Image description

প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই পড়ে আসা প্রশ্ন, রেললাইনের পাত কেন ফাঁকা রাখা হয়? অতিরিক্ত তাপপ্রবাহের কারণে রেললাইন প্রসারিত হতে পারে, তাই ফাঁকা রাখা হয়। যেন স্বাভাবিকভাবে প্রসারিত হতে পারে, আর ফাঁকা রাখা না হলে প্রসারিত হয়ে রেললাইনের পাত বেঁকে যেতে পারে। অস্বাভাবিক অবস্থা তৈরি হতে পারে।

প্রাথমিক বিদ্যালয় পেরিয়ে আসা প্রায় সবার এই উত্তরটিই এখন প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ দেশব্যাপী তাপপ্রবাহের মধ্যে সম্প্রতি দুবার রেললাইনের পাত বেঁকে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ছোটবেলায় পড়ে আসা জবাবটি মনে করিয়ে দিলে ঢাকা ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির (ডুয়েট) ম্যাটেরিয়ালস অ্যান্ড মেটালার্জিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং (এমএমই) বিভাগের প্রধান ড. মো. আরেফিন কাওসার সময়ের আলোকে বলেন, রেললাইনের পাত তৈরিতে ব্যবহৃত ম্যাটেরিয়ালে দিনে দিনে পরিবর্তন আনা হয়েছে। ম্যাটেরিয়াল ব্যবহারের ক্ষেত্রে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয় যে, তা যেন কম তাপ শোষণ করে, তা হলে তপ্ত হয়ে পাত বেঁকে যাওয়া নিয়ে ভাবতে হয় কম। এখন তো এমন পাত ব্যবহার করা হয়, যার ফলে রেললাইনের পাতে আগের মতো ফাঁকা রাখতে হয় না, ফাঁকার পরিমাণ অনেক কম বা আগের তুলনায় অনেক দূরে দূরে ফাঁকা রাখলেই হয়। কারণ এমন ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করা হয়, যা তাপ শোষণ করে কম, তা প্রসারিত হওয়ার ঝুঁকিও কম।

উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, কয়েক বছর আগে অস্ট্রেলিয়ায় দাবানলের ঘটনার পর সেখানকার অনেক ইলেক্ট্রনিক সরঞ্জাম নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, কারণ সেগুলো একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ তাপমাত্রা সহনীয় ছিল। কিন্তু দাবানলের অস্বাভাবিক তাপে তা নষ্ট হয়ে গেছে। একইভাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ওই রেললাইনের পাতে ফাঁকা রাখলেও তা সর্বোচ্চ কতখানি তাপপ্রবাহ বিবেচনায় নির্ধারণ করা হয়েছে তাও দেখতে হবে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় রেললাইনের পাত বেঁকে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এই অধ্যাপক বলেন, দেখতে হবে যেই জায়গায় পাত বেঁকে গেছে, সেখানকার পাত আগেকার কি না? কারণ আগের পাত বেশি তাপ শোষণ করে, তাই বেঁকে যাওয়ার ঝুঁকি বেশি, সেই অনুসারে রেললাইনের পাতে ফাঁকা আছে কি না?
প্রসঙ্গত, গত শনিবার দুপুরের দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরতলির দাড়িয়াপুরে রেললাইনের পাত বাঁকা হয়ে যাওয়ার বিষয়টি ধরা পড়ে। পাত বাঁকা অবস্থায় দেখে স্থানীয়রা তা রেল কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে। এর আগে বৃহস্পতিবার একই জায়গায় রেললাইনের পাত বাঁকা হয়ে যাওয়ায় একটি মালবাহী ট্রেনের সাতটি বগি লাইনচ্যুত হয়। চব্বিশ ঘণ্টা পার হওয়ার আগেই শনিবার আবারও সেখানকার রেললাইনের পাত বেঁকে যায়।

রেল কর্মকর্তারা বলেছেন, তাপপ্রবাহের কারণে রেলের পাত বেঁকে গেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে শনিবার দিনের তাপমাত্রা ৩৪ ডিগ্রি হলেও রেলের পাতে তাপমাত্রা অনেক বেশি পাওয়া যায়।

বাংলাদেশ রেলওয়ের বিভাগীয় প্রকৌশলী সিরাজ জান্নাত বলেছেন, রেললাইনের পাত বাঁকা হয়ে যাওয়ার স্থানে তেমন গাছপালা নেই। তাই তাপ বেশি হওয়ায় প্রচণ্ড গরমের কারণে রেলের পাত বাঁকা হয়ে গেছে। শহরে যে তাপমাত্রা আছে, রেলের পাতের তাপ আরও বেশি। 

কর্মকর্তারা বলছেন, কিছুদিন আগে এই এলাকায় রেলে স্লিপার পরিবর্তন করা হয়েছিল। সেই কারণে এভাবে রেলের পাত বাঁকা হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে কি না, সেটিও পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাপপ্রবাহ বেশি হলে রেলের পাত বেঁকে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। এ ধরনের নজির অনেক জায়গায় রয়েছে। ২০২২ সালেও ব্রিটেনে গরমের কারণে রেল চলাচল বিঘ্নিত হয়েছিল। তাপপ্রবাহ ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকলে রেললাইনের ওপরে সূর্যের তাপ ৫০ ডিগ্রি পর্যন্ত হতে পারে। যেহেতু রেলের পাত লোহা দিয়ে তৈরি এবং সূর্যের তাপে লোহা অতিরিক্ত গরম হয়।

গ্লোবাল রোড সেফটি প্রোগ্রামের ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেটর মাহিয়াত হাসনা স্বর্না বলেছেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রেললাইনকে সাদা রঙ করে দেওয়া হচ্ছে, যাতে সেটি কম তাপ শোষণ করে। যুক্তরাজ্য, ইতালিসহ অনেক দেশে এটা করা হচ্ছে। রেললাইনে সাদা রং করা হলে সেটির তাপমাত্রা পাঁচ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত কমতে পারে।

এদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে বেঁকে যাওয়া রেললাইন সোজা করা হয়েছে বলে জানা গেছে। গত শনিবার রাত থেকে চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও সিলেটের সঙ্গে ঢাকা অভিমুখী রেলপথে (আপলাইন) ট্রেন চলছে। অবশ্য গতি কমিয়ে দুর্ঘটনাকবলিত এলাকা অতিক্রম করছে ট্রেন। সর্বশেষ রোববার ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ও সিলেট অভিমুখী রেলপথ (ডাউনলাইন) দিয়েও ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক ছিল। 

আখাউড়া রেলওয়ের সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী মেহেদী হাসান আহমেদ তারেক বলেছেন, চট্টগ্রাম-সিলেটমুখী ডাউনলাইনও কয়েকটি জায়গায় বেঁকে গেছে। পানি ও কচুরিপানা দিয়ে রেললাইন শীতল করা হয়।

রেলস্টেশন সূত্রে জানা গেছে, আখাউড়া থেকে আশুগঞ্জ পর্যন্ত গতি কমিয়ে ট্রেন চালানোর নির্দেশনা দেওয়া হয় শনিবার। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে তালশহর পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার গতিতে, আশুগঞ্জ থেকে নরসিংদী পর্যন্ত ৪০ কিলোমিটার গতিতে ও নরসিংদী থেকে টঙ্গী পর্যন্ত সব ট্রেনকে ৩০ কিলোমিটার গতিতে চালানোর জন্য লোকোমাস্টারদের (ট্রেনচালক) নির্দেশনা দেওয়া হয়।