Image description

মিজানুর রহমান মিজান: পৃথিবীকে মানুষের বাসযোগ্য আবাসস্থল হিসাবে গড়ে তুলতে হলে যুদ্ধের সমাপ্তি জরুরি। যুদ্ধবিহীন সমাজই পারে মানুষকে সুন্দর বিশ্ব উপহার দিতে। সারাবিশ্বে মানুষকে সুন্দরভাবে বসবাসের জন্য প্রয়োজন মানবিক ও সহনশীল গুণাবলি সম্বলিত বিশ্ব।

মানুষের জীবন ধারণের জন্য যা যা প্রয়োজন তার সবই সৃষ্টিকর্তা এই পৃথিবীতে সৃষ্টি করেছেন। মানুষের রয়েছে বিবেক, বুদ্ধি, জ্ঞান ও চিন্তার স্বাধীনতা। আজকের পৃথিবীতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের যত উন্নতি তার সব মানুষেরই অবদান। কিন্তু জ্ঞান-বিজ্ঞানের চরম উন্নতির পরও মানুষের জীবনে শান্তি নেই। শান্তিময় জীবন যাপনের জন্য মানুষের মধ্যে সাম্য, ভাতৃত্ব, ঐক্য ও মানবিকতা প্রয়োজন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, জ্ঞান বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষ সত্তে¡ও বিশ্ব থেকে যুদ্ধ নির্মূল হয়নি, যুদ্ধ বন্ধ হয়নি।

সব সময় এই পৃথিবীর কোনো না কোনো অঞ্চলে যুদ্ধ চলছে। প্রাণ হারাচ্ছে নিরপরাধ মানুষ। এই অমানবিক যুদ্ধের কারণে একজন স্ত্রী হারাচ্ছে তার স্বামীকে। একজন বাবা হারাচ্ছে তার ছেলে কিংবা মেয়েকে, একটি পরিবার হারাচ্ছে তার পরিবারের একমাত্র উপার্জনশীল ব্যক্তিকে। এছাড়াও এই যুদ্ধে সারা জীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করে হাজারো মানুষ। এই যুদ্ধ মানবতার জন্য কখনো কোনো ধরনের কল্যাণ বয়ে আনেনি ও ভবিষ্যতেও আনবে না।

যুদ্ধ মানে মানুষের জীবনে কেবল দুঃখ, কষ্ট আর ধ্বংস। এর অতীত ইতিহাস হিসাবে এখনো আমাদের চোখে ভাসে ১ম ও ২য় বিশ্বযুদ্ধের কথা। তাই আমরা এসব অর্থহীন যুদ্ধের চির অবসান চাই। আমরা চাই যুদ্ধ নামক এই ধ্বংসযজ্ঞ পৃথিবী থেকে চিরদিনের জন্য দূর হয়ে যাক। আমরা যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই। চাই মানবতার মুক্তি।

বর্তমান বিশ্ব ও এই নিষ্ঠুর যুদ্ধের প্রভাব থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না। প্রতিনিয়ত যুদ্ধের ওপর ভাসছে আমাদের এই সুনীল বিশ্ব। বর্তমানে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ চলছে। এই যুদ্ধে ইতোমধ্যেই মারা গেছে কয়েক হাজার মানুষ। রাশিয়া ও ইউক্রেন পাশাপাশি অবস্থিত দু’টি দেশ। ইউক্রেন এক সময় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ইউক্রেন স্বাধীনতা অর্জন করে। ইউক্রেনের ন্যাটো সামরিক জোটে অন্তর্ভুক্তিসহ বিভিন্ন ইস্যুতে দীর্ঘদিন ধরেই রাশিয়ার সাথে ইউক্রেনের মতবিরোধ চলছে। চলমান এই উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে রাশিয়া গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে আক্রমণ শুরু করে।

ইতোমধ্যেই ইউক্রেনের কয়েকটি শহর ধ্বংস হয়েছে। ইউক্রেনের প্রায় ১০ লাখ মানুষ দেশ ছেড়ে শরণার্থীর জীবন যাপন করছে। ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণে রাশিয়ারও অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। রাশিয়ার সেনাসহ অনেক লোকজন নিহত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্ব ইউক্রেনকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য সহযোগিতা করছে। বরাবরের মতোই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বিশ্ব আবারো দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। রাশিয়ার পক্ষের রাষ্ট্রগুলো এই যুদ্ধে রাশিয়ার পক্ষে এবং যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষের রাষ্ট্রগুলো ইউক্রেনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই রাশিয়ার বিরুদ্ধে একাধিক অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছে। অন্যদিকে, রাশিয়ার পক্ষের রাষ্ট্রগুলো যুক্তরাষ্ট্রের এসব অবরোধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ফলে রাজনৈতিক বিভক্তির পাশাপাশি বিশ্ব অর্থনৈতিকভাবেও বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এই যুদ্ধের কারণে বিশ্বে বিভিন্ন ধরনের পণ্যসামগ্রীর দাম বেড়েছে। ফলে বিশ্বব্যাপী মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে গেছে। যেখানে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠান করা হয়েছিলো সেই শান্তি প্রতিষ্ঠার দায়িত্বে নিয়োজিত জাতিসংঘ বরাবরের মতোই এই যুদ্ধ বন্ধে ব্যর্থ হয়েছে। তারা পারছে না আমাদের জন্য একটা নিরাপদ বিশ্ব উপহার দিতে। তারা পারছে আগামী দিনের শিশুর জন্য বিশ্বকে বাস যোগ্য করে গড়ে তুলতে। আমরা অবিলম্বে এই যুদ্ধের অবসান চাই।

পৃথিবীতে কোনো না কোনো সময় কোনো না কোনো দেশের মধ্যে যুদ্ধ লেগেছে এবং এসব যুদ্ধ দীর্ঘদিন অব্যাহত রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই পৃথিবীতে বিভিন্ন দেশের মধ্যে একাধিক যুদ্ধ চলছে। যুদ্ধ চলছে লিবিয়ায়, সিরিয়ায় ও ইয়েমেনে। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এ তিনটি দেশে যুদ্ধ চলছে। যুদ্ধে যুদ্ধে এসব দেশ আজ ধ্বংসের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। অথচ এসব দেশ এক সময় অনেক উন্নত ও শান্ত ছিল। এসব দেশ আজ বহু ভাগে বিভক্ত এবং একেক এলাকায় চলছে একেক গোত্রের শাসন। এসব দেশে দেশব্যাপী একক সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই এবং এসব দেশের সার্বভৌমত্ব আজ দুর্বল হয়ে পড়েছে। এসব দেশের সাধারণ জনগণের জীবনে আজ কষ্টের শেষ নেই।

যুদ্ধ বন্ধের পরিবর্তে বৃহৎ শক্তিগুলোর এসব যুদ্ধের বিবদমান পক্ষগুলোর পক্ষাবলম্বন করেছে এবং তাদের সহযোগিতা করে এসব যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করেছে। দীর্ঘদিন যুদ্ধ চলেছে ইরাক ও আফগানিস্তানে। ইরাকে প্রায় এক দশক ও আফগানিস্তানে প্রায় চার দশক ধরে যুদ্ধ চলেছে। এ দু’টি দেশে কয়েক লাখ মানুষ মারা গেছে। আফগানিস্তানের প্রায় ৪০ লাখ মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে। বর্তমানে এ দু’টি দেশে যুদ্ধ বন্ধ হলেও দেশ দু’টিতে পুরোপুরিভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

বছরের পর বছর ধরে চলে আসা যুদ্ধে এসব দেশ কেবল ধ্বংস হয়েছে। ধ্বংস হয়েছে মানুষের বাড়িঘর, ধ্বংস হয়েছে অফিস-আদালতসহ বিভিন্ন অবকাঠামো এবং ধ্বংস হয়েছে সব কিছু। নিহত ও পঙ্গুত্ব বরণ করেছে কয়েক লাখ মানুষ। যুদ্ধের ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ থেকে বাঁচার তাগিদে নিজের বাড়িঘর ছেড়ে ভিনদেশে উদ্বাস্তুর জীবন যাপন করছে অগণিত মানুষ। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বে উদ্বাস্তুর সংখ্যা এখন প্রায় ছয় কোটি। এসব যুদ্ধে যে সব অস্ত্র ব্যবহার হয়েছে তার মূল্য বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। অথচ এসব অর্থ মানবতার কল্যাণে ব্যয় করা হলে পৃথিবী থেকে ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও অশিক্ষা বহু আগেই দূর হয়ে যেত। ফলে পৃথিবীজুড়েও বিরাজ করত শান্তি ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ ও জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির প্রেক্ষাপটে ভবিষ্যৎ বিশ্বকে যুদ্ধমুক্ত করার প্রত্যয়ে ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। বিশ্বব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠাই ছিল জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য। ইতোমধ্যেই জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার ৭৬ বছর পূর্ণ হয়েছে কিন্তু যুদ্ধ বন্ধ হয়নি। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, জাতিসংঘ বিভিন্ন দেশে চলমান যুদ্ধ বন্ধে বরাবরই ব্যর্থ হয়েছে। ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়া ও ইয়েমেনে যুদ্ধ বন্ধ করতে পারেনি। কয়েক দশক ধরে চলে আসা ফিলিস্তিনের ওপর ইসরাইলের দখলদারিত্ব বন্ধে ব্যর্থ হয়েছে।

ফিলিস্তিনের হাজারো মানুষ বছরের পর বছর ধরে উদ্বাস্তু। এদের অনেকেই উদ্বাস্তু শিবিরেই জন্মগ্রহণ করেছে, বড় হয়েছে এবং মৃত্যুবরণ করেছে। বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনেও জাতিসংঘ ব্যর্থ হয়েছে। জাতিসংঘের এই ব্যর্থতার কারণ বৃহৎ শক্তিগুলো কখনোই নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করেনি এবং জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ব্রিটেন ও ফ্রান্স হচ্ছে জাতিসঙ্ঘে ভেটো ক্ষমতার অধিকারী পাঁচটি দেশ। আর এসব দেশ তাদের ইচ্ছার বাইরের সব প্রস্তাব ভেটো ক্ষমতার মাধ্যমে বরাবরই নাকচ করে দিয়েছে। ফলে কোনো এলাকায় যুদ্ধ শুরু হলে তা বন্ধের জন্য জাতিসংঘ কখনোই সর্বসম্মতভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। এ অবস্থায় মানবজাতির শান্তির স্বার্থেই আজ এই পৃথিবীকে যুদ্ধমুক্ত করতে হবে।

বর্তমানে এই পৃথিবীতে প্রায় ১৯৫টি স্বাধীন রাষ্ট্র রয়েছে, যারা সবাই জাতিসংঘের সদস্য। এসব রাষ্ট্রের সবার আর্থ-সামাজিক অবস্থান সমান নয়। কেউ অনেক বড় ও অধিক শক্তিশালী, কেউ একেবারেই ছোট ও দুর্বল। কোনোটি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে অনেক বেশি শক্তিশালী। আবার কোনোটি দুর্বল। কিন্তু সব রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সম্মান করা এবং এর মর্যাদা সমুন্নত রাখাই কাক্সিক্ষত। সব দেশের সব মানুষেরই স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে। মানুষের সর্বজনীন এই অধিকার জাতিসংঘ স্বীকৃত।

জাতিসংঘকে বিশ্বশান্তি রক্ষায় কার্যকর করতে হলে এর সংস্কার প্রয়োজন। এ জন্য বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সমঝোতা প্রয়োজন। আজ যুদ্ধ করতে হবে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা ও রোগ জীবাণুর বিরুদ্ধে। মারণাস্ত্র না বানিয়ে বরং এসব ধ্বংস করতে হবে। পৃথিবীর শত কোটি মানুষ এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। অস্ত্র নির্মাণে অর্থ ব্যয় না করে সেই অর্থ আজ এসব মানুষের জীবন মান উন্নয়নে ব্যয় করতে হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আজ যেসব মানুষ শরণার্থী হিসেবে বিভিন্ন উদ্বাস্তু শিবিরে বসবাস করছে, তাদের নিজ নিজ দেশের নিজ বাসভ‚মিতে ফিরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে হবে। মানবিকতার আদর্শ ছড়িয়ে দিতে হবে সবখানে। ক্ষুধা-দারিদ্র্য, রোগব্যাধি, যুদ্ধ-হানাহানিতে নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোই সত্যিকারের মানবিকতা। মানুষের মধ্যে আর কোনো হিংসা-বিদ্বেষ নয়। জাগিয়ে তুলতে হবে ভালোবাসা ও মানবিকতার পরিবেশ। -লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

মানবকণ্ঠ/এআই