

জ্বালানি সাশ্রয়ী অর্থনীতি ও গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানোর বৈশ্বিক প্রবণতার অনুসরণে বাংলাদেশও প্রবেশ করতে যাচ্ছে বিদ্যুৎ চালিত গাড়ির (ইভি) যুগে। আগামী অক্টোবর-নভেম্বরেই ঢাকার রাস্তায় নামবে ১০০ বৈদ্যুতিক গাড়ি। এ সুখবর গত এপ্রিলেই দিয়েছিলেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
বৈদ্যুতিক গাড়ি নামানোর বিষয়ে ২০১৫ সালের জুন মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকালে ২০০ কোটি ডলারের সমঝোতা চুক্তি হয়, যা দ্বিতীয় লাইন অব ক্রেডিট (এলওসি) নামে পরিচিত।
জানা গেছে, এই চুক্তির আওতায় বিআরটিসির জন্য ৩০০টি বৈদ্যুতিক দ্বিতল এসি বাস সংগ্রহ করা হচ্ছে। তারই প্রথম চালানের ১০০ বাস অক্টোবরে ঢাকায় আসার কথা রয়েছে। এরমধ্যে নিজস্ব বহরের জন্য ৫০টি ব্যাটারিচালিত ইলেকট্রিক বাস কেনার পরিকল্পনা নিয়েছে বিআরটিসি।
প্রসঙ্গত, ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের লক্ষ্যে সরকার ইলেক্ট্রিক ভেহিক্যাল নীতিমালা প্রণয়নের কাজ করছে। এক্ষেত্রে, নীতিগত সমর্থন ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের যৌথ প্রচেষ্টা প্রাধান্য পাচ্ছে।
এর আগে ২০২১ সালে মন্ত্রিপরিষদের সবুজ সংকেত পাওয়া অটোমোবাইল শিল্প উন্নয়ন নীতির আওতায় এ খাতের বিকাশে কর অবকাশ ও বার্ষিক প্রণোদনা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। সুবিধাগুলো পাবে, স্থানীয়ভাবে ইলেক্ট্রিক যান সংযোজক, জ্বালানি সাশ্রয়ী প্রযুক্তি উন্নয়ন ও অবকাঠামো নির্মাণে জড়িত প্রতিষ্ঠান।
প্রস্তাবিত নীতির আওতায় ২০৩০ সাল নাগাদ দেশে পরিবেশবান্ধব নিবন্ধিত গাড়ির সংখ্যা ১৫ শতাংশ করার লক্ষ্য নেয়া হয়। তবে বিদ্যুত্চালিত গণ-পরিবহন প্রতিষ্ঠায় প্রধান বাধা, অধিক শুল্ক ও চার্জিং স্টেশনের অভাব। আমদানি শুল্ক অনেক বেশি হওয়ায়, চার চাকার বৈদ্যুতিক যানের দাম বাংলাদেশের বাজারে অনেক বেশি হয়ে যায়।
এ ধরনের যানের বেসরকারি অপারেটর ও ইউএনডিপি সূত্র এসব সমস্যার কথা জানিয়েছে। জাতিসংঘের সংস্থাটি ইভির (বৈদ্যুতিক যান) প্রসারের জন্য দরকারি নীতিগত কাঠামো দৃঢ়করণ, চার্জিং স্টেশন স্থাপন ও উপযোগী সক্ষমতা তৈরির লক্ষ্যে ১ কোটি ৭৮ লাখ মার্কিন ডলার সহায়তা দানের প্রস্তাবকালে বেশকিছু প্রতিবন্ধকতার কথা তুলে ধরে জানায়, দেশের যোগাযোগ খাতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে হলে, এগুলো দূর করতে হবে।
সড়ক, পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ '২০২৬ সালের মধ্যে জ্বালানিভিত্তিক পরিবহন কাঠামোকে বৈদ্যুতিক যানবাহন গ্রহণে উপযোগীকরণ' শীর্ষক ইউএনডিপি সমর্থিত প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে।
এ ব্যাপারে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ—ইআরডির যুগ্ম-সচিব অমল কৃষ্ণ মণ্ডল বলেন, 'ইভি পরিবহন সম্প্রসারণে ইউএনডিপি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সরকারি সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করছে। এরপর তারা প্রকল্প প্রস্তাবনার খসরা নথি তৈরি করছে। এখন এ প্রকল্পটি অনুমোদন পর্যায়ে আছে। প্রকল্প প্রস্তাব অনুমোদন করবেন পরিকল্পনামন্ত্রী। তবে তার আগে ইউএনডিপির সঙ্গে সরকারের একটি অনুদান চুক্তি সই হবে।'
ইভি যুগে প্রবেশের পদক্ষেপ: রাষ্ট্রায়ত্ত পরিবহন কোম্পানি বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো গণপরিবহন ব্যবস্থায় ই-বাস চালুর উদ্যোগ নিয়ে এক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছে। বিশেষ করে ঢাকা-চট্টগ্রামের মতো দূরপাল্লার রুটের জন্য বাসগুলো হবে ৫০ আসনবিশিষ্ট। ব্যাটারি রিচার্জের ব্যবস্থা হবে দুটি— যাত্রাপথে এবং রাত্রে বাস ডিপোতে অবস্থানকালে। বেশ কয়েকটি বেসরকারি সংস্থারও ইভি গাড়ি তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে।
বাংলাদেশ অটো ইন্ডাস্ট্রিজ (বেইল) নামের একটি স্থানীয় অটোমোবাইল কোম্পানি এ ব্যাপারে টয়োটার সঙ্গে কাজ করছে, তারা প্রাথমিকভাবে ২০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করে দেশে বৈদ্যুতিক যানবাহন উত্পাদন করতে চায়। লিথিয়াম ব্যাটারি, মোটর, কন্ট্রোলার, সফটওয়্যার প্লাটফর্ম, চেসিস ও বডিসহ ইভি যানের ৬০ শতাংশই দেশে উত্পাদনের লক্ষ্য রয়েছে কোম্পানিটির। তাদের উত্পাদিত ইভি কার দেশের বাজারে বিক্রি হবে ১২-১৫ লাখ টাকায়। আর নিটল মটরস এর প্রতি গাড়ি বিক্রি হবে ১০-১২ লাখ টাকায়। কারের ব্যাটারি সক্ষমতা হবে পারে ৫০ কিলোওয়াট আওয়ার, যা একবার চার্জে ৪০০ কিলোমিটার পর্যন্ত চলতে পারবে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অটো ইন্ডাস্ট্রিজ (বেইল) এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর মাসুদ কবির বলেন, 'আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত, শুল্কায়নে যেন শিল্পায়ন হয়। আমরা চাই ইভির ক্ষেত্রে শুল্কায়ন বলবৎ থাকুক। এতে দেশীয় শিল্প সম্প্রসারণ হবে। আমাদের দেশে ১৭ কোটি মানুষের বড় বাজার রয়েছে। সারা বিশ্ব গাড়ির ক্ষেত্রে এখন ট্রান্সফরমেশনের দিকে যাচ্ছে। পৃথিবীতে এখন এক বিলিয়ন গাড়ি আছে। এসব গাড়ি আগামী ৩০ বছরের মধ্যে ইভিতে রূপান্তর হবে। বাংলাদেশ যদি এ সুযোগ দিতে পারে, তবে আমাদের জন্য বড় অর্জন হবে। সে কারণে শুল্কায়ন বান্ধব হওয়ার চেয়ে, শিল্পায়ন বান্ধব হলে দীর্ঘমেয়াদে দেশের অনেক উপকার হবে।'
ইভি কমায় জ্বালানি খরচ ও দূষণ: এ বছরের শুরুর দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অটোমোবাইল জায়ান্ট জেনারেল মোটরস ঘোষণা দিয়েছে, তারা ২০৩৫ সালের মধ্যে পেট্রোল ও ডিজেলচালিত গাড়ি বিক্রি বন্ধ করবে। আরেকটি বড় কোম্পানি অডি ২০৩৩ সালের মধ্যে পেট্রোল ও ডিজেলচালিত মোটরগাড়ি উত্পাদন বন্ধের পরিকল্পনা করছে। আরও অনেক গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এ রকম রোডম্যাপ হাতে নিয়েছে।
কাজেই বলা যায়, আর দু-তিন দশকের মধ্যেই বিশ্বে পেট্রোল ও ডিজেলচালিত মোটরগাড়ি অতীত হয়ে যাবে। বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যবহার বাড়ছে অকল্পনীয় দ্রুতগতিতে। ২০৩৫ সালের মধ্যেই বিশ্বজুড়ে অর্ধেক যাত্রীবাহী গাড়ি বিদ্যুত্চালিত হয়ে যাবে।
বিশ্বজুড়ে এ রূপান্তরের প্রধান কারণগুলো হচ্ছে; প্রচলিত জ্বালানির বাহনের চাইতে ইভি জ্বালানি সাশ্রয়ী। তাদের টেইলপাইপে কার্বন নিঃসরণ একেবারেই শূন্য। ২০২০ সালে বাজারে আসা টয়োটা-করোলার একটি হাইব্রিড কার প্রতি লিটার জ্বালানি ৫২ মাইল পাড়ি দিতে পারে, সে তুলনায় একই বছর বাজারে আসা প্রচলিত চার সিলিন্ডারের অটোমেটিক অটোমেটিক করলার লিটার প্রতি মাইলেজ মাত্র ৩৪। তবে ১৯৯০ এর দশকের তুলনায় কমলেও বাজার আরও প্রসারে এখনও মূল সমস্যা ব্যাটারির দাম। এ কারণে ব্যাটারি রিসাইকেল করে এতে ব্যবহূত মূল্যবান ধাতু পুনর্ব্যবহারের প্রযুক্তি ও উপায় সন্ধানে শত শত কোটি ডলার বিনিয়োগ করতে হচ্ছে বিশ্বের শীর্ষ কোম্পানিগুলোকে।
তবে আশা করা হচ্ছে, ২০২৩ সালের মধ্যে লিথিয়াম-আয়ন ইভি ব্যাটারি প্যাকের খরচ প্রতি কিলোওয়াট-ঘণ্টায় ১০০ ডলারের নিচে নেমে আসবে, অর্থাৎ বর্তমানের চেয়ে ২০ শতাংশ কমে যাবে।
বাধা দূর হয়নি: বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যাপক গতি এলেও দেশে চার চাকার বৈদ্যুতিক যানের বাজার বলতে গেলে একেবারেই অস্তিত্বহীন। কেউ কেউ অবশ্য অনেক টাকা দামে কিছু হাইব্রিড গাড়ি আমদানি করেছেন। এগুলোর মধ্যে মাত্র ১০ শতাংশ প্ল্যাগ অন হাইব্রিড। দেশে বাণিজ্যিক পর্যায়ে কোনো চার্জিং স্টেশন না থাকায়, যাদের অধিকাংশই ব্যবহারকারীরা বাড়িতে চার্জ করান।
ইউএনডিপির হিসাব অনুসারে, এক হাজার প্লাগ-ইন হাইব্রিড কারসহ বর্তমানে দেশে ১৫ লাখ ইভি মোটরবাইক ও অনিবন্ধিত তিন চাকার যান রয়েছে। ইউএনডিপির প্রকল্পের খসরা নথি অনুসারে জানা যায়, গণ-পরিবহন ব্যবস্থায় ইভি যুক্তকরণ ও বেসরকারি খাতে ইভি উত্সাহিত করতে বাংলাদেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ম্যান্ডেটে কোনো সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা নেই।
এছাড়াও উচ্চ কর, বাস চার্জিং স্টেশন নির্মাণের সমস্যাই প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখা হচ্ছে।
মানবকণ্ঠ/এফআই