Image description

শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে বিশ্ব দিবস, যা প্রতিবছর ১২ জুন, শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী আন্দোলনকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে অনুষ্ঠিত ও পালিত হয়। আজ বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য, ‘স্বপ্নের ডানায় ভর করি, শিশুশ্রমের শৃঙ্খল ছিঁড়ি—এগিয়ে চলি দৃপ্ত পায়ে, আশার আগুন বুকে জ্বালি।

বাংলাদেশে দিবসটি পালন উপলক্ষে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এবং ইউনিসেফসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও দেশীয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা নানা কর্মসূচি নিয়েছে।

এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ২০২৫ সালের মধ্যে দেশকে সব ধরনের শিশুশ্রম থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা ২০২১-২৫ প্রণয়ন করা হয়েছে। এ কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ‘জাতীয় শিশুশ্রম কল্যাণ পরিষদ’ কাজ করছে। 

সুবিধাবঞ্চিত পথশিশুদের পুনর্বাসন এবং বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর বিকাশ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বাংলাদেশ জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ ও ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমবিষয়ক আইএলও কনভেনশন অনুসমর্থন করেছে।

বাংলাদেশ জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ ও ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বিষয়ক আইএলও কনভেনশন অনুসমর্থন করেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর শিশুশ্রম সমীক্ষা-২০০৩ অনুযায়ী বাংলাদেশে শ্রমে নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা ছিল প্রায় ৩২ লাখ। সরকারের পদক্ষেপের ফলে ২০২৩ সালে শিশুশ্রম সমীক্ষা অনুযায়ী শ্রমে নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা হ্রাস পেয়ে ১৭ লক্ষে দাঁড়িয়েছে।

বিভিন্ন গণমাধ্যম দিবসটির গুরুত্ব তুলে ধরে অনুষ্ঠান, টিভিসি প্রচার করবে। সারা দেশে কলকারখানা ও শ্রমঘন এলাকায় ব্যানার, ফেস্টুন ও পোস্টার টানানো হবে। শিশুশ্রম নিরসনে সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ করা হবে। বিভিন্ন শিল্প এলাকার কলকারখানায় শিশুশ্রম নিরুৎসাহিত করতে বিশেষ পরিদর্শনের ব্যবস্থা করা হবে।

এদিকে সরকারিভাবে ২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশে শিশুশ্রম শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার কথা ছিল। অন্যদিকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ২০৩০ সালের মধ্যে সব রকম শিশুশ্রম বন্ধ করার তাগিদ আছে বিশ্বদরবার থেকে। কিন্তু দেশে শিশুশ্রম কমার পরিবর্তে তা বেড়েই চলেছে। জাতীয় শ্রম জরিপ ২০২২ সে কথাই বলছে। এ জরিপ অনুযায়ী দেশে ৩৫ লাখ ৩৬ হাজার ৯২৭ শিশু বিভিন্ন ধরনের শ্রমে নিয়োজিত আছে, যা ২০১৩ সালে ছিল ৩৪ লাখ ৫০ হাজার ৩৬৯। অর্থাৎ ১০ বছরে দেশে শিশু শ্রমিক বেড়েছে ৮৬ হাজার ৫৫৮ জন। 

শিশু অধিকার কর্মীরা বলছেন, যে বয়সে শিশুদের সৃজনশীল কাজে ব্যস্ত থাকার কথা, সে সময় আর্থিক অনটনে বাংলাদেশের বড় সংখ্যক শিশুই বিভিন্নভাবে শ্রমে নিয়োজিত হচ্ছে। এসব শিশুকে শ্রম থেকে সরাতে প্রয়োজন আর্থিক সহায়তা ও সুশিক্ষা নিশ্চিত করা।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত ‘সেক্টরভিত্তিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত শিশুশ্রম জরিপ ২০২৩’-এর প্রতিবেদন আরও বলছে, দেশে শিশুর সংখ্যা প্রায় চার কোটি। এর মধ্যে ২০ লাখ ৯০ হাজার শিশু গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে। তাদের মধ্যে আবার ২০ লাখ ১০ হাজার শিশু শ্রমিক কোনো পারিশ্রমিক পায় না। যারা পারিশ্রমিক পায়, তাদের গড় আয় মাসে ৬ হাজার ৬৭৫ টাকা। এ ছাড়া শিশু শ্রমিকদের মধ্যে ১০ লাখ ৭০ হাজার ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে।

অন্যদিকে বিবিএসের ওই প্রতিবেদনে শিশুশ্রমের আরও গভীর চিত্র উঠে এসেছে। এ জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ঝুঁকিপূর্ণ পাঁচটি খাতের ৪০ হাজার ৫২৫টি কারখানায় সব মিলিয়ে ৩৮ হাজার ৮ জন শিশু কাজ করে। তাদের প্রায় ৯৮ শতাংশ ছেলে, বাকিরা মেয়ে। এর মধ্যে মোটর যানবাহনের রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতে (অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ) ২৪ হাজার ৯২৩ জন, পাদুকা উৎপাদনে ৫ হাজার ২৮১ জন, ওয়েল্ডিংয়ের কাজ বা গ্যাস বার্নার মেরামতের ৪ হাজার ৯৯ জন এবং টেইলারিং ও পোশাক খাতে ২ হাজার ৮০৫ শিশু কাজ করে। আর শুঁটকি উৎপাদনে কাজ করে ৮৯৮ জন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও ইউনিসেফ পরিচালিত ‘সার্ভে অন স্ট্রিট চিলড্রেন ২০২২’ শীর্ষক জরিপ অনুযায়ী, শ্রমে নিয়োজিত শিশুদের মধ্যে ৩১ শতাংশ কাজ করতে গিয়ে বিভিন্নভাবে আহত হয়েছে। আহত শিশুদের মধ্যে ৬৭ শতাংশের ক্ষেত্রে আঘাত ও কাটাছেঁড়ার ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া ভারী বস্তু বহনের ফলে ঘাড়, পিঠ ও কোমরে ব্যথা, হাড় ভাঙা, দগ্ধ হওয়া এবং মারধরের শিকার হওয়ার ঘটনাও সামনে এসেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) তথ্যমতে, ২০২৩ সালে কর্মস্থলে সহিংসতার কারণে ২০ জন শিশু শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছে।

অথচ বাংলাদেশ শ্রম (সংশোধন) আইন, ২০১৮-এর খসড়ায় শিশুশ্রম সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নতুন আইনে যদি কেউ শিশু শ্রমিক নিয়োগ করে, তাহলে তার বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়। সংশোধিত আইনে ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়সী কিশোরদের হালকা কাজে নিয়োগ দেয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে, যেখানে আগে ১২ বছর বয়সী শিশুরাও হালকা কাজে নিয়োজিত হওয়ার অনুমতি পেত।

জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতি ২০১০ অনুযায়ী, শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কোনো কাজে নিয়োগ দেয়া সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুরা যদি সপ্তাহে সর্বোচ্চ ৪২ ঘণ্টা পর্যন্ত হালকা বা ঝুঁকিমুক্ত কাজ করে, তাহলে সেটিকে অনুমোদনযোগ্য শ্রম হিসেবে গণ্য করা হয়। তবে ৫ থেকে ১১ বছর বয়সী কোনো শিশু যদি ঝুঁকিমুক্ত কাজেও নিয়োজিত হয়, সেটিকে শিশুশ্রম হিসেবে বিবেচনা করা হবে। এ ছাড়া ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী কোনো শিশু যদি সপ্তাহে ৪২ ঘণ্টার বেশি কাজ করে, তা ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম হিসেবে গণ্য হবে।