২৪ মাসে ২০ উপনির্বাচন ইসির

- জাহাঙ্গীর কিরণ
- ২০ জানুয়ারি ২০২২, ১৩:০০
জাতীয় সংসদের উপনির্বাচন অনুষ্ঠানে রেকর্ড গড়েছে কে এম নুরুল হুদা নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন (ইসি)। মহামারী করোনার মধ্যেই গত ২৪ মাসে ২০টি সংসদীয় আসনে উপনির্বাচন সম্পন্ন করতে হয়েছে। এর মাধ্যমে চলমান একাদশ জাতীয় সংসদেরও আসন শূন্য হওয়ার ক্ষেত্রে রেকর্ড হয়েছে। এর আগে এতো অল্প সময়ে কোনো সংসদেই এতো সংখ্যক আসনে নতুন মুখ আসেননি।
গত বছর (২০২১) অনেকে মারা গেছেন। অল্প সময়ে এতো মৃত্যুর খবর শুনে অবেগাপ্লুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে আনা শোক প্রস্তাবের ওপর বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘আসলে জীবনটাই হয়ে গেছে এমন, কে যে কখন আছে, কে যে কখন নাই, তার কোনো হিসাবই নেই।’
সংসদ ও নির্বাচন কমিশন সংশ্লিষ্টরা এ বিষয়টিতে একদিকে মর্মাহত হয়েছেন অন্যদিকে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে মহামারীর মধ্যে এসব আসনে উপনির্বাচন করতে গিয়ে পোহাতে হয়েছে অনেক ঝক্কি-ঝামেলা। প্রচার-প্রচারণার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়টিতে নজর দিতে হয়েছে আবার ভোটগ্রহণের দায়িত্বে থাকা নির্বাচন কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের জন্য গুনতে হয়েছে অতিরিক্ত অর্থও।
তথ্যানুযায়ী, একাদশ জাতীয় সংসদ গঠনের পর প্রথম উপনির্বাচন সম্পন্ন করতে হয়েছে রংপুর-৩ আসনে। জাতীয় পার্টির সাবেক চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুতে শূন্য হওয়া এই আসনটিতে ২০১৯ সালের ৫ অক্টোবর নির্বাচন সম্পন্ন করে ইসি। তবে ২০১৯ সালে মারা যাওয়া অপর সংসদ সদস্যদের আসনে উপনির্বাচন সম্পন্ন হয় ২০২০ সালে।
২০১৯ সালের ৭ নভেম্বর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সংসদ সদস্য মঈন উদ্দীন খান বাদলের মৃত্যুতে শূন্য হয় চট্টগ্রাম-৮ আসনটি। পরে ২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারি উপনির্বাচন সম্পন্ন করে ইসি। একই বছরে (২৭ ডিসেম্বর) ইউনূস আলী সরকার মারা যাওয়ায় শূন্য হওয়া গাইবান্ধা-৩ আসনে উপনির্বাচন হয় পরের বছর ২৭ জানুয়ারি। আর সর্বশেষ উপনির্বাচন হয় টাঙ্গাইল-৭ আসনে।
গত বছরের ১৬ নভেম্বর এই আসনে চারবারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য, সড়ক পরিবহন এবং সেতু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. একাব্বর হোসেন মারা যাওয়ায় আসনটি শূন্য হয়। চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি আসনটিতে উপনির্বাচন সম্পন্ন করে ইসি। উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব মো. হুমায়ুন কবীর খোন্দকার বলেন, উপনির্বাচনের প্রয়োজন হলে তো করতেই হবে। মৃত্যুর ওপর তো কারো হাত নেই। কেউ মারা গেলে আসন শূন্য হবে। সেখানে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সংবিধান অনুযায়ী আমাদের ভোটও করতে হবে।
চলতি একাদশ সংসদের প্রথম বছরে (২০১৯ সালে) সংসদ সদস্যদের মধ্যে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, আওয়ামী লীগের ইউনূস আলী সরকার এবং বাংলাদেশ জাসদের সংসদ সদস্য মঈন উদ্দীন খান বাদল মারা যান। ওই বছরে এরশাদের আসনে উপনির্বাচন হলেও বছরের শেষ দিকে মারা যাওয়ায় বাদল ও ইউনূস আলী সরকারের আসনে উপনির্বাচন হয়েছে ২০২০ সালে। এই সংসদের আরেক নির্বাচিত সদস্য সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম প্রথম বছরে ৩ জানুয়ারি মারা যান। তবে এমপি হিসেবে শপথ নেয়ার আগেই মারা যাওয়ায় তার আসনটিতে উপনির্বাচন না হয়ে সাধারণ নির্বাচন হয়। ওই নির্বাচনটি হয় ওই বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি। আর বিএনপি থেকে নির্বাচিত মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শপথ না নেয়ায় তার আসনটি শূন্য হয়ে যায়। পরে ওই আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
সংসদ ও নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, চলমান একাদশ জাতীয় সংসদের তিন বছরে ২০ জন সংসদ সদস্য মারা যাওয়ায় তাদের আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এদের মধ্যে তিন জন মারা গেছেন ২০১৯ সালে, ৮ জন ২০২০ সালে এবং গত বছর (২০২১) মারা যান ৯ জন। অল্প সময়ে এতো মৃত্যুর খবর শুনে অবেগাপ্লুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে আনা শোক প্রস্তাবের ওপর বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘এটা কষ্টকর। এবারের নির্বাচনের পর অনেক সদস্যকে আমরা হারিয়েছি। জানি না, এবার আমাদের সংসদের কী রকম একটা দুর্ভাগ্য। আসলে জীবনটাই হয়ে গেছে এমন, কে যে কখন আছে, কে যে কখন নাই, তার কোনো হিসাবই নেই।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ৭ নভেম্বর জাসদের সংসদ সদস্য মঈন উদ্দীন খান বাদল মারা যাওয়ায় শূন্য হওয়া চট্টগ্রাম-৮ আসনের উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় পরের বছরের ১৩ জানুয়ারি। ২৭ ডিসেম্বর ইউনূস আলী সরকার মারা যাওয়ায় শূন্য হওয়া গাইবান্ধা-৩ আসনে উপনির্বাচন হয় ২০২০ সালের ২৭ জানুয়ারি। ইউনূস আলী সরকার মারা যাওয়ার পর ২০২০ সালের জানুয়ারিতে পর পর তিনজন এমপি মারা যান। তাদের মধ্যে ৯ জানুয়ারি বাগেরহাট-৪ আসনের মো. মোজাম্মেল হোসেন, ১৮ জানুয়ারি বগুড়া-১ আসনের আবদুল মান্নান এবং ২১ জানুয়ারি যশোর-৬ আসনের ইসমাত আরা সাদেক মারা যান।
এদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে নির্বাচন করার কারণে ঢাকা-১০ আসনের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস সংসদ সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করায় তার আসনটি ২০১৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর শূন্য হয়। নির্বাচন কমিশন একইসঙ্গে তফসিল দিয়ে ২০২০ সালের ২১ মার্চ বাগেরহাট-৪ ও ঢাকা-১০ আসনের উপনির্বাচন সম্পন্ন করে। পাশাপাশি ২৯ মার্চ ভোটগ্রহণের তারিখ নির্ধারণ করে যশোর-৬ ও বগুড়া-১ আসনের উপনির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়। তবে করোনা সংক্রমণের কারণে শেষ সময়ে এসে নির্বাচন স্থগিত হয়। ২০২০ সালের ১৪ জুলাই এ দুটি আসনে ভোট হয়। এদিকে অসুস্থ হয়ে মারা যাওয়া শামসুর রহমান শরীফ ডিলুর আসন পাবনা-৪-এ উপনির্বাচন হয় ২৬ সেপ্টেম্বর, হাবিবুর রহমান মোল্লার ঢাকা-৫ আসনে উপনির্বাচন হয় ১৭ অক্টোবর ও সাহারা খাতুনের ঢাকা-১৮ আসনে উপনির্বাচন হয় ১২ নভেম্বর। করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণকারী মোহাম্মদ নাসিমের সিরাজগঞ্জ-১ আসনে গত ১২ নভেম্বর ও ইসরাফিল আলমের নওগাঁ-৬ আসনে ১৭ অক্টোবর উপনির্বাচন হয়।
গতবছর মারা যাওয়াদের মধ্যে সর্বশেষ ১৬ নভেম্বর উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় টাঙ্গাইল-৭ আসনে। ওই আসনের টানা চারবারের সংসদ সদস্য, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মো. একাব্বর হোসেন মারা যাওয়ায় আসনটি শূন্য হয়। এই বছরের ১১ মার্চ মারা যান সিলেট-৩ আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী। ৪ এপ্রিল মারা যান ঢাকা-১৪ আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আসলামুল হক। ১৪ এপ্রিল মারা যান সাবেক আইনমন্ত্রী ও কুমিল্লা-৫ আসনের সংসদ সদস্য আব্দুল মতিন খসরু। ৩০ জুলাই মারা যান কুমিল্লা-৭ আসনের সংসদ সদস্য ও সাবেক ডেপুটি স্পিকার অধ্যাপক মো. আলী আশরাফ।
২ সেপ্টেম্বর মারা যান সিরাজগঞ্জ-৬ আসনের সংসদ সদস্য হাসিবুর রহমান স্বপন এবং জাতীয় পার্টির (জাপা) সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য অধ্যাপক মাসুদা এম রশিদ চৌধুরী মারা যান ১৩ সেপ্টেম্বর। যে কারণে ২০২০ সালে এসব আসনে উপনির্বাচন সম্পন্ন করতে হয়েছে ইসিকে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশে নিকট অতীতে অল্প সময়ে এতো উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনো রেকর্ড নেই। অবশ্য অতীতে যখন এক ব্যক্তির একইসঙ্গে পাঁচটি সংসদীয় আসনে নির্বাচন করার সুযোগ ছিল, ওই সময় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতারা জাতীয় নির্বাচনে একাধিক আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেন। পরে তারা বিজয়ী হয়ে আইন অনুযায়ী একটি আসন রেখে দিয়ে অন্যগুলো ছেড়ে দিতেন। পরে সেখানেও অনুষ্ঠিত হয়েছে উপনির্বাচন। এ কারণে নির্বাচনের পর পরই একইসঙ্গে বেশ কয়েকটি আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হতো।


