Image description

মিয়ানমারে অব্যাহত দাঙ্গা এ অঞ্চলের জন্য হুমকি। তাদের মধ্যে গোষ্ঠীগত হামলা প্রতিরোধ এই সবের পেছনে শাসকগোষ্ঠী এবং সে দেশের নাগরিকদের মধ্যে পারস্পরিক ক্ষমতার দ্ব›দ্ব আছে। জাতিগত ধর্ম-বর্ণ সংস্কৃতি ক্ষমতার নানা বিষয় নিয়ে মিয়ানমারের জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিভাজন তৈরি হয়েছে। রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর মিয়ানমারের সেনা সরকার চরমভাবে দমন নিপীড়ন নির্যাতন হত্যা দর্শনসহ অমানবিক নির্যাতন চালিয়েছে। তাদেরকে ভিটাবাড়ি থেকে বিতাড়িত করেছে। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। সেনাশাসক তাদেরকে নির্যাতনের মাধ্যমে বাংলাদেশে পুশব্যাক করেছে। বাংলাদেশ সরকার ও দেশের জনগণ সম্পূর্ণভাবে মানবিক কারণে তাদেরকে আশ্রয় দিয়েছে।

ব্রিটিশদের থেকে স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৪৮ সাল থেকে পরবর্তী ১০ বছর অং সানের নেতৃত্বাধীন অ্যান্টি-ফ্যাসিস্ট পিপলস ফ্রিডম লিগ (এএফপিএফএল) মিয়ানমারের শাসন ক্ষমতায় ছিল। ১৯৫৮ সালে এএফপিএফএল-এ ভাঙন হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। ১৯৬২ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে দেশটির সামরিক বাহিনী।

১৯৯০ সালে মিয়ানমারের নির্বাচনে অং সান সু চির দল ‘ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি’ বা এনএলডি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও সেনাবাহিনী ওই ফল বাতিল করে দেয়। এরপর দেশটি ফের সামরিক জান্তার হাতে চলে যায়। বিরোধীদের আন্দোলন ও আন্তর্জাতিক চাপ-নিষেধাজ্ঞাও সেনাশাসককে টলাতে পারেনি।

বর্তমান সংকটের শুরু ২০২০ সালে অং সান সু চির ক্ষমতা গ্রহণের মাধ্যমে। সু চি ক্ষমতা গ্রহণের পর তার সরকার ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার যে সংবিধান প্রণয়ন করে সেনাবাহিনী তা পছন্দ করেনি। তখন থেকেই তারা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। ২০২১ সালে সুযোগ বুঝে তারা সু চিকে ক্ষমতাচ্যুত ও কারাগারে আটক করে।

মিয়ানমারের বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীকে আস্থায় নিয়ে একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার অঙ্গীকার নিয়ে ক্ষমতায় এলেও সে পথে হাটেননি সু চিও। তিনিও সেনাবাহিনীর সঙ্গে নানাভাবে বোঝাপড়া করে ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছিলেন। মিয়ানমারের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী নিপীড়ন ও নিধনে তিনিও সামিল হয়েছেন।

গত তিন বছরে রাজনৈতিক ও জাতিগত সংঘাত এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে দেশটির ২৬ লাখ মানুষ অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিকভাবে শরণার্থী হতে বাধ্য হয়েছে। এর অর্ধেক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এ সময়ে মিয়ানমারের অর্থনীতিতেও ধস নেমেছে। জ্বালানির দাম প্রায় চারগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যান্য পণ্যের দামও লাগামহীন। গৃহযুদ্ধ অনিবার্য হয়েছে।

২০২১ সালে ক্ষমতাচ্যুত এনএলডির নেতৃত্বে নির্বাচনে জয়ী সদস্যরা জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠন করে, যাকে সংক্ষেপে এনইউজি বলা হয়। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সদস্যরাও এতে যোগ দেয়। সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে থাকা বিদ্রোহী বাহিনীর সঙ্গে মিলে তারা প্রশিক্ষণ নেয়া শুরু করে এবং সব গোষ্ঠীর সমন্বয়ে ‘পিপল ডিফেন্স ফোর্স’ গঠন করে।
সামরিক বাহিনীর দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ নতুন মাত্রা পায় উত্তরাঞ্চলের তিনটি বিদ্রোহী বাহিনী এক হয়ে আক্রমণ শুরুর পর।

২০২৩-এর অক্টোবরে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ওপর একজোট হয়ে সুসংগঠিতভাবে হামলা চালায় দেশটির উত্তরের শান রাজ্যের জাতিগতভাবে সংখ্যালঘু তিনটি বিদ্রোহী বাহিনী, যাদের একসঙ্গে ডাকা হচ্ছে ‘থ্রি গ্রুপ অ্যালায়েন্স’ নামে। ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ), তায়াং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ) এবং আরাকান আর্মি (এএ) নিয়ে এই জোট গঠন করা হয়েছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী হচ্ছে আরাকান আর্মি (এএ)। যাদের সবকিছু নিয়মিত সেনাবাহিনীর আদলে গড়ে তোলা। এ গ্রুপগুলো দেশটির পশ্চিম-উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে সশস্ত্র সংগ্রাম করছে।

এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধে লিপ্ত গ্রুপগুলো মিয়ানমারের বিভক্তির পক্ষে নয়। তাদের দাবি আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও দেশটিকে একটি ফেডারেল রাষ্ট্রে পরিণত করা। যে দাবি তারা ১৯৪৮ সাল থেকে করে আসছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ হচ্ছে চরম ভুক্তভোগী। এখানেই সন্ধান করতে হবে সংকট থেকে বেরিয়ে আসার পথ। কারও ওপর নির্ভরশীল না হয়ে নিজস্ব কSটনীতি-কৌশল দিয়ে স্বার্থ উদ্ধার ও সংকটমুক্ত হয়ে বিপদ কাটাতে হবে। এখানেই বর্তমান নেতৃত্বের দক্ষতা ও দূরদর্শিতা প্রদর্শনের একটি বড় পরীক্ষা। বিশেষত ৪ জানুয়ারি ১৯৪৮ সালে যুক্তরাজ্য থেকে মায়ানমারের স্বাধীনতার পর তার দেশে দুটি দল ছিল। একটি কমিউনিস্ট পার্টি আরেকটি ন্যাশনাল ইউনিয়ন। স্বাধীনতার পর প্রাথমিকভাবে এলাকাটি শান্ত ছিল। তাদের মধ্যে এলাকাভিত্তিক স্বার্থ ও আধিপত্য ক্ষমতার দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকে।

পরপর তিনটি সংসদীয় সরকার মিয়ানমারকে শাসন করে। ক্ষমতার লোভে সেনাবাহিনী ১৯৬২ সালে ২ মার্চ সেনা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে। পরবর্তীতে সে দেশে চরমভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন শুরু হয়। জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর রাজনৈতিক নেতাদের উপর জুলুম নির্যাতন চলে। গ্রেপ্তারদের বিনা বিচারে বন্দি করে রাখা হয়। তাদের মধ্যে শান্তি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য দ্বিপাক্ষিক আলোচনা হরেও ফলপ্রসূ কোনো রেজাল্ট আর আনতে পারেনি। আদর্শগত, চরিত্রগত নেতৃত্ব ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই সব চরিত্র ক্ষমতার মোহ সবগুলো দলের মধ্যেই দানা বাধে। তাদের মধ্যে অন্য কোনো দল পারস্পরিক আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। জাতিগত দাঙ্গায় এ পর্যন্ত ২৫ লাখের অধিক মানুষ বস্তুচ্যুত হয়েছে। জাতিগত দাঙ্গা ক্রমেই বাড়ছে। পারস্পরিক মিলমিশ সমঝোতার লক্ষণ এখনও পর্যন্ত স্পষ্ট নয়।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন, জাতিসংঘ সব বিশ্ব নেতৃবৃন্দ উৎবেগ ও উৎকণ্ঠা প্রকাশ করছে। যেহেতু বাংলাদেশের প্রতিবেশি দেশ মায়ানমার। স্বাভাবিক কারণেই মিয়ানমারের রাজনৈতিক সামাজিক অস্থিরতা বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগের কার। দুই দেশের সীমান্ত পাশাপাশি হওয়াতে মিয়ানমারের কিছু একটা হলেই তার প্রভাব বাংলাদেশে পড়ে। বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে সরকার ও দেশের জনগণের চেষ্টার ত্রুটি নেই। সেই জায়গায় মিয়ানমারের নানা জাতি উদ্ভাস্ত হয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়লে সেই স্রোতে বাংলাদেশের পক্ষে সহ্য করা মোটেও সম্ভব নয়। যেখানে রোহিঙ্গা প্রায়ই ১২ লাখের অধিক জনগণ উদ্বাস্তু হয়ে বাংলাদেশের শরণার্থী কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের পেছনে বাংলাদেশের সরকার প্রশাসন ও জনগণকে অনেক কিছু ত্যাগ করতে হচ্ছে। সেই পরিস্থিতিতে মায়ানমার যদি আরও সংকটের দিকে যায় তখন বাংলাদেশের জন্যও চিন্তার অনেক কারণ। তাদের মধ্যে গোষ্ঠীগত দাঙ্গায় দিকহীন হয়ে পড়ছে সেই দেশটির জনগণ। সে দেশের আন্তঃকোন্দল থামাতে পার্শ্ববর্তী যে সকল দেশ ও সরকার আছে তাদেরও বলিষ্ঠ ভ‚মিকা থাকা চায়।

ইতোমধ্যে মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তের স্কুল, কলেজ, হাট-বাজার বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সীমান্তের জনগণ নিরাপত্তাহীনতায় ভোগছে। বাংলাদেশের জাতীয় পত্রিকা দেশি-বিদেশি প্রচার মাধ্যমে মিয়ানমারের দাঙ্গার সংবাদ গুরুত্বের সাথে প্রচার হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার ও জনগণ চায় মিয়ানমারের রাজনৈতিক স্থিতিশীল পরিবেশ ফিরে আসুক। আন্তঃকোন্দল সহিংসতা বন্ধ করা হউক। সে দেশের জনগণের বাক স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ফিরে আসুক।

বাংলাদেশ ও এদেশের জনগণের প্রত্যাশা হলো সকল ধর্মের নাগরিকের স্বাধীনতা স্বকীয়তা সমানভাবে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সব দল পেশা ধর্ম নির্বিশেষে সবার প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মিয়ানমারের শান্তি ফিরে আসুক।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিষ্ট

মানবকণ্ঠ/এআই