Image description

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, ৯৬৩ হিজরিতে তথা ১৫৫৬ খ্র্রিষ্টাব্দে মুঘল সম্রাট জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ আকবর-এর সিংহাসনে আরোহণের সময় থেকে আমাদের বাংলা সন প্রবর্তিত হয়। প্রথমে ৯৬৩ হিজরিকে বাংলা সনের বয়স ৯৬৩ বছর ধরে নিয়ে তারপর প্রতি সৌর বছর অন্তর ৯৬৪, ৯৬৫, ৯৬৭- এরূপ হিসেবে গণনা করা হয়ে আসছে। সেই হিসেবে আজ থেকে শুরু হলো বাংলা ১৪৩১ সাল। প্রসঙ্গত, বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ প্রভৃতি ১২ মাসের নামের সঙ্গে রাশিচক্রের নক্ষত্রদেরও নাম জড়িয়ে রয়েছে। প্রতি মাসেই একবার করে পূর্ণিমা হয়। প্রতি মাসের পূর্ণিমার চাঁদ কোন রাশির কোন নক্ষত্রে অবস্থান করে তা দেখে সেই মাসের নামকরণ করা হয়েছে। যে মাসটিকে আমরা বৈশাখ বলি, সেই মাসে পূর্ণিমার চাঁদ বিশাখা নক্ষত্রে থাকে বিধায় মাসটির নাম হয়েছে বৈশাখ। বাংলা সালের প্রথম মাস বৈশাখ। তাই দীর্ঘদিন ধরে সমগ্র বাঙালি সমাজে বৈশাখের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ নববর্ষ উৎসব হিসেবে উদ্যাপিত হয়ে আসছে।

বাংলা নববর্ষ উৎসব মূলত আবহমান বাংলার কৃষি সমাজের উৎসব। ড. মুহম্মদ এনামুল হকের পর্যবেক্ষণ থেকে দেখা যায়- ...পৃথিবীর সভ্য-অর্ধসভ্য সমস্ত জাতি এক আনন্দময় পরিবেশে নববর্ষ পালন করতেন এবং এখনও করেন। নেচে, গেয়ে, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে পানাহারে মেতে, আত্মীয়-পরিজনের সাথে মিলিত হয়ে, স্থানে স্থানে আড্ডা দিয়ে হই-হুল্লুড় করে নববর্ষের বাঞ্ছিত উৎসবের পরিবেশ সৃষ্টি করা হতো এবং এখন পর্যন্ত তা হচ্ছে। বাংলা নববর্ষ সচরাচর পহেলা বৈশাখে প্রতিপালিত হলেও এটি বৈশাখ মাসব্যাপী পালনীয় উৎসব। বাংলা নববর্ষের কিছু উল্লেখযোগ্য অনুষঙ্গ রয়েছে। সেসব অনুষঙ্গ এবং বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের বহুমাত্রিকতা এখানে উল্লেখ করা হলো: 

আমানি: নববর্ষের একটি অনুষঙ্গ ‘আমানি’ (আমপানীয়) খাওয়া। প্রধানত উত্তরবঙ্গের গৃহিণীরা চৈত্রসংক্রান্তির দিন সন্ধ্যায় অথবা রাতে এক হাঁড়ি পানিতে স্বল্প পরিমাণ অপক্ব বা অর্ধসিদ্ধ চাল ছেড়ে দিয়ে তার মধ্যে একটি কচি আমের ডাল বসিয়ে রাখেন। পহেলা বৈশাখের ভোরবেলায় সূর্যোদয়ের আগে ঘুম থেকে উঠে তারা ভেজা চাল গৃহের সকলকে খেতে দেন। ঘরের সবাই মিলে একে একে তা খেতে থাকে; আর হাঁড়িতে ডোবা ডালের পাতা দিয়ে গৃহিণীরা সকলের গায়ে পানি ছিটাতে থাকেন। তাদের ধারণা, এতে করে গৃহে নতুন বছরের শান্তি নেমে আসবে এবং ফসলের কোনো ক্ষতি হবে না। যদ্দুর জানা যায়, আমানিই বাংলা নববর্ষের প্রথম ও প্রাচীন অনুষ্ঠান।

পুণ্যাহ: পুণ্যাহ অর্থ কোনো পুণ্য কাজ শুরু করার জন্যে জ্যোতিষশাস্ত্র অনুমোদিত প্রশস্ত দিন। বাংলায় এর অর্থ দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো- জমিদার কর্তৃক প্রজাদের কাছ থেকে নতুন বছরের খাজনা আদায়ের প্রারম্ভিক অনুষ্ঠানসূচক দিন। এই দিনে প্রজারা ভালো কাপড়চোপড় পরে জমিদার-তালুকদারদের বাড়িতে খাজনা দিতে আসতেন। কোথাও কোথাও জমিদার-তালুকদারেরা পান-সুপারি অথবা মিষ্টিমুখ করিয়ে আপ্যায়ন করতেন। মুহম্মদ এনামুল হকের লেখায় উল্লেখ পাওয়া যায় যে, ১৯২০ সাল পর্যন্ত পহেলা বৈশাখে পুণ্যাহ অনুষ্ঠিত হতো।

গরুর দৌড়: মুহম্মদ এনামুল হকের মতে ‘গরুর দৌড়’ নববর্ষের স্থানীয় অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম। অনুষ্ঠানটি এখন একরকম লোপ পেতে বসেছে। তৎকালীন ঢাকা জেলার মুন্সীগঞ্জ মহকুমা ও তার সন্নিহিত অঞ্চলের গ্রামে-গ্রামে পহেলা বৈশাখে এই অনুষ্ঠান সমারোহসহকারে উদ্যাপিত হতো। যে সমস্ত জায়গায় গরুর দৌড় হতো, সেসব এলাকায় ছোটখাট মেলাও বসতো। এদিন সঙ্গতিসম্পন্ন গৃহস্থেরা তাদের হালের গরুর গায়ে রঙের ছোপ দিয়ে, গলায় কড়ির মালা পরিয়ে সাজাতেন এবং গরুগুলোকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিযোগিতায় যোগ দিতেন। যাদের গরু এই প্রতিযোগিতায় জিততো, গর্বে তাদের বুক ফুলে উঠতো এবং তারা আনন্দে মেতে উঠতেন।

হালখাতা: পহেলা বৈশাখে হালখাতা অনুষ্ঠানটি হাটে-বাজারে-গঞ্জে দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত প্রতিপালিত হয়। এটি সাধারণত ব্যবসা-বাণিজ্যের সাংবাৎসরিক হিসাব রাখা এবং মেলানোর প্রয়োজনে   ব্যবসায়ী ও দোকানদারগণ আয়োজন করেন। এখানে বাকিতে কিছু কেনার টাকা পরিশোধের প্রচলন ছিলো। আমাদের ছোটবেলায় দর্জির দোকানে শার্ট কিংবা পায়জামা বানানোর সময় বাবাকে এক/দেড় টাকা বাকি রাখার বায়না ধরতাম- যাতে হালখাতা’র দিন মিষ্টি-নিমকি-বাতাসা ইত্যাদি খাওয়ার সুযোগ মেলে। বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের প্রধানত মফস্বল শহর এবং গাঁয়ে-গঞ্জের দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আজও  হালখাতার প্রচলন রয়েছে।

মেলা: মেলা নববর্ষের অন্যতম প্রধান আনন্দময় অনুষঙ্গ। দেশ জুড়ে সারা বৈশাখ মাসেই অনেক মেলা বসে এবং অধিকাংশ মেলা পহেলা বৈশাখে আয়োজিত হয়। মেলায় এসে মানুষ একে অপরের সাথে মিলিত হয়, ক্ষুদ্র মানুষ বৃহৎ হয়, সীমাবদ্ধ মানুষ সীমা ছাড়িয়ে নিজেকে অপরের মধ্যে সঞ্চারিত করে এবং অপরকে নিজের মধ্যে ঠাঁই দেয়। মানুষের মেলার আনন্দ নির্মল ও নিঃস্বার্থপরতার আনন্দ। মেলার সঙ্গে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কৃষ্টি ও সংস্কৃতির যোগাযোগ নিবিড়। বাঙালির এই উৎসবে ফুঠে ওঠে সকল ধর্মের সকল শ্রেণির মানুষের সংস্কৃতির সমন্বয়। কয়েকটি গ্রামের সংযোগস্থলে, নদী তীরে বা কোনো খোলা মাঠে মেলার আয়োজন করা হয়। মেলাকে ঘিরে গ্রামীণ জীবনে সকলের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য আসে। গ্রামের মেলায় যাত্রা, পুতুল নাচ, নাগরদোলা, জারি-সারি, রামায়ণপাঠ, পুঁথিপাঠ, গম্ভীরা, কীর্তন, পালাগানের আসর, ষাঁড়ের লড়াই, মোরগের লড়াই, লাঠিখেলা, হাডুডু খেলা ইত্যাদি নানাবিধ আয়োজন আগত দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে। এখনও নাগরদোলা সব বয়সীদের কাছে প্রধান আকর্ষণ। মেলায় নাটক বা যাত্রাপালারও আয়োজন করা হয়। গ্রামীণ মৃৎশিল্প ও কারুপণ্যের বিকিকিনি মেলার আরেক আকর্ষণ। এসব মৃৎশিল্পের মধ্যে শখের হাঁড়ি এবং বিভিন্ন ধরনের মাটির পুতুল বেশ জনপ্রিয়।

মঙ্গল শোভাযাত্রা: আজকের দিনে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ হয়ে উঠেছে নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ উদ্যাপনের প্রধান আনন্দময় অনুষঙ্গ। ১৯৮০-এর দশকের শেষ ভাগে স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ঐক্য এবং একই সঙ্গে শান্তির বিজয় ও অপশক্তির অবসান কামনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে ১৯৮৯ খ্র্রিষ্টাব্দে সর্বপ্রথম সর্বস্তরের জনসমাজের অংশগ্রহণে আনন্দ শোভাযাত্রার প্রবর্তন হয়। উল্লেখ্য যে, ১৯৬৬ সালে তৎকালীন ছাত্রনেত্রী বাংলার অগ্নিকন্যাখ্যাত মতিয়া চৌধুরীর (বর্তমানে জাতীয় সংসদের উপনেতা) নেতৃত্বে ছাত্র ইউনিয়ন ঢাকায় এবং ১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি যশোরের চারুপীঠ বাংলা বর্ষবরণ উপলক্ষে সীমিত পরিসরে বৈশাখী শোভাযাত্রার আয়োজন করেছিলো বলে জানা যায়।
 
১৯৯৬ সাল থেকে সূচিত এই আনন্দ শোভাযাত্রা নতুন রূপে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামে প্রতি বছর বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনে আয়োজিত একটি অনন্য বর্ষবরণ উৎসবে পরিণত হয়েছে। ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ এখন বাংলাদেশের নবতর সর্বজনীন সাংস্কৃতিক এবং প্রধান ধর্মনিরপেক্ষ উৎসব হিসেবে বাঙালির জীবনে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এই আয়োজনে হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান, আদিবাসী এবং দেশি-বিদেশি সর্বস্তরের ও সকল শ্রেণির নারী-পুরুষ-শিশু সকলেই বাদ্য-বাজনার তালে তালে নেচে-গেয়ে মাতোয়ারা হয়ে অংশগ্রহণ করে থাকে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীদের আয়োজনে প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সহযোগিতায় প্রতি বছরই পহেলা বৈশাখে ঢাকা শহরের শাহবাগ-রমনা এলাকায় এই মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। শোভাযাত্রায় বিভিন্ন ধরনের প্রতীকী শিল্পকর্ম বহন করা হয়। এসবের মধ্যে বাঙালি সংস্কৃতির পরিচয়বাহী নানা প্রতীকী উপকরণ, বিভিন্ন রঙের মুখোশ ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতি নিয়ে হাজার হাজার মানুষ মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করে। শোভাযাত্রার অন্যতম আকর্ষণ হলো বিশালকায় চারুকর্ম হিসেবে বাঘ, হাতি, কুমীর, ঘোড়া, ময়ূর, লক্ষ্মীপেঁচা, মাছ, পুতুলসহ নানা রঙের  ও আকারের বিচিত্র মুখোশ এবং সাজসজ্জা, বাদ্যযন্ত্র, নৃত্য ইত্যাদি। এসবই শক্তি ও শান্তির আবাহন এবং অশুভকে দূরে তাড়ানোর প্রতীক।
 
আনন্দের কথা এই যে, বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবক্রমে ২০১৬ সালের ৩০শে নভেম্বর বাংলাদেশের ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ জাতিসংঘের সংস্থা ইউনেস্কোর মানবতার অধরা বা অস্পর্শনীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান লাভ করে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার ফলেই সেটি সম্ভব হয়েছিলো। উল্লেখ্য, ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’র স্থান লাভ উপলক্ষে বাংলাদেশকে একটি সনদপত্র প্রদান করা হয়। সেই সনদপত্রে এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সুরক্ষা দেয়ার ধারা (ঈড়হাবহঃরড়হ ভড়ৎ ঃযব ঝধভবমঁধৎফরহম ড়ভ ঃযব ওহঃধহমরনষব ঈঁষঃঁৎধষ ঐবৎরঃধমব) যুক্ত রয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সরকার পহেলা বৈশাখকে সরকারি ছুটি ঘোষণা করে এবং জাতীয় বেতন স্কেলের আওতাভুক্ত সকল সামরিক/বেসামরিক কর্মচারীর জন্য ‘বাংলা নববর্ষ ভাতা’ প্রবর্তনের মাধ্যমে ইউনেস্কোর কনভেনশন অনুযায়ী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সুরক্ষা দান করেছে। বাঙালি সংস্কৃতির অনুরাগী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিক উদ্যোগের ফলেই জাতীয়ভাবে সকলের জন্যে পহেলা বৈশাখ উদ্যাপনের এমন সুন্দর ও সুদৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হয়েছে।  জানা যায়, ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হয়ে এ কে ফজলুল হক বাংলা নববর্ষের দিনটিকে ছুটি ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু, ৫৬ দিনের মাথায় পাকিস্তান সরকার ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের ৯২-ক ধারা জারি করে যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দেয়ার পর তা আর কার্যকর থাকেনি।

ছায়ানটের বর্ষবরণ: বাংলা নতুন বছরকে আবাহন করে রমনা পার্কের লেক সংলগ্ন বটমূলে ছায়ানটের সংগীতানুষ্ঠান পহেলা বৈশাখের অন্যতম সাংস্কৃতিক আকর্ষণ। ১৯৬১ সালে এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলা ১৩৭১ সালের (ইংরেজি ১৯৬৪ সাল) পহেলা বৈশাখ রমনার বটমূলে ছায়ানট বাংলা নববর্ষ পালন শুরু করে। কালক্রমে এই নববর্ষ পালন জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়। আমরা ছাত্র জীবন থেকে এই বর্ষবরণ উৎসব দেখে এসেছি। সূর্যোদয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই উৎসব আরম্ভ হয়। প্রথম থেকে রবীন্দ্রসংগীত ছিলো এই অনুষ্ঠানের প্রধান পাথেয়। বর্তমানে রবীন্দ্রসংগীতের সঙ্গে পঞ্চকবির গান ও লালনগীতিসহ জনপ্রিয় লোকসংগীতে মেতে ওঠে পহেলা বৈশাখের এই উৎসব। এছাড়া কবিতা আবৃত্তিও হয়। বাঙালির উচ্চমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্যোগে এবং অংশগ্রহণে এই বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন শুরু হলেও এখন সকল শ্রেণি-পেশার মানুষই এই উৎসবে অংশগ্রহণ করে। এছাড়াও ছায়ানট ২৫শে বৈশাখ, ২২শে শ্রাবণ, শারদোৎসব ও বসন্তোৎসব গুরুত্ব সহকারে আয়োজন করে। এই সবই অসাম্প্রদায়িক উৎসব। উল্লেখ্য, সন্জীদা খাতুন, ওয়াহিদুল হক প্রমুখের উদ্যোগে ছায়ানটের বর্ষবরণ বাঙালি সমাজের এক অগ্রণী সাংস্কৃতিক আন্দোলন হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে।

ঋষিজ শিল্পী গোষ্ঠীর বর্ষবরণ: বরেণ্য গণসংগীতশিল্পী একাত্তরের কণ্ঠযোদ্ধা ফকির আলমগীর এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা ও গীতিকার আলতাফ আলী হাসু মিলে ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন গণসংগীতের দল ঋষিজ শিল্পী গোষ্ঠী। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শোষণ, দুঃশাসন ও বৈরী প্রকৃতির বিরুদ্ধে গণমানুষের সংগ্রামকে পাথেয় করে গড়ে ওঠে এই প্রতিষ্ঠান। প্রায় অর্ধ শতাব্দিকাল ধরে মহান শিল্পী ফকির আলমগীরের নেতৃত্বে এগিয়ে যায় প্রতিষ্ঠানটি। ২০২১ সালে ফকির আলমগীরের প্রয়াণের পর এখন সংগঠনের হাল ধরেছেন তারই অনুজ ও প্রতিষ্ঠাকালীন সংগঠক-সংগীতশিল্পী ফকির সিরাজ এবং জীবনসঙ্গিনী সুরাইয়া আলমগীর।

ঋষিজ শিল্পী গোষ্ঠীর যাত্রা শুরু হয়েছিলো দেশীয় সংস্কৃতির লালন ও চর্চার মূল অঙ্গীকার নিয়ে। সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৩ (বাংলা ১৩৯০) সাল থেকে ভাসানী সড়কে শিশুপার্কের সামনে ‘নব আনন্দে জাগো’  মর্মবাণী বা স্লোগানকে ধারণ করে প্রতি বছর বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে চলেছে ঋষিজ। কবীর চৌধুরীর মতে- কৃষি সমাজের শীতকালীন নির্জীবতার পর নবজীবনের আবির্ভাবের ধারণার সঙ্গে বাংলা নববর্ষ উদ্্যাপনের বিষয়টি সম্পর্কিত ছিলো, একথা ভাবা অসঙ্গত নয়। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, ছায়ানটের পরেই স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় যুক্ত হয় ঋষিজের অনুষ্ঠান। নৃত্যের  নান্দনিকতা, সংগীতের মোহময়তা আর কবিতার মধুর ছন্দে সমৃদ্ধ বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় ঋদ্ধ এই বর্ষবরণের আয়োজন। সকল ধর্মের, সকল শ্রেণির, এবং সকল পেশার শত শত মানুষ সমবেত হয়ে একাত্ম হন পহেলা বৈশাখের এই প্রাণের উৎসবে।

সুরের ধারার বর্ষবরণ: ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত গানের স্কুল সুরের ধারা প্রথমে ঘরোয়াভাবে বাংলা নববর্ষ পালন আরম্ভ করে। পরে, ২০১২ সাল থেকে দেশের বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী রিজওয়ানা চৌধুরী বন্যার তত্ত্বাবধানে সুরের ধারা সারা দেশের হাজার সংগীতশিল্পীর অংশগ্রহণে ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে চলেছে। শুরুতে সমাজের গণ্য-মান্য ব্যক্তিবর্গ ও রবীন্দ্রসংগীতের অনুরাগীরা আমন্ত্রিত হয়ে সুরের ধারার বর্ষবরণ অনুষ্ঠান উপভোগ করতেন। এখন সুরের ধারার পহেলা বৈশাখের এই নববর্ষ উৎসব সকলের জন্যে উম্মুক্ত। বলা বাহুল্য, ২০১২ সালে চ্যানেল আই সুরের ধারার বর্ষবরণ অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো।

প্রবাসে পহেলা বৈশাখ: বিশেষভাবে বলা আবশ্যক যে, ২০১৭ সাল থেকে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন পরিষদের উদ্যোগে কলকাতায় প্রতি বছর মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। কলকাতার গাঙ্গুলি বাগান থেকে শুরু হয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অদূরে বিদ্যাপীঠ ময়দানে গিয়ে শেষ হয় এই মঙ্গল শোভাযাত্রা। পশ্চিমবঙ্গে আরও কয়েকটি মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজন হয়। এসব শোভাযাত্রায় দুই বাংলার শিল্পীদের আঁকা নানান লোকজ চিত্রকর্ম, পুতুল প্রভৃতি বহন করা হয়। এছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী প্রধানত বাংলাদেশের বাঙালি জনগোষ্ঠীর উদ্যোগে কোথাও ছোটো আবার কোথাও বড় পরিসরে পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের আয়োজন বেড়েই চলছে। এবছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে কবিতা, গান, লোকজ মেলা, বাংলাখাবার ইত্যাদির সমাহারে পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের বিশাল আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে। উত্তর আমেরিকায় বসবাসরত বাঙালিরা নিশ্চয়ই তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে এবার নিউইয়র্কের এই নববর্ষের উৎসবে মেতে উঠবেন।

পহেলা বৈশাখ সকলের উৎসব। বাংলাদেশের সকল স্তরের মানুষের জন্যে এই নববর্ষ উৎসবটি ধর্ম নিরপেক্ষ উৎসব। পহেলা বৈশাখে আয়োজিত বাঙালির নববর্ষের উৎসবে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র এবং অনেকাংশে রাজনৈতিক বিশ্বাস নির্বিশেষে সকলেই উদার ও আনন্দিত চিত্তে অংশগ্রহণ করেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু  শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আমরা ধর্ম নিরপেক্ষতা বা অসাম্প্রদায়িক চেতনার ভিত্তিতে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্জন করেছি। পহেলা বৈশাখের নববর্ষ উদ্যাপন সেই চেতনা ও ঐতিহ্যের অন্যতম প্রধান ধারক-বাহক। উল্লেখ্য, সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর থেকে প্রায় আড়াই দশক ধরে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করে বাঙালির আবহমান সংস্কৃতির ওপর ভয়াবহ আঘাত হানে। সংস্কৃতি ক্ষেত্রে সেসব আঘাতের অন্যতম একটি জবাব হলো ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’র আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন এবং জাতীয়ভাবে সাড়ম্বরে পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন। এখন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সারা দেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন করে বাঙালি সংস্কৃতির জয়যাত্রা অব্যাহত রেখেছে। প্রতিটি আয়োজনে সমস্বরে ধ্বনি ওঠে- ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’।  

লেখক পরিচিতি: ড. মুহাম্মদ সামাদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাই চ্যান্সেলর ও জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি