Image description

শিল্পী নাজনীন: সম্প্রতি একজন নবাগত ক্রিকেটারকে নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠেছে। ফেসবুক সয়লাব তার বিভিন্ন সময়ে করা ফেসবুক পোস্টের স্ক্রিনশটে। তার সবগুলো পোস্টেই চরম নারীবিদ্বেষ এবং মৌলবাদী মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে। সে নিয়ে সমালোচনায় মেতেছেন নেটিজেনরা। কেউ কেউ এমনকি তার বিরুদ্ধে মানববন্ধনেরও ডাক দিয়ে বসেছেন। কিন্তু ক্রিকেটার সাকিব কি সত্যিই এতটা সমালোচনার যোগ্য বা গুরুত্বপূর্ণ? সেটা ভেবে দেখার বিষয়।

যদি সত্যিই কাউকে সমালোচনা করতে হয়, তবে তা হওয়া উচিত তার পরিবার, তার সমাজ, তার শিক্ষা সর্বোপরি রাষ্ট্রের মৌলবাদকে প্রশ্রয় দেয়া উদ্দেশ্যমূলক নীতিকে নিয়ে। কেননা সাকিবের এই যে চরম সাম্প্রদায়িক মনোভাব, নারীবিদ্বেষী চিন্তাচেতনা সেটি তো একদিনে তৈরি হয়নি।

বরং তার শৈশব থেকে অতি ধীরে ধীরে তার মগজের গভীরে এই ‘চেতনা’র বীজ বুনে দিতে সচেষ্ট থেকেছে পরিবার, সমাজ, শিক্ষাব্যবস্থা এবং পরোক্ষভাবে রাষ্ট্র নিজে। কারণ রাষ্ট্র খুব প্রচ্ছন্নভাবে চরম সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রশ্রয় দিয়ে, তাদেরকে প্রায় কোলে তুলে নিয়ে তাদের এই হিংসাত্মক মনোভাবকে সমাজে ছড়িয়ে দিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে।

সেজন্যই এমন হাজার সাকিবে সয়লাব এখন সমাজ, এমন লক্ষ সাকিবে ভরে উঠছে দেশ। পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র কি এই দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারে? সুতরাং সমালোচনা করলে প্রকৃত দায় যার, যাদের, তাকে, তাদেরই সমালোচনা করা উচিত।

সাকিব জন্ম থেকেই তার মাকে তার পরিবারে দেখেছে প্রথমত সেবাদাসীর ভ‚মিকায়। সেখানে সে দেখেছে নারী মানেই কালো বস্ত্রাবৃত ভারবাহী প্রাণী। হ্যাঁ প্রাণী। যাকে ঠিকঠাক মানুষ ভাবার শিক্ষাটা সে পায়নি, তার পরিবার, সমাজ, তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাকে এই শিক্ষাটা দেয়নি, কিংবা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এই অপারগতা কিংবা ব্যর্থতার দায় তো সাকিবের নয়। সে জন্মাবধি দেখেছে নারী মানেই সন্তান উৎপাদকারী একটি যন্ত্র, যার নিজস্ব কোনো কণ্ঠস্বর নেই, ভালোলাগা-মন্দলাগা নেই, স্বাধীনতা নামক বস্তুটির বালাই নেই। যে অন্যের কথায় ওঠে, অন্যের কথায় বসে, যাপন করে অন্যের জীবন। সে দেখেছে নারী মানেই দম দেয়া এক কলের পুতুল।

যে নারী চাহিদামাফিক ‘স্বামীসেবা’ করে, নিজের সব স্বাধীনতা সেরদরে বিক্রি করে দিয়ে সন্তানের ‘হক’ আদায় করে, অন্ধকার ঘরের কোণে লুকিয়ে থেকে অন্যের চোখে ‘কমনীয়’ হওয়ার চেষ্টায় যে জীবন পার করে দেয় আর কঠোর পর্দার মধ্যে নিজেকে বন্দি রেখে যে সমাজকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার আপ্রাণ চেষ্টায় যাপন করে অন্যের জীবন। এই নারীতেই জন্ম থেকে অভ্যস্ত সাকিব, এই নারীকেই সে দেখে এসেছে চারপাশে। এর ব্যতিক্রম যা সে দেখেছে, তাকে এই সমাজ, তার প্রাপ্ত শিক্ষা, এবং তার পরিবার তার কাছে হাজির করেছে ‘ব্যতিক্রম’ এবং ‘ভয়ানক পাপ’ হিসেবে। তার শৈশব-কৈশোর কেটেছে হয়তো নারীবিদ্বেষীদের কথা শুনে। ঘটনাক্রমে সেখান থেকে সে পুঁজিবাদের লোভাতুর হাতছানিতে ‘দিগভ্রান্ত’ হয়ে ক্রিকেট খেলায় এসেছে।

মোল্লাতন্ত্রের সবটুকু পাঠ আত্মস্থ করতে পারলে সে এখানেও আসত না, কারণ তার কট্টোর মোল্লাতন্ত্র এই ক্রিকেটকেও সমর্থন করে না। তার পরিবার, এই সমাজ, এই শিক্ষাব্যবস্থা তাকে শিক্ষা দিয়েছে নারীকে ‘অবলা জীব’, ‘সন্তান উৎপাদনকারী যন্ত্র’, ‘যৌনসুখ প্রদানকারী সেবাদাসী’ ভাবতে। বেচারা অবলা নারীরাও এখন মুখে কথার খই ফুটিয়ে, পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করে সাকিবদের হারিয়ে লুফে নিচ্ছে সব নজরকাড়া চাকরি। মোল্লাতন্ত্রের জ্বলুনিটা ওখানেই। তারা তাই সাকিবদের মগজ ধোলাই করতে তৎপর।

তা বাছারা, সমাজ রক্ষার এতই যখন জরুরৎ, তো যাও না, তোমরা ঘরের কোণে সেঁধিয়ে পড়, মন দিয়ে সন্তান লালন-পালন কর, সংসার সামলাও, আর নারীরা মন দিয়ে বাইরেরটা সামলাক এবার! তোমরা বাইরে না এলে তো নারীদেরও পর্দা করার হ্যাপা নিতে হবে না আর! তোমাদের দৃষ্টি খারাপ, সুতরাং তোমাদের কুদৃষ্টি নিয়ে তোমরা লুকিয়ে পড় গর্তে, নারীরা কেন তোমাদের ভয়ে ঘরের কোণে লুকোবে! ‘সুলতানার স্বপ্ন’ বরং সত্যি হোক এবার!

সাকিবের সমালোচনা না করে তাই, পরিবার, সমাজ আর রাষ্ট্র, সবাই একযোগে তৎপর হতে হবে। ঢেলে সাজাতে হবে শিক্ষাব্যবস্থাকে। সাকিবদের এই শিক্ষা দিতে হবে যে, সমাজের অর্ধেক অংশকে অন্ধকারে রেখে কখনো সমাজকে আলোকিত করা যায় না। সেজন্য দরকার শিক্ষার উজ্জ্বলতর মশাল, যা সমাজের প্রতিটি গলি-ঘুপচিতে আলো ফেলবে, দূর করবে সাকিবদের মনের ভেতরকার সব অন্ধকার। -লেখক: শিক্ষক, কথাচিত্রী

মানবকণ্ঠ/এআই