Image description

গোলাম কিবরিয়া পিনু: কবি কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি হিসেবে রাষ্ট্রীয় বাতাবরণ থেকে নির্ধারণ করা হয়েছে। সেই জাতীয় কবির চেতনাকে আমরা কতটুকু গ্রহণ করতে পেরেছি? সেই প্রশ্নের উত্তর বিবেচনায় স্থির করা জরুরি। নজরুলের চেতনায় যে ভ‚মি জেগে ওঠে, সেই ভ‚মির বিশাল এলাকা জুড়ে যে ফসলের স্থিতি-তা হলো অসাম্প্রদায়িকতাবোধ। নজরুলের সময়ে অসাম্প্রদায়িকতার ফসল লালন করে বেড়ে তোলা ছিল একজন মানবমুখী মানুষের আগামীর দিকে চেয়ে থাকা দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়; যে পরিচয় সে সময়ে অনেক কবি, রাজনীতিক, সমাজকর্মী দেখাতে পারেননি। নজরুল এইদিক থেকে আলাদা বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। আর এই উজ্জ্বলতা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ থেকেও উন্মুখ হয়েছে। নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা একাকার।

মুক্তিযুদ্ধের পর বহুদিন চলে গেছে, নজরুলের সময়ও আরও দীর্ঘ পশ্চাতে চলে গেছে-এরপরও আমরা নজরুলকে টেনে আনি আনুষ্ঠানিকতায়, উৎসাহে, কখনো কখনো বড় বেশি আয়োজনে। কিন্তু নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে গ্রহণ না করেও এরশাদ সরকার রাষ্ট্রীয় ধর্মের গোড়াপত্তন করে-জাঁকজমক অবস্থানে কবিকে উপস্থাপন করেছিল। এ ধারা থেকে কি আমরা এখনো মুক্ত হতে পেরেছি?
এই উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক অমানবিকতার পশুধর্মী লোমশ পা যখন নিরীহ মানুষের উঠানে গিয়ে উপস্থিত হয়ে নিরীহ শিশুকে ক্ষত-বিক্ষত করছে, তখন নজরুল আমাদের নির্দিষ্ট করে দেয়-অসাম্প্রদায়িকতার শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে পথ চলার; সে পথে না চললে মুক্তি নেই। নজরুলের গোটা সাহিত্যের অন্যতম মূল সুর অসাম্প্রদায়িকতা, তবে এখানে আলোচনা তাঁর চিঠিপত্রকে কেন্দ্র করে। চিঠিপত্র যে কোনো মানুষের আবেগ, প্রকাশ্যতা ও মনের গভীরতা থেকে উৎসারিত হয়। এই উৎস থেকে লক্ষ করি যে নজরুল ছিলেন-একজন অসাম্প্রদায়িক মানুষ, যে মানুষটি আমাদের জাতীয় কবি হিসেবে আমাদের হৃদয়ে অবস্থান করছেন।

১ মার্চ, ১৯২৬ সালে আনওয়ার হোসেনকে লেখা চিঠিতে কবি লিখেছেন-“আমাদের বাঙালী মুসলমানের সমাজ, নামাজ পড়ার সমাজ। যত রকম পাপ আছে, করে যাও-তার জবাবদিহি করতে হয় না এ সমাজে,-কিন্তু নামাজ না পড়লে তার কৈফিয়ত তলব হয়।” উল্লিখিত পঙ্ক্তিতে কবি ব্রিটিশ আমলেই ‘বাঙালী’ এর অস্তিত্বকে গ্রহণ করেছিলেন! তিনি লক্ষ করেছেন-মুসলমানের নাম নিয়ে সমাজের এক শ্রেণির মানুষ বহুধর্মী পাপকর্ম চালিয়ে যায়। সেই সময়ে তা যেমন সত্য ছিল, আজও তা সত্য। মুসলমানের লেবাস পরেই একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় এক শ্রেণির অমানুষ কু-কর্মকে ইতিহাসে চিহ্নিত করেছে। নামাজ পড়া এক শ্রেণির লোক কি এখনো ঘুষ-দুর্নীতি আমাদের সমাজে করে না? খোলা চোখে দেখে তা আমরা সহজেই উপলব্ধি করতে পারি।

১৯২৬ খ্রিঃ এর ১০ এপ্রিলে ‘কালিকলম’ পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক ও কবির বাল্যবন্ধু শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়কে লেখা চিঠিতে দুঃখাক্রান্ত মনে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার চিত্রকে শ্লেষ আর ঋজু মনোভঙ্গিতে বলেছেন-‘আমি এবার কলকাতায় গিয়েছিলুম-আল্লা আর ভগবান-এর মারামারির দরুন... তোমার কাছে যেতে পারিনি।” সেই সময়ে মানুষের মধ্যে জেগে ওঠা পশুত্বে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি হয়েছিল। সেই দাঙ্গার প্রকোপ এখনো এই উপমহাদেশে কমেনি!

১৩৩৪ সালের ভাদ্র সংখ্যা নওরোজ-এ কবিকে লেখা অধ্যক্ষ ইব্রাহীম খাঁ-র একটি পত্র প্রকাশিত হওয়ার পর ১৩৩৪ সালের পৌষ সংখ্যা সওগাতে নজরুল তার উত্তরে এক দীর্ঘ পত্র লেখেন, এই পত্রটি একটি বড় প্রবন্ধের মতো। এতে নজরুল মানসের বিভিন্ন দিক ফুটে উঠেছে। কবি বলেছেন-“বাঙলার মুসলমান সমাজ ধনে কাঙাল কিনা জানিনে, কিন্তু মনে যে কাঙাল এবং অত্রিমাত্রায় কাঙাল, তা আমি বেদনার সঙ্গে অনুভব করে আসছি বহুদিন হতে। আমায় মুসলমান সমাজ ‘কাফের’ খেতাবের যে শিরোপা দিয়েছে, তা আমি মাথা পেতে গ্রহণ করছি। একে আমি অবিচার বলে কোনদিন অভিযোগ করেছি বলে ত মনে পড়ে না। তবে আমার লজ্জা হয়েছে এই ভেবে, কাফের আখ্যায় বিভ‚ষিত হবার মত বড় ত আমি হইনি। অথচ হাফেজ-খৈয়াম-মনসুর প্রভৃতি মহাপুরুষদের সাথে কাফেরের পঙ্ক্তিতে উঠে গেলাম।” সেই সময়ে ধর্মীয় সংকীর্ণতা ও ভেদবুদ্ধিকে নজরুল গ্রহণ না করে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন বলেই, এক ধরনের তথাকথিত মুসলমানরা তাঁর প্রতি অসন্তুষ্ট শুধু হননি, ‘কাফের’ বলে তাঁকে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। কবি চেয়েছিলেন-মানুষে মানুষে ভেদাভেদ থাকবে না, থাকবে না ধর্মীয় বিচারের মাধ্যমে মানুষকে ছোট করার প্রবণতা। এই উদার মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে নজরুলকে লক্ষ্য করে বারবার তীব্র যন্ত্রণাদায়ক তীর নিক্ষেপ করা হয়েছে, এই তীরন্দাজরা কি এখন নেই? একই প্রক্রিয়ায়, একই মধ্যযুগীয় মানসিকতায় নজরুলের মানসজাত বুদ্ধিজীবী-লেখকদের বর্তমান সময়ের বাংলাদেশেও তীরবিদ্ধ হতে হচ্ছে। নজরুলকে গ্রহণ করতে গেলে, শত্রæদের চিহ্নিত করতে হবে। না হলে নজরুলের মানসিকতার ভিত্তিভূমি আমরা উজ্জ্বলভাবে গ্রহণ করতে পারবো না। নজরুলের শত্রæরা আজও শত্রুতার বিষকাঁটা বিছিয়ে পথচলাকে ব্যাহত করার স্পর্ধা দেখাচ্ছে। বিষকাঁটা উপরে ফেলে তাদের বিষদাঁতও ভেঙে ফেলতে হবে, কেননা সেই শত্রুরা আরও শক্ত সামর্থ্যরে বিষদাঁত দিয়ে কামড় দিচ্ছে মানবিকতার সরল-সজীব প্রবাহমুখী মানুষকে।

নজরুল এই চিঠিতে আরও উল্লেখ করেছেন যে, “এ কুম্ভকর্ণ-মার্কা সমাজকে জাগাতে হলে আঘাত দিয়েই জাগাতে হবে। একদল প্রগতিশীল বিদ্রোহীর উদ্ভব না হলে এর চেতনা আসবে না।” সমাজের মধ্যে যে পাথরসম স্থবির পুরনো মানসিকতার দিক খুঁজে পাওয়া যায়-তা দূর করার জন্যে নজরুল প্রগতিশীল বিদ্রোহী মানুষের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন। সেই প্রয়োজনীয়তা এখনো যে রয়েছে, তা আমরা উপলব্ধি করছি-বিশেষ করে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় এখনো আমাদের!

এই দীর্ঘ চিঠির এক স্তবকে কবি তাঁর অভিজ্ঞতা ও জীবনমুখী চেতনার ওপর ভিত্তি করে বলেছেন যে, “হিন্দু-মুসলমানের পরস্পরের অশ্রদ্ধা দূর করতে না পারলে যে এ পোড়া দেশের কিছু হবে না।” এই সত্য কথাটি কি আমরা সবাই এই দেশে গ্রহণ করে থাকি? নজরুলকে যারা গ্রহণ করি, তাদের অনেকের কণ্ঠে ও আচরণে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির ছোঁয়া, এরাই হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টিতে তৎপর। এদের তৎপরতায় নজরুল যেমন খণ্ডিত, তেমনি আমাদের সমাজকেও বিভেদ রেখায় খণ্ডিত করা হয়ে থাকে। এরা নজরুলকে নিয়ে অনেক সময় বেশি মাত্রায় লাফালাফি করে থাকে, এরা নজরুলের মর্মবেদনায় জেগে ওঠা সাহিত্য ও জীবনবোধের মমার্থকে গ্রহণ করে না। এদের চোরাস্রোতে নজরুল আটকে থাকে, এটা নজরুল চর্চার ক্ষেত্রে এক ট্র্যাজেডি। এই ট্র্যাজিক অবস্থা থেকে নজরুলকে মুক্ত করে তাঁর সচল ধারায় সম্পর্কিত করে রাখতে হবে।

উল্লিখিত চিঠিতে তিনি আরও বলেছেন-“বাঙলা-সাহিত্য হিন্দু-মুসলমানের উভয়ের সাহিত্য। এতে হিন্দু দেব-দেবীর নাম দেখলে মুসলমানের রাগ করা যেমন অন্যায়, হিন্দুরও তেমনি মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবন-যাপনের মধ্যে নিত্য-প্রচলিত মুসলমানী শব্দ তাদের লিখিত সাহিত্যে দেখে ভ‚রু কোঁচকানো অন্যায়। আমি হিন্দু-মুসলমানের মিলনে পরিপূর্ণ-বিশ্বাসী।”

কবি হিন্দু-মুসলমানের মিলনে পরিপূর্ণ বিশ্বাসী বলেই তাঁর সাহিত্যের সমস্ত শাখায় অসাম্প্রদায়িকতার বিষয়টি উচ্চকিত হয়েছে, যা তাঁর চিঠিপত্রে আরও সরাসরি, আরও সংহতভাবে উন্মুখ হয়েছে। এ মানবিক মিলনের তাৎপর্য এখনো কমেনি বরং বেড়েছে। যখন সাম্প্রদায়িকতার উন্নাসিক হাওয়া আমাদের পরিবেশে-প্রতিবেশে এখনো বহমান। তাই নজরুলের ১২৫তম জন্মজয়ন্তীতে তার অসাম্প্রদায়িক চেতনায় অবগাহন করেই নজরুল চর্চাকে সমৃদ্ধ করতে হবে। এর ফলে আমাদের রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্র থেকে শুরু করে সমাজের সর্বক্ষেত্রে নজরুলী আস্থায় জেগে উঠে আগামীর পথচলাকে আরও গতিশীল, আরও সংহত করতে হবে।

মানবকণ্ঠ/এআই