

অলোক আচার্য: বিশ্ব সত্যিকার অর্থেই এক অস্থির সময় পার করছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ব রাজনীতির বহু হিসাব-নিকাশ বদলে দিয়েছে। বদলে দিয়েছে অর্থনীতি, সামরিক সক্ষমতার হিসাব। এই যুদ্ধ এখনো চলছে। যুদ্ধ যে মূলত দীর্ঘায়িত হতে যাচ্ছে সে অনুমান করা যায়। সেক্ষেত্রে বৈশ্বিক রাজনীতিতে আরও পরিবর্তন ঘটবে। জোটের সম্প্রসারণ এবং নতুন জোটের সম্প্রসারণ হচ্ছে। আসতে পারে নতুন জোট। সময়ের সাথে সাথে নতুন নতুন জোট গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
বিশেষ করে এই যুদ্ধের শুরু হওয়ার পর জোটের গুরুত্ব বেড়েছে। আবার জোটের গুরুত্ব যেমন প্রসারিত হয়েছে সেভাবেই সমমনা দেশগুলোও নিজেদের অস্তিত্ব, স্বার্থ এবং নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে। ফলে এ ধরনের পরিস্থিতিতে নিজেকে নিরাপদ করাতে একাধিক দেশ জোটবদ্ধ হচ্ছে বা হতে পারে। মাঝেমধ্যেই গণমাধ্যমে সেসব জোট গঠনের খবর আসছে। আবার কমতে পারে কোনো জোটের গুরুত্বও! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পারস্পরিক স্বার্থ রক্ষায় বহু জোটের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে ব্রিকস নিয়ে বেশ জোরেশোরে আলোচনা হয়েছে। এর কারণ ব্রিকসের সম্প্রতি শেষ হওয়া সম্মেলনে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির সম্ভাবনা এবং আগ্রহ প্রকাশ। প্রথমত এই জোট সম্পর্কে একটু জানা দরকার। ব্রিকস হলো বিশ্বের পাঁচ উদীয়মান এবং সম্ভাবনাময় অর্থনীতির দেশের একটি অর্থনৈতিক জোট। এই জোটের সদস্য রাষ্ট্রগুলো হলো ভারত, চীন, রাশিয়া, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকা।
ইতিমধ্যেই পৃথিবী যে দুটি শক্তিশালী বলয়ে বিভক্ত হয়েছে তার একটি হলো চীন ও রাশিয়া। অর্থনীতি, রাজনীতি এবং সামরিক দিক থেকে বিশ্বের অন্যতম অবস্থানে এবং সেই সাথে ভারতও গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে তার কৌশলগত ভ‚মিকার কারণে। সমাপ্ত হওয়া ব্রিকসের সম্মেলনে নতুন করে আরও ছয়টি দেশ সদস্য হয়েছে। এটি এমন এক সময় যখন বৈশ্বিক ক্ষমতার কেন্দ্র দুইভাগে বিভক্ত হতে চলেছে। এখানে সদস্য রাষ্ট্র বৃদ্ধি করা এবং জোটকে শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা রয়েছে। ব্রিকসের এবারের যোগ হওয়া দেশগুলো অর্থনীতিতে শক্তিশালী। ইতিমধ্যেই ব্রিকসের এই সম্প্রসারণ ভবিষ্যৎ অর্থনীতির নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হবে। কারণ যদি তারা নিজেদের মধ্যে ব্যবহারের জন্য একই মুদ্রা ব্যবহার করে তাহলে ডলারের ওপর থেকে চাপ কমবে।
এটি বিশ্বের অন্যতম একটি জোট হিসেবে প্রকাশিত হবে। এখন জোট গঠনের ও সম্প্রসারণের উদ্দেশ্য বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষার সাথে সাথে নিরাপত্তা জোরদার করা এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা রক্ষা করা। বর্তমান বিশ্বে সামরিক শক্তি, অর্থনৈতিক সক্ষমতা এবং অন্যান্য দিক মিলিয়ে আমেরিকা বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর মধ্যে এখনো এককভাবেই প্রভাবশালী বলে স্বীকার করতে হয়। বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় সামরিক খাতে নতুন নতুন অস্ত্র যোগ করা এবং বিশ্ব প্রতিযোগিতায় নিজেকে উপযুক্ত করে গড়ে তোলা এখন প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বের প্রবণতা এবং এই প্রবণতা থেকেই এক দেশ অন্য পরাশক্তিকে মোকাবিলায় জোটবদ্ধ অবস্থান গড়ে তুলছে। পশ্চিমা বিশ্ব বনাম চীন-রাশিয়ার যে প্রতিযোগিতা সেখানে জোট একটি প্রধানতম বিষয়।
ব্রিকসের সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে যদি পশ্চিমা বিশ্বের বিপক্ষে দাঁড় করানো যায় তাহলে সেটি একটি শক্ত অবস্থান হবে। কিন্তু এখানে অন্যান্য অনেক দেশেরই যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এবং রাশিয়ার সাথে ভালো সম্পর্ক রয়েছে। অর্থাৎ ভারসাম্য নীতি মেনে চলছে। কিছুটা কম বা বেশি হলেও সম্পর্ক দুই দেশের সাথেই ভালো। ফলে এক্ষেত্রে কতটুকু শক্তিশালী করা যাবে তা ভবিষ্যৎই বলতে পারে। কিন্তু অর্থনৈতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে প্রায় শতভাগ সফল হতে পারে যদি পরিকল্পনাগুলো কার্যকরভাবে কাজে লাগাতে পারে দেশগুলো। কারণ বিশ্বের প্রায় ৪০ শতাংশ জনসংখ্যা ব্রিকসের দেশগুলোতে বসবাস করে। বিশ্বের মোট দেশজ উৎপাদনের এক-চতুর্থাংশও আসে ব্রিকসের দেশগুলো থেকে। এখন যেহেতু ব্রিকসে আরও অনেক দেশ যোগ দিতে আগ্রহী তাহলে সেটা ব্রিকসের সম্প্রসারণের সাথে সাথে কিছুটা হলেও পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য চিন্তার।
২০১৯ সালের পর এবারই প্রথম সশরীরে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সদস্য বাড়াতে চীন ও রাশিয়ার মনোভাবও ইতিবাচক ছিল। এর অর্থ হলো এখন এই জোটকে আরও প্রসারিত করতে চায় তারা। আবার বিভিন্ন দেশের আগ্রহও ছিল চোখে পড়ার মতো। এবারের ১৫তম ব্রিকস সম্মেলনে ৪০টি দেশ আগ্রহ প্রকাশ করেছিল এবং এর মধ্যে ২০টিরও বেশি দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন করেছিল। এর একটি অন্যতম কারণ হতে পারে অর্থনীতির চাপ সামাল দিতে অর্থনৈতিক শক্তিশালী এই জোটের সাথে থেকে একটি নিরাপত্তা ব্যবস্থা তৈরি করা।
যতদূর মনে হয়, ব্রিকসের দেশগুলো ভবিষ্যতে অর্থনীতিতে নেতৃত্ব দিবে। তার প্রমাণ পাওয়া যায় অর্থনৈতিক সমীক্ষায়। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মনস্তাত্তি্বক দ্বন্দ্ব চলে আসছে রাশিয়া ও চীনের। দ্ব›দ্ব মূলত বিশ্বে আধিপত্য ধরে রাখার এবং বিস্তার করার।
সম্প্রসারিত হচ্ছে জোটগুলো। স্বাক্ষরিত হচ্ছে চুক্তি। বিশ্ব রাজনীতি এখন নতুন মাত্রা পেয়েছে। বিশ্ব আগের চেয়ে আরও বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ অবস্থানে যাচ্ছে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। কৌশলগত অবস্থানে থেকে পারস্পরিক সহযোগিতার প্রত্যাশায় জোট গঠিত ও সম্প্রসারিত হচ্ছে। তবে ব্রিকসের অর্থনৈতিক ভিত্তি এবং দেশগুলোর সহাবস্থান ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক, চিকিৎসাসহ অন্যান্য মৌলিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হয়ে উঠবে। -লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
মানবকণ্ঠ/এআই