ঞ নামিয়ে আনে, যা বিংশ শতাব্দীর পরবর্তী যুগে খুব কমই দেখা গেছে। যুদ্ধের প্রথম সপ্তাহেই মৃত্যু সংখ্যা হাজার ছাড়ায়। তারপর প্রতিদিনের গড় মৃত্যু বেড়েছে এমনভাবে, যা এখন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে হতবাক করে তুলেছে। জাতিসংঘের তথ্যমতে, ২০২৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত গাজায় মারা গেছে প্রায় ৩৪ হাজার মানুষ, এর মধ্যে অধিকাংশই শিশু ও নারী। আহত হয়েছে ৭০ হাজারের বেশি। বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ১৮ লাখ ছাড়িয়েছে, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮০ শতাংশ।

কিন্তু পরিসংখ্যান সব বলে না। সংখ্যার পেছনে থাকে জীবন, থাকে সম্পর্ক, থাকে ভালোবাসা। গাজার এক মা যখন ধ্বংসস্তূপের নিচে তার দুই সন্তানের লাশ খুঁজে পান, সেই দৃশ্য পরিসংখ্যান দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। যখন একটি শিশুর মাথায় কনক্রিট পড়ে, তখন আমরা বুঝি যুদ্ধ শুধু বন্দুক দিয়ে চলে না, চলে নীরবতা, নিষ্ক্রিয়তা, আর আমাদের সুবিধাজনক অমানবিকতা দিয়েও। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এই নির্লিপ্ততা আজ প্রশ্ন তোলে, আমরা কী সত্যিই মানবতা রক্ষা করতে চাই, না কি কেবল ভাষণ আর বিবৃতি দিয়ে নিজেদের দায় এড়াতে চাই?

ইসরায়েলের দাবি, তারা হামাসকে নির্মূল করতে এই অপারেশন চালাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, যেসব স্থাপনায় আঘাত হানা হচ্ছে তার অধিকাংশই আবাসিক ভবন, হাসপাতাল, স্কুল এবং জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে থাকা আশ্রয়কেন্দ্র। যুদ্ধবিধ্বস্ত এই এলাকার মানুষগুলো তো হামাস নয়, তারা সাধারণ নাগরিক, যারা কেবল বাঁচতে চায়। যুদ্ধ যখন এতটাই নিঃস্ব করে দেয় যে, শিশুদের কবর দিতে হয় কলাগাছের বাকল দিয়ে তৈরি কফিনে, তখন বুঝতে হয়, এটা আর কৌশলগত লড়াই নয়, বরং এটি একটি মানবতার বিরুদ্ধে সংগঠিত অপরাধ।

গাজা অনেক আগে থেকেই বিশ্বের সবচেয়ে বড় খোলা কারাগার হিসেবে পরিচিত। ২০০৭ সালে হামাস ক্ষমতায় আসার পর থেকে ইসরায়েল ও মিসর যৌথভাবে গাজা অবরোধ করে রেখেছে। এই অবরোধের কারণে খাদ্য, পানি, ওষুধ, বিদ্যুৎ, সবকিছুর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। করোনার সময় গাজা কার্যত এক নিঃসঙ্গ মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছিল। এবং এই যুদ্ধ যেন সেই অসুস্থ দেহের ওপর শেষ আঘাত। হাসপাতালগুলো ভেঙে পড়েছে, জ্বালানি নেই, অস্ত্রোপচার করতে হচ্ছে আলো ছাড়া। নবজাতকেরা মারা যাচ্ছে অক্সিজেন না পেয়ে। ওষুধ নেই, ইনজেকশন নেই, নেই খাদ্য, নেই পানীয় জল। তবুও মানুষ বাঁচার চেষ্টা করে যাচ্ছে।

যুদ্ধের রাজনৈতিক পটভূমি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এই সংঘাত শুধু মধ্যপ্রাচ্যের বাস্তবতা নয়, এটি বিশ্ব রাজনীতির এক নগ্ন প্রদর্শনী। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের যেসব প্রস্তাবে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানানো হয়েছিল, তা বারবার আটকে গেছে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটোতে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের কিছু দেশ উদ্বেগ জানালেও কার্যকর চাপ প্রয়োগ করেনি। দক্ষিণ আফ্রিকার নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ দায়ের হয়েছে বটে, কিন্তু এখনো পর্যন্ত কোনো বাস্তবিক প্রতিক্রিয়া নেই। বরং এই দীর্ঘ প্রক্রিয়ার আড়ালে আরও কত প্রাণ ঝরে যাচ্ছে, তা নিয়ে কোনো  গ্লোবাল ডিসকোর্স নেই।

বিশ্ব সম্প্রদায় দিক থেকে কিছুটা সহানুভ‚তির প্রতিফলন দেখা গেলেও, ইসরায়েলের হামলার পরিপ্রেক্ষিতে অনেক দেশ কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে সন্ত্রাসবাদ ও নিরাপত্তা বিষয়ক আলোচনা হতে থাকলেও, ইসরায়েলি বাহিনীর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা কিংবা দৃষ্টান্তমূলক কোনো ব্যবস্থা নিতে ভেটো দিয়ে বাধা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এতে একটি বড় প্রশ্ন উঠে আসে, কীভাবে এক রাষ্ট্রের অপরাধের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সমাজ কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে? এমন পরিস্থিতি যখন তৈরি হয়, তখন সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয় সাধারণ জনগণ। 

গাজার শিশুরা, নারীরা, বৃদ্ধরা, এরা সবাই এক দুর্বিষহ পরিস্থিতির শিকার। যেখানে প্রতিদিন মানুষ একে অপরকে খুঁজে ফিরে, তাদের শেষ শ্বাসটুকু বা সর্বশেষ কথা বলতে তারা কষ্ট পাচ্ছে। পরিবারগুলো একে অপরকে হারানোর শোকে ভেঙে পড়ছে। অথচ বিশ্বের অন্যান্য দেশে এসব ঘটনা নেহাতই একটি ‘সংবাদ’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গাজার প্রতিটি নাগরিক, তাদের অন্তরে এক অনন্ত যন্ত্রণা, তাদের জীবন যেন শুধুই বিপর্যয়ের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।

এদিকে, একদিকে যেখানে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ মিত্রতার নামে কথা বলছেন, সেখানে গাজার শিশুদের শরীরে লেগে থাকা বুলেটের ক্ষত তাদের অশান্ত ভবিষ্যতের দিকে ইঙ্গিত করছে। দেশের সীমানা বা ক্ষমতা থেকে বের হয়ে যখন পুরো পৃথিবী এক জাতি বা স¤প্রদায়ের অধিকারের কথা বলে, তখন কি আমরা কি সত্যিই মানবতার পক্ষে দাঁড়াতে পারি? এসব প্রশ্ন বিশ্বকে আলোড়িত করছে, কিন্তু তেমন কোনো কার্যকর উত্তর দেখা যাচ্ছে না। বিশ্বের বাণিজ্যিক শক্তি যেমন তেলের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে, তেমনি যুদ্ধের ফলে গাজার জনসংখ্যার বিশাল অংশ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে, যা বৈশ্বিক শরণার্থী সংকটের সৃষ্টি করছে। 

আর এসব সংকটের মধ্যে কিছু দেশ নিজের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করতে একে অপরকে চাপের মধ্যে ফেলছে, তবে মূল সমস্যা সমাধানের চেষ্টার কমতি দেখা যাচ্ছে। শরণার্থীদের গ্রহণ, তাদের পুনর্বাসন, খাবারের প্রাচুর্য এবং মৌলিক স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু সব কিছু সীমাবদ্ধতার মধ্যে। সবচেয়ে বড় কথা, এসব প্রতিকার কার্যকরভাবে মানবিক সংকটের সমাধান দিতে পারছে না।

এই পরিস্থিতিতে, আন্তর্জাতিক সমাজ যদি কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে না পারে, তবে হয়তো এই সংঘাতের প্রভাব বিশ্বজুড়ে আরও বিস্তার লাভ করবে। অতএব, এই যুদ্ধ শুধু গাজার সমস্যা নয়, এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। এটি আমাদের কেবল শেখায় না যে যুদ্ধের ক্ষত কত গভীর, বরং এটি বিশ্বকে আমাদের ঐক্য ও সহানুভ‚তির দরকার কতটা তা স্মরণ করিয়ে দেয়। একমাত্র মানবতার পক্ষে কাজ করে, শান্তির প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। শান্তি ও শান্তির প্রচারের মাধ্যমে শুধুমাত্র এই সংকট থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব, তা যদি বিশ্বজুড়ে কার্যকর ও সঠিক নেতৃত্বের অধীনে পরিচালিত হয়।

এই অবস্থায় বাংলাদেশের মতো দেশের নৈতিক অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে যুদ্ধ ও গণহত্যার মধ্য দিয়ে। আমরা জানি, কীভাবে নিপীড়ন এক জাতিকে গড়ে তোলে, আবার কীভাবে নীরবতা একটি অপরাধকে বৈধতা দেয়। বাংলাদেশের উচিত, ওআইসি এবং জাতিসংঘে সক্রিয় কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করা। বাংলাদেশ চাইলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে গাজার জন্য একটি মানবিক করিডোর তৈরির আহ্বান জানাতে পারে। আমাদের জনগণের মধ্যেও এই বিষয়ে সচেতনতা ছড়িয়ে দেয়া দরকার, বিশ্বের যে কোনো নির্যাতনের বিরুদ্ধে কণ্ঠ তোলা আমাদের দায়িত্ব।

তরুণ প্রজন্ম, যারা স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখে, তাদের বোঝাতে হবে, গাজার মতো যুদ্ধ আজকের পৃথিবীতে কেবল আগ্নেয়াস্ত্রের লড়াই নয়, বরং তথ্য, মিডিয়া, এবং মনস্তত্ত্বের লড়াই। গাজার পক্ষে কথা বলা মানে কোনো দলের পক্ষ নেয়া নয়, এটি মানবতার পক্ষে দাঁড়ানো। সাংবাদিকতা, সাহিত্যে, চিত্রকলায়, এমনকি গানেও গাজার প্রতিরোধ উঠে আসা উচিত, এই দুনিয়াকে মনে করিয়ে দিতে, ন্যায়বিচার ছাড়া কোনো সভ্যতা টিকে থাকে না।

সবশেষে, একটি প্রশ্ন থেকে যায়, এই যুদ্ধ কবে শেষ হবে? আদৌ কি শেষ হবে? নাকি এই আগুন আরও ছড়িয়ে পড়বে নতুন প্রজন্মের মনে? আজ যারা ধ্বংস দেখছে, কাল তারা কি ঘৃণা নিয়ে বড় হবে না? এই চক্র বন্ধ করতে হলে আমাদের কেবল অস্ত্র নয়, দরকার বিবেকের বিপ্লব। দরকার এমন এক বিশ্ব, যেখানে এক শিশুর কান্না পেরিয়ে যায় ক‚টনৈতিক সীমারেখা, আর প্রতিটি মায়ের শোক আমাদের ঘুম ভাঙায়।

গাজা আজ শুধু একটি ভূখণ্ড নয়, এটি হয়ে উঠেছে আমাদের বিবেকের আয়না। সেখানে আমরা কী দেখি? এক ধ্বংসস্তূপ, নাকি এক জাতির অদম্য প্রতিরোধ? সে উত্তর আমাদের হৃদয়ের ভেতরেই লুকিয়ে আছে।

লেখক: সাহিত্যিক ও কলামিস্ট