সীমান্তের গডফাদার ডাকাত শাহীন সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার

কক্সবাজারের শীর্ষ সন্ত্রাসী, পাহাড়-সমতলের শীর্ষ ডাকাত শাহীনুর রহমান ওরফে শাহীন ডাকাত অনেক প্রতীক্ষার পর অবশেষে ধরা পড়েছেন। ইতোপূর্বে যৌথভাবে বারবার চেষ্টা করেও তাকে গ্রেফতার করতে পারেনি। অবশেষ সেই কাজটি করে দেখিয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। তাদের অভিযানে সহায়তা দেয় র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব-১৫) ও সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।
বৃহস্পতিবার (০৫ জুন) সকাল ১০টার দিকে রামু উপজেলার গর্জনিয়া ইউনিয়নের জাউচপাড়া এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। ওই সময় ডাকাত শাহীন তার শ্বশুর শাকের মেম্বারের বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। সেনাবাহিনীর চৌকস দলের অভিযানে শাহীন ডাকাত গ্রেফতার হওয়ায় পুরো এলাকার জনমনে স্বস্তি ফিরে এসেছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কক্সবাজার শহরস্থ ঝিলংজা ক্যাম্পে দায়িত্বরত মেজর শাহরিয়ার, শাহীন ডাকাতকে গ্রেফতারের বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার (০৫ জুন) বিকেল সাড়ে ৩টায় (র্যাব-১৫) গর্জনিয়ায় ধৃত শাহীনের বাড়ির সামনে যৌথ প্রেস ব্রিফিং করেছে সেনাবাহিনী, র্যাব ও বিজিবি। অভিযানকালে ডাকাত শাহীন ছাড়াও তার দুই সহযোগীকেও গ্রেফতার করা হয়। এছাড়াও বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, ইয়াবা ও ডাকাতির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার হওয়া অস্ত্রের মধ্যে আছে ১০টি দেশীয় ধারালো অস্ত্র কিরিচ, ৩টি একনলা বন্দুক, একটি একে-২২ রাইফেল, ১০ রাউন্ড গুলি ও চারটি কার্তুজ। এছাড়াও ২০ হাজার পিস ইয়াবা ট্যাবলেট ও সেনাবাহিনীর ব্যবহৃত বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়।
সংশ্লিষ্টদের মতে, রামু উপজেলার পূর্বাঞ্চলের অস্ত্র, গরু, মাদক চোরাচালানসহ বহু মামলার আসামি, শাহীনুর রহমান শাহীন ওরফে ডাকাত শাহীনের ডেরায় গত ২৫ মে অভিযান চালিয়েছিল যৌথবাহিনী। ওই অভিযানে অস্ত্র, মাদক, জাল টাকা ও ওয়াকিটকি উদ্ধার হলেও কৌশলে সটকে পড়েছিল ডাকাত শাহীন। র্যাব-১৫ এর সহকারি পরিচালক (আইন ও গণমাধ্যম) ও সহকারি পুলিশ সুপার আ. ম. ফারুক গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, কক্সবাজার জেলার রামু উপজেলার গর্জনিয়া ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডস্থ মাঝিরঘাটা গ্রামের পলাতক আসামি শাহীনুর রহমান শাহীন একজন অস্ত্রধারি ডাকাত। সে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ড করে আসছে। তার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত ১৯টি মামলা রয়েছে। পুলিশের তথ্য মতে, সিআর ও জিআর মামলা এবং সাধারণ ডাইরিসহ (জিডি) অন্তত ১৯ মামলার পলাতক আসামি এই ডাকাত শাহীন। তার দুই ডজন মামলার মধ্যে ৯টি ডাকাতি, ডাকাতির প্রস্তুতি ও ছিনতাই, ৪টি হত্যা মামলা, দুটি অস্ত্র মামলা, দুটি মাদক মামলা এবং বাকিগুলো বিভিন্ন থানায় জিডি হিসেবে রয়েছে।
সীমান্ত জনপদের আতংক ডাকাত শাহীন: সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র ও স্থানীয়দের মতে, সীমান্ত জনপদের এক আতংকের নাম ডাকাত শাহীন। তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ সীমান্ত এলাকার লোকজন। তার বাহিনীর ভয়ে কেউ মুখ খোলার সাহসও পাচ্ছে না। ফলে বান্দরবানের নাইক্ষংছড়ি ও কক্সবাজারের রামু উপজেলায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে ডাকাত শাহীন। খুন, ডাকাতি, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া, একচ্ছত্র ভাবে গরু ও মাদক পাচার নিয়ন্ত্রণ, মতের বিরোধ থাকা লোকজনকে এলাকা ছাড়াসহ এমন কোন অবৈধ কাজ নাই যা সে করে না!
ধনীর দুলাল থেকে শীর্ষ ডাকাত: শাহীনুর রহমান শাহীন ওরফে ডাকাত শাহীন হচ্ছে মূলত ধনীর ঘরের আদরের দুলাল। কক্সবাজারের রামু উপজেলার গর্জনিয়ার জমিদার হাজী ইসলামের সন্তান সে। বাবা- মায়ের স্বপ্ন ছিল সন্তান বড় হয়ে গর্জনিয়ার হাল ধরবে। হাল ধরেছে ঠিকই, তবে তা সমাজসেবা বা এলাকার মানুষের কল্যাণে নয়। একের পর খুন, ডাকাতি, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া, একচ্ছত্র গরু, মাদক ও সিগারেট পাচার নিয়ন্ত্রণ, মতের বিরোধ থাকা লোকজনকে এলাকা ছাড়া করাসহ ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে নাইক্ষংছড়ি ও রামু সীমান্তের জনপদে।
গর্জনিয়ায় পৃথক পুলিশ ফাঁড়ি, বিজিবি ক্যাম্প থাকলেও সেখানে আইন চলে কেবল শাহীনের। বলা যায়, শাহীনের হাতে স্বাধীন দেশের পরাধীন এক ভূখন্ড রামু ও পাশ্ববর্তী নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা। সংশ্লিষ্টদের মতে, শাহীনের হাতে খুনের তালিকাও দীর্ঘ হচ্ছে প্রতিনিয়ত। প্রকাশ্যে করা খুনের তথ্য এলাকাবাসি জানলেও সীমান্তে লোকচক্ষুর আড়ালে তৈরি করা মৃত্যুপুরীর পরিসংখ্যান থেকে যাচ্ছে আড়ালে! যুবক, বৃদ্ধ, নারী, এমনকি পেটের অনাগত সন্তানও রেহায় পায়নি এই শাহীনের হাত থেকে। এলাকাবাসি জানিয়েছেন, পড়াশোনার জন্য পরিবার থেকে শাহীনকে ঢাকা এবং চট্টগ্রামে পাঠালেও সেদিকে মন না দিয়ে চলে আসেন গ্রামে। অপরাধ জগতে পা দেয় ঈদগড়ের ভয়ংকর ডাকাত কালু, কলিমুল্লাহসহ কয়েকজনের হাত ধরে। শুরুতে ঈদগড়-ঈদগাও সড়কে ডাকাতি করতে গিয়ে আটক হয়ে জেলে গিয়েছিলেন শাহীন। সেখান থেকেই ঘুরে যায় তার জীবন। সন্ত্রাসিদের অনুসারী থেকে হয়ে উঠেন সন্ত্রাসি বাহিনীর প্রধান। ২০১২ সালে সন্ত্রাস জগতে পা রাখা শাহীন এখন সীমান্তের অপরাধ জগতের 'ডন'। সূত্র মতে, ৫০০ থেকে এক হাজার বার্মিজ গরু অবৈধভাবে প্রতিদিন বাংলাদেশে প্রবেশ করে। প্রতিটি গরু থেকে ৩ হাজার টাকা করে দিতে হয় শাহীনকে। শুধু গরু নয়, সাথে আসে আইস, ইয়াবা, সিগারেটসহ বিভিন্ন অবৈধ পণ্য, যার মূল নিয়ন্ত্রক হচ্ছেন এই শাহীন। গরু, আইস, ইয়াবা, সিগারেট চোরাচালান বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে সীমান্তের এই এলাকায় বেড়ে গেছে খুনোখুনির ঘটনাও। শাহীনের গরু এবং ইয়াবা পাচারে কেউ নূন্যতম বাধা হলেও তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়া হয় বলে জানায় এলাকাবাসি। এভাবে এক এক করে সীমান্তের এই এলাকাগুলোতে গেলো কয়েক বছরে অন্তত ডজনাধিক খুনের নেতৃত্ব দিয়েছেন শাহীন।
ডাকাত শাহীনের নৃশংসতা: ভুক্তভোগীদের মতে, সেদিন ছিল ২০২৩ সালের ৩ মার্চ। এদিন ভয়ংকর হত্যাকান্ডের সাক্ষী হয় গর্জনিয়ার বেলতলীর মানুষ। নাইক্ষ্যংছড়ির শফিউলাহর ছেলে ইরফানকে ডাকাত শাহীন তার নিজের মোটরসাইকেলে বসিয়ে পেছন থেকে গুলি করে হত্যা করে নৃসংশভাবে। যে খুনের কথা এখনও ভুলতে পারেননি এলাকার মানুষ। ডাকাত শাহীনের তেমনই আরেক শিকার স্থানীয় আবুল কাশেম। ২০২৪ সালের ৮ মে মধ্যরাতে শাহীন তাকে নিজ বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে নারাইম্মাজিরি পাহাড়ে নিয়ে যায় এবং সে আর ফিরেনি।
Comments