

মোহাম্মদ অলিদ সিদ্দিকী তালুকদার :: জাতিসংঘের মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এতোদিন বলেছিল, তারা বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের অপেক্ষা করছে। এখন আর নরম কথার অপেক্ষার পর্যায়ে নেই। অ্যাকশন বা থেরাপি প্রয়োগে নেমে গেছে দেশটি। কথা একটু পাল্টে জানিয়ে দিয়েছে, যারা সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধা দেবে তাদের এবং তাদের পরিবারের সদস্যদেরও যুক্তরাষ্ট্র ভিসা দেবে না। অনেকটা বজ্রপাতের মতো কিসের মধ্যে কি ধরনের এক অবস্থা। তাৎক্ষণিক জবাবে বাংলাদেশ থেকে বলা হয়েছে, সরকার এ নিয়ে মাথা ঘামায় না। এসবে বদার করার কিছু নেই। আসলেই বদার না করা বা মাথা না ঘামানোর মতো বিষয়টি?
সরকারের দিক থেকে এতে বিচলিত না হওয়ার ভান করলেও ভেতরের অবস্থা নিশ্চিন্ত থাকার মতো নয়। যুক্তরাষ্ট্রের বার্তা খুব স্পস্ট। গত ক’দিন ধরে ঘুরছিল বাংলাদেশের আরো কয়েকজনের স্যাংশনে পড়ার গুঞ্জন। বাস্তবে প্রকাশ পেলো যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতির খবর। যা স্যাংশনের চেয়ে কমও নয়। বাংলাদেশ প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র কতটা কঠোর অবস্থানে তা বোধগম্য ভিসানীতি একযোগে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নিজে টুইট করা, সাপ্তাহিক প্রেস ব্রিফিংয়ে এবং দূতাবাসের মাধ্যমে ঘোষণার মধ্যে।
যুক্তরাষ্ট্রেরে এ ভিসানীতিতে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধা প্রদানে দায়ী ব্যক্তি এবং তাদের পরিবারের সদস্যদেরও আনা হবে। যুক্তরাষ্ট্রের এই নতুন ভিসানীতিতে অনেকটা থ বনে গেছে নির্বাচন কমিশন। তারা এ বিষয়ে কিছু বলবেন না। কারণ এ বিষয়গুলো আন্তঃরাষ্ট্রীয় ব্যাপার। মোটকথা আগেই সাইড নিয়ে ফেলা। তবে, তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলে দিয়েছেন, এতে মাথা ঘামানোর কিছু নেই।
আসলেই কি মাথা না ঘামানোর বিষয় এটি? পানি অনেক দূর গড়িয়ে গেছে। সামগ্রিক অবস্থা যে জায়গায় চলে গেছে, সেখানে নেগোসিয়েশনের জায়গাও সাদা চোখে অস্পষ্ট। বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন আন্তর্জাতিক বিষয় হয়ে গেছে। ভৌগলিক ও আঞ্চলিক অবস্থান, বিশ্ব কূটনীতি-অর্থনীতি মিলিয়ে বাংলাদেশ এখন এক বিশেষ সন্ধিক্ষণে। এর মাঝে সরকার রাখঢাক না রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে টাগ অব ওয়ারে চলে গেছে। সামনে আরো স্যাংশন বা নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে বলে গুজব-গুঞ্জনের মাঝে বাংলাদেশকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পলিসি অনেকটাই ধারনার বাইরে। এর আগে, যুক্তরাষ্ট্রকে পাল্টা স্যাংশন দেয়া, তাদের সঙ্গে কেনাকাটা না করার মতো হুমকিতে বাঘের লেজ দিয়ে কান চুলকানোর যতো কাণ্ড করা হয়েছে। ঢাকাসহ সারা দেশে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের সতর্কতার সঙ্গে চলাফেরার পরামর্শ দিয়ে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন দূতাবাসের সতর্কতা জারিকে অনেকটা চ্যালেঞ্জের মতো নিয়েছে সরকার।
ওই চ্যালেঞ্জটা জানানো হয়েছে, এক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে রিফিউজি হিসেবে আশ্রিত তাদের কাছে কৃতজ্ঞতার বন্ধনে আবদ্ধ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেনকে দিয়ে। সরকারের কাছে পারফরমেন্স দেখাতে গিয়ে তিনি বলে বসেছেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নাগরিকদেরও যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণে সতর্ক করা উচিত। এমন মন্তব্য করে ড. মোমেন যুক্তি হিসেবে বলেছেন, বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের মতো রাস্তায় গোলাগুলি হয় না, কিংবা কেউ কাউকে মারে না। বাংলাদেশ বিদেশি কোনো রাষ্ট্রের চোখ রাঙানো কথায় কেয়ার করে না- এমন কঠিন কথা বলতেও ছাড়েননি। পরে এখন পর্যন্ত অতীতের মতো বলেননি যে, এ কথা তিনি বলেননি বা সাংবাদিকরা ঠিকভাবে তেুলে ধরেননি তার কথা। সেই সময়ও আর নেই। কেবল সরকার নয়, বিরোধীদলসহ আরো নানা পক্ষেরই এতে বাধা পড়ার শঙ্কা রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতির আওতায় বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী এমন যে কোনো বাংলাদেশি ব্যক্তির ভিসা সুবিধায় বিধি–নিষেধ আরোপ করতে পারবে। কেন যুক্তরাষ্টের দরকার পড়লো এ নীতিটি করার? যে কেউ এর আওতায় পড়তে পারেন, সরকারের লোকজন, বিচার বিভাগের সদস্য, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বা বিরোধী দলের কেউ। ভোটারদের ভয় দেখানো, ভোট কারচুপি, বাকস্বাধীনতাকে অগ্রাহ্য করা বা সমাবেশ করার অধিকারকে অগ্রাহ্য করাকে সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যাহত কোর অপচেষ্টা হিসেবে ধরা হবে। দৃশ্যত এতে বেশি টার্গেটে পড়বে ক্ষমতাসীন পক্ষ। যদিও সরকার ও বিরোধীদের উভয়ের ক্ষেত্রেই ন্যায্যতার ভিত্তিতে, গঠনমূলক পদ্ধতিতে এবং সমানভাবে এই নীতি বাস্তবায়নের কথা জানানো হয়েছে। এর আরেক অর্থ হচ্ছে, আদেশদাতা এবং আদেশগ্রহণকারী উভয়েই এই শাস্তির আওতায় আসবে।
মোটামোটি বোঝাই যাচ্ছে, নয়া ভিসানীতিটির বহুমাত্রিকতা। রাষ্ট্র ও সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে মাঠ প্রশাসন পর্যন্ত এ পদক্ষেপের আওতায় বেশি পড়বে। বিশেষ করে বিগত দুটি নির্বাচনে যেসব বাহিনী ভোটাধিকার হরণে বেপরোয়া ছিল তাদের সানে এখন নানা ঝুঁকি। পরিবারের সদস্যের রক্ষা করা অনেকের পক্ষেই কঠিন হবে। এরইমধ্যে সেই যন্ত্রণায় পড়ে গেছেন অনেকে। ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি ভন্ডুলে নেতৃত্বদানকারী বাহিনী কর্মকর্তারা সরাসরি এতে আক্রান্ত হতে যাচ্ছেন প্রায়। সামনের দিনগুলোতে অতিউৎসাহীর সংখ্যা কমে আসতে পারে। ইলেকশন ইঞ্জিনীয়ারিংয়ে জড়িত দলবাজ ও উচ্চাভিলাষী আমলাদের জন্যও বিপদ অপেক্ষা করছে। বর্তমান, সাবেক, ভবিষ্যৎ ৩ শ্রেণিই ঝুঁকিতে পড়ে গেল।
নির্বাচন প্রক্রিয়ায় আদালতকে যথেচ্ছ ব্যবহারের নোংরা দৃষ্টান্ত স্থাপন হয়েছে গত দুটি নির্বাচনে। আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে গত নির্বাচন অর্ধশতাধিক আসনকে বিএনপির প্রার্থীমুক্ত করে ফেলা হয়েছিল। বিচারকদের দিকে নজর রাখার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে নতুন ভিসা নীতিতে। দুদক, এনবিআর, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বিরোধীদের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের হাতিয়ারে পরিনত করা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের কর্তারাও মার্কিন কালো তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে গেলেন। স্বাধীনচেতা গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান, সাংবাদিক ও সুশীল সমাজসহ গণতন্ত্রমনা বিবেকবান নাগরিকদের বাকস্বাধীনতাসহ নিরাপত্তা বিধানের চেষ্টা আছে মার্কিন নতুন ভিসানীতিতে।
চাইলে এখন থেকেই এ সুযোগ কাজে লাগাতে পারবেন মুক্তমনা ও আত্মমর্যাদাশীলরা। যেসব রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একতরফা ও পাতানো নির্বাচনের সঙ্গী হবে সেসব দলের নেতারা এই নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হবেন। ফলে অতীতের মতো আওয়ামী লীগ যেনতেনভাবে নির্বাচনী বৈতরণি পার হতে চাইলে সঙ্গী পেতে বেশ বেগ পেতে হতে পারে। পেশাজীবি ও নাগরিক সমাজের নেতৃস্থানীয় যারা ফ্যাসিবাদ টিকিয়ে রাখতে নির্লজ্জ ভূমিকা পালন করে চলেছেন তাদের
জন্যেও সতর্কবার্তা রয়েছে। বলা বাহুল্য নামে ভিসানীতি হলেও এর অ্যাকশন কেবল ভিসায় থাকছে না। এর বিস্তার আরো নানান দিকে। এত কিছু লোকের বিপদে পড়ার বার্তা আছে। পাশাপাশি দলবাজি ক্ষ্যান্ত দিয়ে নিরপেক্ষভাবে কাজ করার একটি তাড়নাও তৈরি করতে পারে বাদবাকিদের মধ্যে।
লেখক: ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক বাংলা পোস্ট
প্রকাশক, বাংলাদেশ জ্ঞান সৃজনশীল প্রকাশনা