Image description

গত ১৯ জানুয়ারি ছিল প্রয়াত জিয়াউর রহমানের ৮৯তম জন্মবার্ষিকী। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের ৮ম রাষ্ট্রপতি। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে বিপথগামী একদল সেনাসদস্যের হাতে তিনি নির্মমভাবে নিহত হন। স্বাধীনতাযুদ্ধ, সেনাবাহিনী ও রাজনীতির এক বহুমুখী চরিত্রের নাম জিয়াউর রহমান। সবার আগে জিয়াউর রহমান একজন মুক্তিযোদ্ধা। দেশের মানুষের কাছে জিয়াউর রহমানের প্রথম পরিচয় ঘটে ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ, স্বাধীন বাংলাদেশ বেতারের ঘোষণার মাধ্যমে। ২০০৪ সালে বিবিসি’র এক জরিপে সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে তার নাম ১৯ নম্বরে উঠে আসে। তবে তারেক রহমান কি পারবেন বাবার মতো হতে।

পরিবার-পরিজনের নিরাপত্তাকে তুচ্ছ জ্ঞান করে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতেই তিনি বিদ্রোহ করেন এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন। সন্দেহ নেই, তিনি ছিলেন একজন দক্ষ সমরবিদ ও সেনানায়ক। আবার পরবর্তী সময় তিনি রাজনীতির মাঠেও কুশলতার স্বাক্ষর রেখেছেন। তার প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপিকে নিয়ে ঠাট্টা-মশকরাও করেছেন অনেকে। কিন্তু জিয়াউর রহমান টিকে গেছেন বা রাজনীতির মাঠে উতরে গেছেন তার উদ্ভাবনী চিন্তা ও দক্ষতা দিয়ে।

মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার ও জেড ফোর্সের অধিনায়ক ছিলেন শহীদ জিয়া। বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে দেশের ইতিহাসে একটি নিজস্ব অবস্থান তৈরি করেন তিনি। কৃষি ও কৃষকবান্ধব জিয়া সবুজ বিপ্লবের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে আমূল পরিবর্তন এনেছিলেন। সেসময় জিয়ার গৃহীত বিভিন্ন পরিকল্পনা ও কর্মসূচি দেশের কৃষি উন্নয়ন তথা অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করেছে। জিয়াউর রহমান প্রাকৃতিক জলাধার সৃষ্টির লক্ষ্যে সারা দেশে খাল খনন কর্মসূচি শুরু করেন। সমাজকে সংগঠিত করার এক অনন্য নজির হচ্ছে খাল খনন কর্মসূচি। আপাতদৃষ্টে এ কর্মসূচিকে শুধুই খাল খনন মনে করা হলেও এই কর্মসূচির বহুমুখী উদ্দেশ্য ছিল। কৃষিতে সেচ নিশ্চিত করা, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া ও কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করা। সারা দেশে খাল খনন করে প্রাকৃতিক জলাধার নির্মাণের কারণে ভূগর্ভস্থ পানির পরিবর্তে উপরিভাগের পানির ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়া খালগুলোতে মাছের উৎপাদনও বৃদ্ধি পায়। 

১৯৭৯ থেকে ১৯৮১ সালের মে মাস পর্যন্ত সারা দেশে দেড় হাজারের বেশি খাল খনন করা হয়। দৈর্ঘ্য প্রায় ২৬ হাজার কিলোমিটার খাল দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে খনন ও পুনঃখনন করা হয়। আর এ খাল খননের সরাসরি প্রভাব পড়েছিল কৃষিতে। এটা অপেক্ষাকৃত স্বল্পমূল্যের সেচ-সুবিধা ছিল কৃষকদের জন্য। ফলে অতিরিক্ত জ্বালানি ব্যয় বহন করতে হয়নি কৃষকদের। শুধু সেচের আওতায় বৃদ্ধি নয়, গ্রামাঞ্চলে দারিদ্র্য বিমোচন ও খাদ্য সহায়তারও পথ খুলে দিয়েছিল খাল খনন কর্মসূচি। কার্যত খাল খনন কর্মসূচি একসঙ্গে অনেক সাফল্য অর্জনের একটি পরিকল্পিত কর্মসূচি ছিল। এর অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। ‘নিন্দুকেরে বাসি আমি সবার চেয়ে ভালো’। এই কথা আমরা সবাই বলি, কাজে প্রমাণ দেখাই কজন? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষ্ঠানে জিয়াউর রহমানের সামনেই শিক্ষকরা তার প্রচণ্ড সমালোচনা করলেন। জিয়াউর রহমানের জায়গায় অন্য কেউ হলে কী হতো? সেই সমালোচকদের একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ডক্টর খন্দকার মোশাররফ হোসেন এখন বিএনপিরই একজন কাণ্ডারি।

কোনো ধরনের জামানত ছাড়াই ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক যেন সহজেই কৃষি কাজের জন্য ঋণ সুবিধা পান, সেজন্য তিনি ১৯৭৭ সালে ১০০ কোটি টাকার একটি বিশেষ কৃষিঋণ কর্মসূচি প্রণয়ন করেন, যা বাংলাদেশের কৃষিঋণ প্রবাহে নতুনমাত্রা যোগ করে এবং দেশের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। এ ছাড়া গ্রামীণ অবকাঠামোকে উন্নত করার লক্ষ্যে ১৯৭৭ সালের অক্টোবর মাসে রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশের মাধ্যমে জিয়াউর রহমান পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড প্রতিষ্ঠা করেন, যার দায়িত্ব ছিল গ্রাম অঞ্চলকে বিদ্যুৎ ব্যবস্থার আওতায় নিয়ে আসা। আর এই কর্মসূচির উদ্দেশ্য ছিল বিদ্যুৎ ব্যবহার করে সেচ সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি এবং গ্রামীণ এলাকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সম্প্রসারণের মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন বৃদ্ধি করা। যেন পল্লী এলাকার জনগণের জীবনমানের উন্নতি হয়। দেশের শিক্ষিত-অশিক্ষিত যুবসমাজ যেন উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়। 

সেজন্য রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে যুব মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা ও ১৯৮১ সালে যুব উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেন। যার মাধ্যমে দেশে আত্ম-কর্মসংস্থান সৃষ্টি, ব্যক্তিগত উদ্যোক্তা তৈরি ও বেকার সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। এ রকম অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গল্পেই ব্যক্তি জিয়াকে চেনা যায়। বাংলাদেশের অর্থনীতি জিয়ার পরিকল্পনার ভিত্তিতেই এগিয়েছে। এই নিয়ে লিখতে গেলে আবার আরেকটা নতুন লেখা শুরু হবে। তা দুইটা উদাহরণ বলি- তার খাল-খনন এবং ফারাক্কা ব্যারাজের কথা আবারও উঠবে সামনে বর্ষায়। কত বছর হয়ে গেছে, তার প্রজেক্টের ইম্পেক্ট আজও রয়ে গেছে। বাংলাদেশের আসল সমস্যা যে জনসংখ্যা, তিনি সবার আগে চিহ্নিত করে প্রচার শুরু করেন, যা বিগত সরকার শুধু জিয়ার পরিকল্পনা বলে বাস্তবায়ন করেনি। ফলাফল তো এখন আপনারা নিজেরাই দেখছেন। এখন আসা যাক তারেক রহমানের কথায়। জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর বিএনপির কাণ্ডারি হন বেগম খালেদা জিয়া। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী। তিনি অসুস্থ হলে বিএনপির দায়িত্ব নেন ছেলে তারেক রহমান। তিনি বর্তমানে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।

গত পহেলা জুলাই থেকে কোটা সংস্কারের দাবিতে ছাত্র-ছাত্রীরা আন্দোলন করে। পরে এই আন্দোলন ধীরে ধীরে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয় এবং ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট রচনার একটা ক্ষেত্র তৈরি হয়। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার বিজয় এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর নির্বাচন নিয়ে নানা গুঞ্জন শুরু হয়। নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ধোঁয়াশার মধ্যে থাকলেও অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন মহল মোটামুটি নিশ্চিত করেছেন যে, ২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুনের মাঝামাঝি কোনো একটা সময়ে হয়তো বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। সে ক্ষেত্রে বর্তমান সরকার হয়তো আর ১২ থেকে ১৮ মাস রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকবেন। এরপরই আমরা ভোটের মাধ্যমে রাজনৈতিক সরকার হয়তো দেখতে পাব।

বর্তমানে বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক বাস্তবতা, তাতে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বেশির ভাগই মনে করছেন, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি হয়তো ভবিষ্যতে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসতে যাচ্ছে।

বিএনপি এই মুহূর্তে নিজেদের সংগঠিত করার চেষ্টা করছে। ৩১ দফা নিয়ে জেলায় জেলায় আলোচনা সভার আয়োজন করা হচ্ছে। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান অনলাইনে এসব সভায় উপস্থিত হয়ে সরাসরি বক্তব্য দিচ্ছেন। তার বক্তব্য গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায়, তিনি পরিবর্তনের পক্ষে।

তারেক রহমান নিয়মিত তার নেতাকর্মীদের বলছেন, যদি ভোটে বিএনপি জয়ী হয়, তাহলে তারা ক্ষমতায় যাবেন না; বরং দায়িত্ব পাবেন। সেই দায়িত্ব যাতে সঠিকভাবে পালন করা যায়, এ জন্য তিনি তার নেতাকর্মীদের বিভিন্ন উপদেশ দিচ্ছেন। এই যেমন তাদের আচার-আচরণ, কথাবার্তা যেন মার্জিত হন; তারা যেন কোনো অপকর্মে লিপ্ত না হন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বাস্তবে কি এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে? কে শোনে কার কথা? বাস্তবতা হলো, দেশের বিভিন্ন স্থানে বিএনপির নেতাকর্মীরা চাঁদাবাজি করছেন অনেকটা প্রকাশ্যে। বিভিন্ন সময়ে তা প্রিন্ট মিডিয়া কিংবা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পারছে দেশের সাধারণ মানুষ। কারা চাঁদাবাজি করছে এ নিয়ে হয়তো তর্ক হতে পারে। বিএনপির কিছু নেতাকর্মী কিংবা বিএনপির নাম ভাঙিয়ে অনেকে চাঁদাবাজি করছে। তারেক রহমানের উচিত হবে এখনই এসব বন্ধ করার উদ্যোগ নেয়া।

এত বড় একটা বিপ্লবের পর দেশের নাগরিকরা কিন্তু পরবর্তী রাজনৈতিক সরকারের কাছে গতানুগতিক রাজনৈতিক আচরণ প্রত্যাশা করছে না। সে ক্ষেত্রে বিএনপিকে অনেক সতর্ক হতে হবে। তারা দল হিসেবে নিজেদের কোন পথে পরিচালিত করবে, সেটা তাদের নির্ধারণ করতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না, ছাত্র-আন্দোলনের গণঅভ্যুত্থানে এই তরুণরাই কিন্তু হাসিনার পতন ঘটিয়েছেন। এই তরুণদের জন্যই আজকে একটা স্বাভাবিক নির্বাচন হওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এই তরুণদের জন্যই বিএনপি এখন সারা দেশে নিজেদের সংগঠিত করতে পারছে। এই তরুণরাই বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার পরিবেশ তৈরি করেছেন।

মানুষ যখন দেখছে বিএনপির কোনো নেতা এখন এই তরুণদের নিয়ে প্রশ্ন করছেন, ‘ওরা কারা’ বলে বিদ্রƒপ করছে, মানুষের মনে তখন কিন্তু বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ছে। তারা ভাবতে শুরু করেছে, যারা বিএনপিকে গণতান্ত্রিক উপায়ে রাজনীতি করার ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছেন, বিএনপি যদি তাদের সঙ্গেই এমন আচরণ করে, তাহলে সাধারণ মানুষের সঙ্গে তারা কী করবে!

বিএনপি একটা বড় দল। তারেক রহমান চাইলেই কিন্তু একটা ডেটাবেজ তৈরি করতে পারেন। যেখানে যারাই চাঁদাবাজি কিংবা কোনো অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত থাকবে, তাদের নাম-ঠিকানাসহ সব তথ্য চলে আসবে। দেশের সাধারণ কোনো নাগরিক যদি কোনোভাবে বিএনপির নেতাকর্মীর দ্বারা হয়রানির শিকার হন, তখন তারা যেন নির্ভয়ে নিজেদের নাম-পরিচয় গোপন রেখে এসব তথ্য ডেটাবেজে দিতে পারেন। তাই তারেক রহমান কিংবা বিএনপির যারা বড় নেতা আছেন তাদেরকে চোখ-কান খোলা রেখেই এগিয়ে যেতে হবে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

মানবকণ্ঠ/আরএইচটি