Image description

মো. সাখাওয়াত হোসেন: ২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসের তৃতীয় সপ্তাহে আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা এএফপিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস দেশের রাজনীতিবিদদের সমালোচনা করে বলেন, তারা রাজনীতি করে টাকার জন্য। অবশ্য এই রাজনীতিবিদদের হাত ধরেই এ দেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে, দেশের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে রাজনীতিবিদদের অবশ্য কর্তব্য ভূমিকা রয়েছে।
রাজনীতিবিদদের এভাবে কটাক্ষ করে গণমাধ্যমে বক্তব্য দেওয়া কতটুকু সাবলীল সেটা পাঠক মাত্রই আপনারা মূল্যায়ন করবেন। ঢালাওভাবে রাজনীতিবিদদের এভাবে মূল্যায়ন করা কোনোভাবেই ঠিক হয়নি এবং বিষয়টি সঠিকও নয়। অথচ তিনি নোবেল পুরস্কার লাভ করার মাত্র পাঁচ মাসের মধ্যেই রাজনৈতিক দল গঠন করার কার্যক্রম শুরু করে সবাইকে অবাক করে দিয়েছিলেন। অর্থাৎ তিনি সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় রাজনৈতিক দল গঠনের জন্য উদ্যোগী হয়েছিলেন, যে সময়টায় মাইনাস টু ফর্মুলায় উঠেপড়ে লেগেছিল সেনাশাসিত সরকার।

কাজেই তার রাজনৈতিক বোধ, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে মূল্যায়ন প্রশ্নবিদ্ধ বাংলাদেশের মানুষ। এ দেশের জনতা সেনা শাসিত সরকারের রূপরেখাকে বাস্তবায়ন করতে দেননি। ১২ কোটি টাকা কর দাবি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নোটিসের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের করা তিনটি আয়কর রেফারেন্স মামলা খারিজ করে দিয়েছেন হাইকোর্ট। ফলে ড. ইউনূসকে এনবিআরকে ১২ কোটি টাকা পরিশোধ করতেই হবে। এখানে ব্যাপারটি হচ্ছে, ড. ইউনূস একজন সম্মানিত ব্যক্তি, বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তি, বাংলাদেশের প্রথম নোবেল প্রাপ্ত ব্যক্তি। কাজেই ড. ইউনূসকে নিয়ে এ ধরনের নেতিবাচক খবর আমাদেরকে আশাহত করে, বিভ্রান্ত করে, আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করে দেয়। তরুণ প্রজন্মের অনেকের কাছে প্রফেসর ইউনূস অনুসরণীয় হতে পারতেন, কিন্তু মাঝে মধ্যে হুট করে নেতিবাচক সংবাদের শিরোনাম হয়ে ড. ইউনূসের আলোচনায় আসার বিষয়টি পছন্দনীয় নয়। একটি নির্দিষ্ট বয়সের অনেকেই ড. ইউনূসকে অনুসরণ করে এবং সার্বিক বিষয়ে খোঁজখবর রাখেন। এ জায়গায় ড. ইউনূসকে নিয়ে এ ধরনের একটি সংবাদ পিলে চমকে ওঠার মতোই।

২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ভারত সফরে যান। সে সফরে তিনি রাজনীতিতে যোগ দেবার জোরালো সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেন। ২০০৭ সালের ৩০ জানুয়ারি ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর সাথে সাক্ষাতের পর ৩১ জানুয়ারি দিল্লিতে এক সংবাদ সম্মেলনে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, দেশের পরিস্থিতি বাধ্য করলে তিনি রাজনীতিতে যোগ দেবেন। অধ্যাপক ইউনূসকে উদ্ধৃত করে দৈনিক আমার দেশ লিখেছে, রাজনীতিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করার মতো ব্যক্তি আমি নই। কিন্তু পরিস্থিতি যদি বাধ্য করে তাহলে রাজনীতিতে যোগ দিতে আমি দ্বিধা করবো না। এ ধরনের বক্তব্য প্রদান করে রাজনীতিবিদদের ঢালাওভাবে দোষারোপ করা হলে ব্যক্তিত্বের জায়গায় অবস্থান নিয়ে প্রশ্নই থেকে যায়। সে কারণেই ড. ইউনূসকে নিয়ে ছোটখাটো কোনো বিষয়ের উদ্রেক হলেও সংবাদ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে আলোচনা সমালোচনা হয়।

জরুরি অবস্থা জারির পর থেকে অধ্যাপক ইউনূস বিভিন্ন সময় দেশের প্রচলিত রাজনীতি এবং রাজনীতিবিদদের কড়া সমালোচনা করেন। দিল্লিতে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, রাজনীতিবিদরা দেশকে এলডিসির পর্যায় থেকে আরো উন্নত পর্যায়ে আনতে চান না। অথচ বাংলাদেশ এখন স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পদার্পণ করেছে, মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। শিক্ষার হার বৃদ্ধি পেয়েছে, মাতৃমৃত্যুহার কমেছে, শিশু মৃত্যুর হারও হ্রাস পেয়েছে। অধ্যাপক ইউনূসকে উদ্ধৃত করে দৈনিক আমার দেশ লিখেছে, এখন একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে। যারা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত তারা যাতে আর নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে সে ব্যবস্থা করা উচিত। তিনি যে সুযোগটার কথা বলেছেন, সে সময়টাকে বাংলাদেশের রাজনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে বিপরীত স্রোতের ইঙ্গিত বহন করে। অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি ক্রমশই ঘোলাটে হয়েছিল এবং ঢালাওভাবে রাজনীতিবিদদের লক্ষ্য করে গ্রেপ্তার ও রাজনৈতিক মামলা প্রদান করা হয়েছিল।

২০০৭ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি অধ্যাপক ইউনূস দেশের মানুষের উদ্দেশে খোলা চিঠি দেন। সে চিঠিতে তিনি বলেন, নতুন রাজনীতি সৃষ্টির জন্য প্রচণ্ড উদ্যোগ নিতে হবে। এটি করতে না পারলে পুরনো রাজনীতি থেকে পরিষ্কারভাবে বেরিয়ে আসা সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, রাজনীতিতে জড়িত হওয়া মানে বিতর্কিত হওয়া। আপনারা যদি মনে করেন, আমার রাজনীতিতে আসাটা দেশে নতুন রাজনৈতিক পরিমণ্ডল রচনায় সহায়ক হবে তবে আমি তার জন্য এ ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত আছি। তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক দল গঠনের জন্য তিনি প্রয়োজনে গ্রামীণ ব্যাংক ছেড়ে দেবেন। অর্থাৎ রাজনীতির প্রতি প্রচণ্ড ঝোঁক থাকা সত্তে্বও জনসাধারণের সমর্থন না থাকায় রাজনৈতিক দলের নাম ঠিক করেও চিঠির মাধ্যমে রাজনীতিতে না আসার ঘোষণা প্রদান করেন।

শুধু তাই নয়, রাজনৈতিক দল গঠন করবেন এ মর্মে বিভিন্ন জায়গায় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার পর পর ড. ইউনূস তার রাজনৈতিক দলের নীতি ও আদর্শ ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, তার রাজনীতি হবে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন বাস্তবায়নের এবং ঐক্যের। দলের নীতি ও আদর্শ হচ্ছে - অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সুশাসন, দুর্নীতি ও দলীয়করণ মুক্ত। আবার কিছুদিন পর স্বেচ্ছায় ২০০৭ সালের ৩ মে অধ্যাপক ইউনূস রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়া থেকে সরে আসার ঘোষণা দেন। অর্থাৎ কোন একটি বিষয় সম্বন্ধে ঘোষণা দিয়ে আবার সে জায়গা থেকে ফিরে আসার সংস্কৃতি কোনোকালেই ভালো ছিল না, ড. ইউনূসের ক্ষেত্রে বোধহয় বিষয়টি এমনি। যেখানে তিনি সর্বমহলে সর্বজায়গায় শ্রদ্ধার আসনে থাকার কথা, সেখানে তার ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ডের জন্য তিনি সমালোচিত হচ্ছেন বিষয়টা অনেকাংশে দৃষ্টিকটু। এনবিআরএর কর ফাঁকির মামলায় ড. ইউনূসকে ১২ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে মর্মে হাইকোর্টের রায় ড. ইউনূসকে আবার আলোচনায় নিয়ে এসেছে। এ ধরনের আলোচনা একজন নোবেল প্রাপ্ত ব্যক্তিত্বকে নিয়ে হোক সেটা আমরা কখনোই মনে প্রাণে প্রত্যাশা করিনি। তাছাড়া গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনার ক্ষেত্রে তার বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ রয়েছে।

গণমাধ্যমের বরাতে জানা যায়, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রস্তাবেই এরশাদ সরকার গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে। ড. ইউনূস সেখানে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের চাকরি নেন, ১৯৮৩ সালে এটি একটি বৈধ এবং স্বতন্ত্র ব্যাংক হিসেবে যাত্রা শুরু করে। সরকার গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে একটি আইনের মাধ্যমে এবং সেখানে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে। অর্থাৎ গ্রামীণ ব্যাংকে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ব্যক্তিগত কোনো টাকা ছিল না। অথচ গ্রামীণ ব্যাংক ব্যবহার করেই ড. ইউনূস পেয়েছেন সবকিছু। কাগজে কলমে গ্রামীণ ব্যাংকের মালিক সরকার এবং ঋণ গ্রহীতা জনগণ।

উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে উল্লেখ করা যায়, সেনাশাসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে রাজনীতিবিদদের নিয়ে নির্মম মন্তব্য করতেও দ্বিধা করেননি ড. ইউনূস। বিষয়টি এদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন ও রাজনীতিবিদদের মনে বিরূপভাবে প্রভাব ফেলেছে। অথচ এ দেশের অধিকাংশ অর্জন ও গৌরবের সঙ্গে রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের অসামান্য ভূমিকা অগ্রগণ্য। পাশাপাশি একজন বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তির কর ফাঁকির ঘটনাটিকে বিভিন্নজন বিভিন্ন উপায়ে মন্তব্য করছেন, যা প্রকৃতঅর্থে লজ্জার ও মানহানিকর।

লেখক : চেয়ারম্যান, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

মানবকণ্ঠ/এআই