বঙ্গবন্ধুর ‘জুলিও-কুরি’ প্রাপ্তির সুবর্ণজয়ন্তী

- অনলাইন ডেস্ক
- ২৩ মে ২০২৩, ১৬:১১
ড. মিল্টন বিশ্বাস: রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বিশ্বে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর ‘জুলিও-কুরি’ শান্তি পদক প্রাপ্তির সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছি আমরা। কারণ যুদ্ধের বিশ্বে শান্তির ললিত বাণী মানুষকে আতঙ্ক থেকে রক্ষার জন্য খুব বেশি কাজে লাগতে পারে। যুদ্ধজনিত সংকট থেকে সমগ্র মানবসমাজকে রক্ষার জন্য দেশে দেশে মহাঐক্য তৈরির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্রের পাশে এসে দাঁড়াতে হবে আরেক রাষ্ট্রকে, মানুষের জন্য সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে আরেক মানুষকে। বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সম্মিলিতভাবে আতঙ্ক মোকাবিলার প্রত্যয় ঘোষণা জরুরি হয়ে পড়েছে- যেখানে দুর্দশায় পতিত মানবজাতিকে উদ্ধারের জন্য নিজের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ব্যবহার করা দরকার মনে করছেন সকলেই- এসবই ছিল বঙ্গবন্ধুর মধ্যে। এজন্যই বিশ্ব শান্তি পরিষদ বিশ্বের নিপীড়িত, নির্যাতিত মানুষের নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘জুলিও-কুরি’ শান্তি পদকে ভূষিত করে ‘বিশ্ববন্ধু’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের পর বিশ্বশান্তি পরিষদের সর্বোচ্চ পুরস্কার এই জুলিও-কুরি শান্তিপদক।
সাম্য-মৈত্রী, গণতন্ত্র রক্ষায় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ জীবদ্দশাতেই বিশ্ব শান্তি পরিষদের পক্ষ থেকে পাওয়া এই পুরস্কার বঙ্গবন্ধু উৎসর্গ করেছিলেন বাংলাদেশ তথা তৃতীয় বিশ্বের অসহায় মানুষদের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই শান্তি পদক সম্পর্কে বলেছেন- ‘বঙ্গবন্ধুর ‘জুলিও-কুরি’ শান্তি পদকে ভূষিত হওয়া ছিল বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় তার অবদানের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। বাংলাদেশের জন্য প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মান।’
১০ অক্টোবর ১৯৭২ সালে বিশ্ব শান্তি পরিষদের প্রেসিডেন্সিয়াল কমিটির সভায় পৃথিবীর ১৪০টি দেশের এই পরিষদের ২০০ প্রতিনিধির উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুকে জুলিও-কুরি শান্তি পদক প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। শোষিত ও বঞ্চিত জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তথা বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বিশ্বশান্তি পরিষদের সর্বোচ্চ সম্মান ‘জুলিও-কুরি’ পুরস্কারে ভ‚ষিত করা ছিল তৎকালীন বিশ্ব পরিস্থিতিতে অসামান্য একটি ঘটনা। পরের বছর ১৯৭৩ সালের ২৩ মে বিশ্বশান্তি পরিষদের উদ্যোগে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এশীয় শান্তি সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও-কুরি’ পদক প্রদান করেন ওই পরিষদের সেক্রেটারি-জেনারেল রমেশ চন্দ্র। সেসময় এশিয়ান পিস এন্ড সিকিউরিটি কনফারেন্স অনুষ্ঠান উপলক্ষে বিশ্ব শান্তি পরিষদ ঢাকায় দুই দিনব্যাপী এক সম্মেলনের আয়োজন করে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে বিশ্ব শান্তি পরিষদের শাখাগুলোর নেতৃবর্গ এই সভায় মিলিত হন। বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ছাড়াও আপসো, পিএলও, এএমসি সোয়াপো ইত্যাদি সংস্থার অনেক প্রতিনিধি সেসময় উপস্থিত হয়েছিল। অনুষ্ঠানে ভারতের ৩৫ জন প্রতিনিধির নেতা কৃষ্ণমেনেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শান্তি আন্দোলনের প্রখ্যাত নেতা জন রিড উপস্থিত ছিলেন। সেদিন ঢাকায় অনুষ্ঠিত ওই এশীয় শান্তি সম্মেলনের ঘোষণায় উপমহাদেশে শান্তি ও প্রগতির শক্তিগুলোর অগ্রগতি নিশ্চিত করে।
অধিবেশনের দ্বিতীয় দিন ২৩ মে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের উত্তর প্লাজায় উন্মুক্ত চত্বরে সুসজ্জিত প্যান্ডেলে বিশ্ব শান্তি পরিষদ আয়োজিত অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিক কূটনীতিকদের বিশাল সমাবেশে বিশ্ব শান্তি পরিষদের তৎকালীন মহাসচিব রমেশ চন্দ্র বঙ্গবন্ধুকে জুলিও-কুরি শান্তি পদক পরিয়ে দিয়ে বলেন, ‘শেখ মুজিব শুধু বঙ্গবন্ধু নন, আজ থেকে তিনি বিশ্ববন্ধুও বটে।’ এ সম্মান পাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এ সম্মান কোনো ব্যক্তি বিশেষের জন্য নয়। এ সম্মান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মদানকারী শহীদদের, স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সেনানীদের। ‘জুলিও-কুরি’ শান্তিপদক সমগ্র বাঙালি জাতির।’
আগেই বলেছি, বিশ্বশান্তি পরিষদের এ পদক ছিল জাতির পিতার কর্মের স্বীকৃতি এবং বাংলাদেশের জন্য প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মান। নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত বিশ্ববিখ্যাত ফরাসি বিজ্ঞানী ম্যারি কুরি ও পিয়েরে কুরি দম্পতি বিশ্ব শান্তির সংগ্রামে যে অবদান রেখেছেন, তা স্মরণীয় করে রাখতে ‘বিশ্ব শান্তি পরিষদ’ ১৯৫০ সাল থেকে ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামে, মানবতার কল্যাণে, শান্তির সপক্ষে বিশেষ অবদানের জন্য বরণীয় ব্যক্তি ও সংগঠনকে ‘জুলিও-কুরি’ শান্তি পদকে ভ‚ষিত করে আসছে।
উল্লেখ্য, জঁ ফ্রেদেরিক জুলিও-কুরি (১৯০০-১৯৫৮) এবং স্ত্রী ইরেন জুলিও-কুরি (১৮৯৭-১৯৫৬) অদ্যাবধি সফল বিজ্ঞানী দম্পতি হিসেবে চিহ্নিত। ফিদেল ক্যাস্ট্রো, হো চি মিন, ইয়াসির আরাফাত, সালভেদর আলেন্দে, নেলসন ম্যান্ডেলা, ইন্দিরা গান্ধী, মাদার তেরেসা, কবি ও রাজনীতিবিদ পাবলো নেরুদা, জওহরলাল নেহেরু, মার্টিন লুথার কিং, লিওনিদ ব্রেজনেভ প্রমুখ বিশ্ব নেতা এই পদকে ভূষিত হয়েছেন। সে সময় ‘জুলিও-কুরি’ শান্তি পুরস্কারের মর্যাদা শান্তিতে নোবেলের চাইতে অনেক বেশি ছিল। অতীতে পুরস্কারপ্রাপ্ত মহান ব্যক্তিদের মতোই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ছিলেন বিশ্বের মুক্তিকামী, নিপীড়িত, মেহনতি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা। শান্তি, সাম্য, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন। জেল, জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতন সহ্য করেছেন। তার অতুলনীয় সাংগঠনিক ক্ষমতা, রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞা, মানবিক মূল্যবোধ, ঐন্দ্রজালিক ব্যক্তিত্ব বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ করে। তাঁর নির্দেশে বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়।
বঙ্গবন্ধুকে কেন ‘জুলিও-কুরি’ শান্তি পুরস্কার প্রদান করা হয়েছিল তার ব্যাখ্যা দেবার জন্য উপরের বিবরণ প্রয়োজন ছিল। কারণ এই শান্তি পদক এক অসামান্য কীর্তির স্মারক, মর্যাদা ও বিশ্ব শান্তির প্রতীক। মূলত বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ছিল জোট-নিরপেক্ষ নীতি এবং শান্তি ও ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ।
তিনি বলেছিলেন- ‘পৃথিবীর বৃহত্তম শক্তি যে অর্থ ব্যয় করে মানুষ মারার অস্ত্র তৈরি করছে, সেই অর্থ গরিব দেশগুলোকে সাহায্য দিলে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা হতে পারে।’ বঙ্গবন্ধু ছিলেন আফ্রো-এশিয়া-ল্যাটিন আমেরিকার মুক্তিকামী মানুষের মহান নেতা এবং গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও শান্তি আন্দোলনের পুরোধা। ১৯৭১-এর পর গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদকে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে ঘোষণার মধ্য দিয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে একটি নতুন দর্শন প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনের পাশাপাশি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংঘাতময় পরিস্থিতির অবসানে তিনি শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পৃথিবীব্যাপী হত্যাযজ্ঞের অভিজ্ঞতা থেকে প্রবর্তিত এই ‘জুলিও-কুরি’ পদক শান্তি প্রতিষ্ঠায় উৎসর্গিত হয়েছিল; পারমাণবিক বোমা আর মারণাস্ত্রের মহড়া থেকে রাষ্ট্রগুলোকে দূরে রাখার জন্যও। যারা পুরস্কৃত হয়েছিলেন তারা কেউ-ই সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর তাঁবেদার ছিলেন না। হিংস্র কিংবা আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাষ্ট্রকে পরিচালিত করেননি ওই ব্যক্তিবর্গ। বরং আজীবন তারা মানবিক বিশ্ব গড়ার চেষ্টা চালিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর ‘জুলিও-কুরি’ শান্তি পদকপ্রাপ্তির সুবর্ণজয়ন্তীর এই দিন স্মরণের মধ্য দিয়ে নতুন প্রজন্মকে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক এবং প্রগতিশীল আদর্শের শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। বিশ্ব শান্তি ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় জাতির পিতার অবদানকে সামলে আনলে যে কোনো সংকট মোকাবিলায় ভবিষ্যতেও আমরা সক্ষম হবো। শেখ হাসিনা সরকার বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় সবসময় জাতির পিতার নীতি ও আদর্শকে অনুসরণ করছে- শান্তির জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
লেখক : অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
মানবকণ্ঠ/এআই


