Image description

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সাড়ে তিন দশক পর অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচনে নারী প্রার্থীর নগণ্য অংশগ্রহণ নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন নারী শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অধিকারকর্মীরা। মোট প্রার্থীর মাত্র ১০ শতাংশ নারী, যার বেশিরভাগই সংরক্ষিত পদে। এর পেছনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাইবার বুলিং, ট্যাগিং, স্লাট-শেমিং এবং ব্যক্তিগত নিরাপত্তার অভাবকে দায়ী করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সাইবার সেল গঠন করলেও তা কার্যকর হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। আগামী ২৫ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিতব্য এই নির্বাচন ঘিরে ক্যাম্পাসে উত্তেজনা তুঙ্গে।

প্রার্থী ও ভোটার পরিসংখ্যান

নির্বাচন কমিশনের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ভোটার ২৮,৯০৫ জন, যার মধ্যে নারী ভোটার ১১,৩০৫ জন (৩৯.১%)। রাকসু’র ২৩টি পদের বিপরীতে প্রার্থী ২৪৮ জন, যার মধ্যে নারী প্রার্থী মাত্র ২৫ জন (১০%)। এই ২৫ জনের মধ্যে ১৪ জন সংরক্ষিত পদে প্রার্থী, ফলে সংরক্ষিত পদ বাদ দিলে নারী প্রার্থী মোট প্রার্থীর মাত্র ৪.৪৫%।

গুরুত্বপূর্ণ পদে নারী প্রার্থীদের সংখ্যা: সহ সভাপতি (ভিপি) পদে ১ জন, সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে ৪ জন, সহসাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে ২ জন, সিনেট ছাত্রপ্রতিনিধি ৫৮ জন প্রার্থীর মধ্যে ৮ জন নারী (১৩.৭%)।

নারী হলগুলোতে প্রার্থিতার চিত্র

নারী হলগুলোতে মোট ৯০টি পদের বিপরীতে ১৩৯ জন প্রার্থী মনোনয়ন নিয়েছেন। এর মধ্যে ২৬টি সম্পাদকীয় পদ ও ১৩টি কার্যকরী সদস্য পদে ৩৯ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছেন। তবে ৪টি কার্যকরী সদস্য পদ শূন্য রয়েছে, অর্থাৎ কেউ প্রার্থী হননি। হলভিত্তিক বিস্তারিত:

মন্নুজান হল: সহকারী সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে ১ জন এবং নির্বাহী সদস্য ৪টি পদে ৫ জন প্রার্থী।

জুলাই-৩৬ হল: সহবিতর্ক ও সাহিত্য, সহক্রীড়া, সহসংস্কৃতি, সহকমন রুম সম্পাদক পদে ১ জন করে এবং নির্বাহী সদস্য ৪ পদে ৩ জন প্রার্থী।

রোকেয়া হল: সহবিতর্ক ও সাহিত্য, কমন রুম, সহকারী কমন রুম, ক্রীড়া, সহকারী ক্রীড়া, সহসাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে ১ জন করে এবং নির্বাহী সদস্য ৪ পদে ৩ জন প্রার্থী।

রহমতুন্নেসা হল: বিতর্ক ও সাহিত্য, সহবিতর্ক ও সাহিত্য, কমন রুম, সহকমন রুম, ক্রীড়া, সহক্রীড়া সম্পাদক পদে ১ জন করে এবং নির্বাহী সদস্য ৪ পদে ৩ জন প্রার্থী।

তাপসী রাবেয়া হল: সহকারী কমন রুম, সাংস্কৃতিক, সহসাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে ১ জন করে এবং নির্বাহী সদস্য ৪ পদে ৫ জন প্রার্থী।

খালেদা জিয়া হল: বিতর্ক ও সাহিত্য, সহকারী কমন রুম, ক্রীড়া, সহক্রীড়া, সাংস্কৃতিক, সহসাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে ১ জন করে এবং নির্বাহী সদস্য ৪ পদে ৪ জন প্রার্থী। সহবিতর্ক ও সাহিত্য সম্পাদক পদে কোনো প্রার্থী নেই।

ছেলেদের হলে ১৬৫টি পদের মধ্যে ৩টি সম্পাদকীয় পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছেন ৩ জন। কোনো পদ শূন্য নেই।

সাইবার বুলিং: নারী প্রার্থীদের প্রধান বাধা

নারী প্রার্থীদের কম অংশগ্রহণের পেছনে সাইবার বুলিং, ট্যাগিং ও স্লাট-শেমিং প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। সিনেট শিক্ষার্থী প্রতিনিধি প্রার্থী রেনেসাঁ রাত্রী বলেন, “নির্বাচনি প্রচার শুরুর সঙ্গে সঙ্গে সাইবার বুলিং শুরু হয়েছে। গঠনমূলক সমালোচনার পরিবর্তে আক্রমণাত্মক ভাষায় বুলিং করা হচ্ছে, যা অনেককে নির্বাচনে না আসার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করছে।”

রাকসু’র জিএস প্রার্থী আসিয়া খাতুন বলেন, “নারীদের অংশগ্রহণ কম হওয়া দুঃখজনক। এটি কেবল সংখ্যার ঘাটতি নয়, বরং সামাজিক মানসিকতা ও পরিবেশের সীমাবদ্ধতার প্রতিচ্ছবি। নিরাপত্তার অভাব, সামাজিক বাধা এবং নিরুৎসাহিত করার প্রবণতা নারীদের পিছিয়ে দিচ্ছে। ক্যাম্পাস রাজনীতির সংঘাতমুখী পরিবেশও নিরুৎসাহিত করে।”

জুলাই-৩৬ হলের ছাত্রী ও জিএস প্রার্থী তাবাসসুম সুপ্তি বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ে মননশীলতা ও সহমর্মিতার পরিবেশ থাকার কথা, কিন্তু সাইবার বুলিং ও স্লাট-শেমিং বাড়ছে। রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় নারীরা নিয়মিত এর শিকার হচ্ছেন, যার ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীরাও নির্বাচনে ভয় পাচ্ছেন।”

ছাত্রদল নেত্রী জান্নাতুন নাঈম তুহিনা বলেন, “অনলাইনে চরিত্রহনন, বডি শেমিং, ‘যৌনকর্মী’, ‘রাতের রাণী’, ‘নেতাদের পরী’র মতো ভাষা সাধারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাধারণ নারী শিক্ষার্থীদেরও ‘কে ভোট দেবে’ বলে দমিয়ে রাখা হচ্ছে। এটিই নারীদের অংশগ্রহণ কম হওয়ার অন্যতম কারণ।”

সাইবার বুলিংয়ের উদাহরণ

৪ সেপ্টেম্বর জুলাই-৩৬ হলের ৯১ জন ছাত্রীকে নির্ধারিত সময়ের পরে প্রবেশের জন্য তলব করা হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে সমালোচনার পর নোটিস প্রত্যাহার করা হলেও, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার্স ইউনিটির ফটোকার্ড শেয়ার করার পর ছাত্রদল নেতা আনিসুর রহমান মিলন আপত্তিকর মন্তব্য করেন, “এগুলো ছাত্রী নয়, বিনা পারিশ্রমিক যৌনকর্মী।” সমালোচনার মুখে তাকে ছাত্রদল থেকে বহিষ্কার করা হয়। হল প্রভোস্ট লাভলী নাহার স্বীকার করেন, নোটিসের কারণে শিক্ষার্থীরা সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়েছেন এবং এজন্য দুঃখ প্রকাশ করেন।

সাইবার সেলের কার্যক্রম

নির্বাচন কমিশন ৩০ অগাস্ট অধ্যাপক মো. একরামুল হামিদের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের সাইবার সেল গঠন করে, কিন্তু এর কার্যক্রম দৃশ্যমান নয়। সাইবার সেলের আহ্বায়কের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। ১৩ সেপ্টেম্বর ১১ জন নারী প্রার্থী সাত দফা সাইবার সুরক্ষা নীতি প্রস্তাব করলেও, এর বাস্তবায়ন এগোয়নি।

কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষকদের বক্তব্য

উপ-উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন খান বলেন, “সাইবার বুলিং একটি উদ্বেগজনক বিষয়। আমরা সতর্ক রয়েছি এবং সাইবার সেল গঠন করেছি। শিক্ষার্থীদের সচেতন হতে হবে এবং হেনস্তাকারীদের শনাক্ত করে প্রশাসনের কাছে পৌঁছালে শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।”

প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক এফ নজরুল ইসলাম বলেন, “নারী প্রার্থীদের পার্সেন্টেজ কম হওয়া স্বাভাবিক। আমরা তাদের উৎসাহিত করেছি, কিন্তু তারা না আসতে চাইলে কিছু করার নেই। তবে বিগত নির্বাচনের তুলনায় এটি হতাশাজনক নয়।”

প্রক্টর অধ্যাপক মাহবুবর রহমান বলেন, “সাইবার বুলিং নারী প্রার্থী কম হওয়ার মূল কারণ। আগে এক নেতার আপত্তিকর মন্তব্যের জন্য তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে, এবং তদন্ত চলছে।”

ফোকলোর বিভাগের অধ্যাপক সুস্মিতা চক্রবর্তী বলেন, “সাইবার বুলিংয়ের কারণে নারী নেতৃত্ব হারাচ্ছে। নারীদের এগিয়ে এসে হেনস্তার মোকাবেলা করতে হবে। সমস্যা চিহ্নিত করে সভা-সেমিনারের মাধ্যমে সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে।”

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক সোমা দেব বলেন, “পারিবারিক চাপ, রাজনীতির প্রতি অনীহা ও দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি নারীদের অংশগ্রহণ কমার বড় কারণ। শিক্ষকদের উদ্বুদ্ধকরণে এই সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।”

নাট্যকলা বিভাগের অধ্যাপক আতাউর রহমান বলেন, “ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা রাজনীতিতে কম সচেতন। বুলিং-হয়রানির সমস্যা রুচিহীন মানুষের। নারীদের ভয় না করে মোকাবেলা করে এগোতে হবে।”

জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির পরিচালক দিল সেতারা চিনু বলেন, “বুলিং-ট্যাগিং কালচারে পরিণত হয়েছে। নির্যাতন প্রতিরোধ ও সাইবার সেল সক্রিয় করতে হবে। নিরাপদ পরিবেশ ও নিয়মিত নির্বাচন নারীদের অংশগ্রহণ বাড়াবে।”

নারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে প্রতিকার

নারী প্রার্থী ও শিক্ষকরা সাইবার বুলিং মোকাবেলায় কঠোর পদক্ষেপ, নিরাপদ ক্যাম্পাস পরিবেশ, নিয়মিত নির্বাচন, সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের যুগপৎ উদ্যোগের ওপর জোর দিয়েছেন। সাইবার সেলকে কার্যকর করা, হেনস্তাকারীদের শাস্তি নিশ্চিত করা এবং সামাজিক মানসিকতার পরিবর্তন নারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।

রাকসু নির্বাচনের ফলাফল ও নারী প্রার্থীদের অংশগ্রহণ নিয়ে ক্যাম্পাসে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের পদক্ষেপ কীভাবে এই সংকট মোকাবেলা করে, তা নির্ধারণ করবে ভবিষ্যতে নারী নেতৃত্বের সম্ভাবনা।