

প্রযুক্তি ছোঁয়ায় বদলে যেতে শুরু করেছে ময়মনসিংহে কাজী নজরুল ইসলামের নামে প্রতিষ্ঠিত দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। প্রচলিত শ্রেণিকক্ষের জায়গায় এখানে রয়েছে স্মার্ট ক্লাসরুম। এর মাধ্যমে শিক্ষার গুণগতমান বৃদ্ধি, শিক্ষকদের দক্ষতা ও শিক্ষাদানের প্রতি আগ্রহ বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি কোথায়, কোন অবস্থায় আছে তা জানতে এখানে রয়েছে JKKNIU Bus Update অনলাইন সুবিধা। এর মাধ্যমে বাস কোথায় আছে জানতে পারছেন যাতায়াতরত শিক্ষার্থীরা। পুরো ক্যাম্পাস ওয়াইফাইয়ের আওতায় আনার ঘোষণা করা হয়েছে। প্রচলিত অফিস ব্যবস্থাপনার জায়গায় ‘পেপারলেস’ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করতে ডিজিটাল নথির যুগে প্রবেশ করেছে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে এটির যাত্রা সফল ভাবে শুরু হয়েছে। এখানে নিয়মিত মুক্তিযুদ্ধের গল্প জানানোর জন্য আয়োজন করা হয় মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক চলচ্চিত্র প্রদর্শনী। এখানে রয়েছে মুক্ত চর্চায় গাহি সাম্যের গান মুক্তমঞ্চ, যেটি দিনভর সংস্কৃতিকর্মীদের পদচারণায় মুখরিত থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেখ রাসেল কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ জমজমাট থাকে খেলোয়াড়দের অনুশীলনে।
২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে উপাচার্য হিসেবে এখানে যোগ দেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব প্রফেসর ড. সৌমিত্র শেখর দে। যিনি ইতোমধ্যেই দেশের অন্যতম জনপ্রিয় শিক্ষার্থীবান্ধব উপাচার্য হিসেবে আলোর দিশারী হয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পরেই একাডেমিক ও প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। এটিকে প্রকৃত বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তুলতে গবেষণার ওপর জোর দেন। শিক্ষা, গবেষণা ও উন্নয়নকে মোটো করে তাঁর সুদক্ষ নেতৃত্বে এগিয়ে চলছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। তাঁকে সহযোগিতা করেছেন কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. আতাউর রহমান। এক সময় বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত বিশ্ববিদ্যালয়টি মাত্র দেড় বছরের মাথায় এগিয়ে চলেছে ২০৪১ সালের স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির ‘বিদ্যা পিঠ’ হিসেবে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে যাচ্ছে ভবিষ্যতের নতুন দিনের বিশ্ববিদ্যালয়।
বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার শিক্ষা, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক তথা সামগ্রিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে শুরু করেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। বিজ্ঞানমুখী শিক্ষার প্রসার, দেশে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি, জ্ঞান চর্চা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে পঠন-পাঠন ও গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করেছে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়।
বিজ্ঞান, প্রকৌশল আর প্রযুক্তি শিক্ষার গুরুত্ব সারা বিশ্বে সমাদৃত ও অনস্বীকার্য। একটি দেশকে উন্নত পর্যায়ে পৌঁছাতে হলে তাকে আধুনিক ও দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হয়। আর দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেছেন, তার অন্যতম হতে চলেছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তা, আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর রাষ্ট্র গড়ার পরিকল্পনা, বিজ্ঞানমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা, বিশেষ করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর উন্নত বিশ্বের সমকক্ষতা অর্জনের যে স্বপ্ন, তা বাস্তবায়নে শীঘ্রই কার্যকরী পদক্ষেপের ফসল হবে এই নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলা বিনির্মাণের এক একজন সুনাগরিক হিসেবে দেশের সেবায় নিজেদের নিয়োজিত করবে।
২০০৬ সালে ময়মনসিংহ শহর থেকে পঁচিশ কিলোমিটার পূর্বে ৫৭ একর জমির ওপর স্থাপিত হয় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। ২০০৭ সালে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। তারপর হাটি হাটি পা পা করে নবীন এই বিশ্ববিদ্যালয় কৈশোরে পদার্পণ করেছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য উপযুক্ত কর্মী তৈরি হচ্ছে এখানে। ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের দক্ষ কর্মী তৈরি করতে নিরলস পরিশ্রম করছেন এখানকার একঝাঁক মেধাবী শিক্ষকেরা। বেশি দিন আর দূরে নেই, একদিন রূপপুর স্মার্ট বাংলাদেশের হাল ধরবে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬টি অনুষদ ও ২৪টি বিভাগের অধীনে প্রায় সাড়ে আট হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন এখানে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং, বিএসসি (অনার্স), বিএসএস (অনার্স), বিবিএ (অনার্স), এফবিএ (অনার্স), এলএলবি (অনার্স), এমএসসি, এমএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং, এমএ, এমএসএস, এলএলএম, এমবিএ, এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রি চালু আছে।
শুরু থেকে এখানে মানসম্মত শিক্ষার পাশাপাশি আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। পাঠদান কার্যক্রম সেমিস্টার পদ্ধতিতে পরিচালিত হয়। আট সেমিস্টারের সময়সীমায় প্রতি বছর দুইটি সেমিস্টার শেষ করা হয়। মাত্র চার বছরে এখান থেকে শিক্ষার্থীরা শিক্ষাজীবন শেষ করতে পারছেন। এখানকার শিক্ষার্থীরা নতুন নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করে জ্ঞানের জগৎকে এগিয়ে নিচ্ছেন। ভর্তি পরীক্ষা অনেক প্রতিযোগিতাপূর্ণ হওয়ায় সারা দেশের শিক্ষার্থীদের আগ্রহের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কারণে ময়মনসিংহ শহরে তথা সারাদেশে নতুন আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। অর্থনীতিতে এসেছে গতিশীলতা। এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে ময়মনসিংহবাসীর ওপর।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবন শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান সংস্কৃতি চর্চার এক উর্বর ক্ষেত্র। এখানে রয়েছে কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম কাব্যগ্রন্থ অগ্নিবীণার নামে প্রথম ছাত্রহল অগ্নিবীণা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্র হল এবং দোলনচাঁপা ছাত্রী হল ও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ছাত্রী হল। নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে রয়েছে যুগোপযোগী ৩৭ হাজার বইয়ের বিপুল সমাহার। এখানে নিয়মিত আয়োজন করা হয় আন্তর্জাতিক কনফারেন্স এবং প্রকাশিত হয় বিভিন্ন জার্নাল। রয়েছে বিভিন্ন বিভাগের সেমিনার ও লাইব্রেরি কক্ষ। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য রয়েছে পর্যাপ্ত পরিবহন ব্যবস্থা। রয়েছে বঙ্গবন্ধু কর্ণার। যেখান থেকে শিক্ষার্থীরা জানতে পারছেন ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের ইতিহাস। শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন মুক্ত চিন্তা ও মত প্রকাশের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলেছে। রয়েছে মহান ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে নির্মিত শহীদ মিনার। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবর্ষ উপলক্ষে নির্মাণ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু ভাস্কর্য, জাতীয় কবির স্মরণে নির্মিত হয়েছে নজরুল ভাস্কর্য। শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন যৌক্তিক দাবী আদায়ের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে এখানে রয়েছে জয় বাংলা ভাস্কর্য ও চির উন্নত মম শির চত্বর।
খুব শীঘ্রই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদ ও কলা অনুষদের সামনের পুকুরে বসানো হবে অঞ্জলি লহ মোর ভাস্কর্য। যেটি স্থাপিত হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃষ্টিনন্দন এই পুকুরটি ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য আরো কয়েকগুণ বৃদ্ধি করবে। এখানে রয়েছে বঙ্গবন্ধু স্কয়ার, রয়েছে শেখ রাসেল শিশু পার্ক, চারু দ্বীপ, চুরুলিয়া মঞ্চ এবং নজরুলের স্মৃতিবিজড়িত সেই বটতলা।
এদিকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আধুনিক সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর জন্য সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মিলে শুরু করেছে উন্নয়নের মহাযজ্ঞ। ১০ তলা বিশিষ্ট একটি একাডেমিক ভবন, ছাত্র ও ছাত্রীদের জন্য ১০ তলা বিশিষ্ট দুইটি পৃথক আবাসিক হল, ৫ তলা বিশিষ্ট ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র ও অডিটোরিয়াম, ৫ তলা বিশিষ্ট নতুন আরেকটি প্রশাসন ভবন, শিক্ষক-কর্মকর্তাদের জন্য ১০ তলা বিশিষ্ট কোয়ার্টার ভবন, কর্মচারীদের জন্য ৫ তলা বিশিষ্ট কোয়ার্টার ভবনসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণকাজের বিশাল কর্মযজ্ঞ এখানে দৃশ্যমান। বেশকিছু প্রজেক্ট রয়েছে উদ্বোধনের অপেক্ষায়।
উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখরের সুদক্ষ নেতৃত্ব শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে এনেছে নতুন উৎসাহ উদ্দীপনা, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে এনেছে কর্মচাঞ্চল্য। উপাচার্য মহোদয়ের সার্বিক তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে গবেষণা, ক্লাসসহ প্রশাসনিক ও দাপ্তরিক কাজ। ফলে সর্বত্র এসেছে উন্নয়ন ও গতিশীলতা। শিক্ষার আদর্শ পরিবেশ পেয়ে জ্ঞানচর্চার তীর্থভূমিতে পরিণত হতে চলেছে জাতীয় কবির নামে প্রতিষ্ঠিত দেশের সর্বোচ্চ এই বিদ্যাপীঠ। বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষ মানব সম্পদের আলো ছড়িয়ে পড়ুক দেশব্যাপী-বিশ্বব্যাপী।
লেখক: এস এম মোজতাহীদ প্লাবন, শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ (তৃতীয় বর্ষ), জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
মানবকণ্ঠ/এসআরএস