Image description

রেজাউল করিম খোকন: চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে ভিনদেশি উন্নত জাতের আমের সফল উৎপাদন হচ্ছে এখন। ভারত, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ব্রাজিল, পাকিস্তানের উন্নতজাতের আম উৎপাদন করে সফল হয়েছেন স্থানীয় আমচাষি এবং বেশ কিছু এগ্রো প্রতিষ্ঠান। প্রাথমিক অবস্থায় স্থানীয় আমচাষি, এগ্রো প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলগুলোর মধ্যে বান্দরবান, লামা, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, কাপ্তাইসহ বিভিন্ন এলাকায় পাহাড় আবাদ করে পরীক্ষামূলকভাবে উন্নতমানের আমের চাষ শুরু করে প্রায় ২৩ বছর আগে থেকে। চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকাগুলো উন্নতজাতের আম চাষের উপযোগী হওয়ায় আমচাষিরা লাভের মুখ দেখতে পায়। তারপর ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে অসংখ্য আমের বাগান। বর্তমানে চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে ছোট বড় সব মিলিয়ে প্রায় পাঁচ হাজার আমের বাগান রয়েছে। এসব বাগানে প্রায় ৩০ হাজার লোক কর্মরত আছে।

বিভিন্ন এগ্রো প্রতিষ্ঠান পার্বত্য অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে আম চাষে এগিয়ে আসায় এটি বর্তমানে একটি সম্ভাবনাময় লাভজনক, সম্ভাবনায় কৃষি এবং শিল্প উদ্যোগে পরিণত হয়েছে। চট্টগ্রাম শহরসহ রাজধানী ঢাকার বাজারেও মিলছে দেশের পার্বত্য অঞ্চলে উৎপাদিত এসব বিদেশি জাতের আম। বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে রাজশাহী অঞ্চলের আমের একচ্ছত্র আধিপত্য খর্ব করেছে তিন পার্বত্য জেলায় উৎপাদিত উন্নতমানের বিদেশি সুস্বাদু আম। বর্তমানে ছোট বড় মিলিয়ে অর্ধশতাধিক প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি এবং প্রান্তিক পর্যায়ের বহু উদ্যোক্তা-চাষি পাহাড়ে আমের আবাদ করছেন। তিন পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবানের মধ্যে বেশির ভাগ আম বাগান রয়েছে বান্দরবানে।

এখানেই রয়েছে কৃষিভিত্তিক বড় বড় এগ্রো ফার্মগুলোর ফলের বাগান। পার্বত্য অঞ্চলে উৎপাদিত আমগুলোর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে খুব মিষ্টি, সুস্বাদু, আঁশবিহীন, ছোট আটিযুক্ত। দিন দিন এসব আমের চাহিদা কেবল বৃদ্ধি পাচ্ছে। উৎপাদিত ভিন্নদেশি বিভিন্ন জাতের এসব আম বর্তমানে চট্টগ্রাম ও ঢাকা শহরের সুপারশপ ছাড়াও বিভিন্ন এগ্রো প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব বিক্রয়কেন্দ্রে পাওয়া যাচ্ছে। অনলাইনেও এসব প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব বিক্রয়কেন্দ্রে পাওয়া যাচ্ছে। অন লাইনেও এসব প্রতিষ্ঠান থেকে আম কেনার চমৎকার সুযোগ রয়েছে। এখন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ক্রেতারা অনলাইনে যোগাযোগ করে পার্বত্য অঞ্চলে উৎপাদিত আম কিনছেন। পার্বত্য অঞ্চলে উন্নত জাতের আম উৎপাদনে আম চাষিদেরকে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।

এসব সমস্যার মধ্যে রয়েছে আম উৎপাদনে প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব, পর্যাপ্ত কীটনাশকের অভাব, সারের অভাব, দুর্গম পাহাড়ে যাতায়াতের অসুবিধা, বিদ্যুৎ সমস্যা, কৃষি ঋণের দুষ্প্রাপ্যতা, বাজারজাতকরণ সমস্যা, সংরক্ষণ ব্যবস্থার অভাব, আম প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবস্থার অভাবসহ বিভিন্ন সমস্যা। আম সংরক্ষণের যথাযথ ব্যবস্থা না থাকায় উৎপাদিত আম পচে নষ্ট হয়ে যায়। এতে আমচাষিরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। আমচাষিরা আমের ন্যায্য দাম পায় না। বিশেষ করে পার্বত্য অঞ্চলে আমের প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা না থাকায় প্রতি বছর হাজার হাজার টন আম পচে নষ্ট হয়ে যায়। আমচাষিরা এবারও আম নষ্ট হওয়ার সমস্যায় ভুগছেন।

আমচাষিদের প্রধান দাবি, পার্বত্য অঞ্চলে আমের প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা গড়ে তোলা। এ ব্যাপারে সরকারের বিশেষ উদ্যোগ আশা করছেন আমচাষিরা। পার্বত্য অঞ্চলে আমের প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা গড়ে উঠলে আমের অপচয় কমবে। আমচাষিরা আম উৎপাদন করে ন্যায্যমূল্য পাবে। সরকার ছাড়াও বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পার্বত্য অঞ্চলে শিল্প প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমের বিভিন্ন প্রোডাক্ট তৈরি করতে পারেন। এতে সবাই উপকৃত হবে। চট্টগ্রামসহ তিন পার্বত্য জেলায় হিমাগার (কোল্ড স্টোরেজ) নির্মাণ করা গেলে পার্বত্য অঞ্চলে উৎপাদিত আম সারা বছর ধরে খেতে পারবে মানুষ।

পাহাড়ি এলাকার আমচাষিদের জন্য স্বল্পখরচে পরিবহন সুবিধা ও সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করা গেলে পাহাড়ি এলাকায় আম উৎপাদনে দারুণ এক বিপ্লব ঘটতে পারে। আমের জুস প্রক্রিয়াকরণসহ আমের বিভিন্ন ধরনের সুস্বাদু খাবার তৈরির কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে পার্বত্য জেলায় উৎপাদিত আমের বহুমুখী ব্যবহার বাড়ানো যায়। চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে উন্নত জাতের আম উৎপাদনে সরকারের পক্ষ থেকে কারিগরি সহযোগিতা প্রদান, স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা, উন্নত যোগাযোগের ব্যবস্থা বিদ্যুতের ব্যবস্থা এবং আম সংরক্ষণের ব্যাপারে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করলে আমাদের দেশ আম উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠবে। উন্নতজাতের আম চাষ এবং উৎপাদন একটি লাভজনক, সম্ভাবনায় কৃষি উদ্যোগ এবং শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে জাতীয় অর্থনীতিতে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবে।

পাহাড়ে একসময় শুধু জুম চাষ হতো। এখন সমতলের মতো অনেক ফসল চাষ করা যাচ্ছে। পাহাড়ের বৃহৎ এলাকাজুড়ে কফি, কাজুবাদাম, গোলমরিচ, পেঁপে, আনারস, আরম, ড্রাগন, মাল্টাসহ ৮-১০টি অর্থকরী ফসলের চাষ অনেক সম্ভাবনাময়। বিশেষ করে দেশে ও আন্তর্জাতিক বাজারে কাজুবাদাম ও কফির বিশাল চাহিদা রয়েছে, দামও অনেক বেশি।

সেজন্য, এসব ফসলের চাষাবাদ ও প্রক্রিয়াজাত বাড়াতে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। এসব ফসলের চাষ আরো ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে পারলে পাহাড়ের অর্থনৈতিক চেহারা পাল্টে যাবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম দেশের অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করবে ও বিশাল ভূমিকা রাখবে। পাহাড়ি এলাকার মানুষের জীবনযাত্রার মানের দর্শনীয় উন্নয়ন হবে।

একইসঙ্গে, দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করেও প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা যাবে। কফি ও কাজুবাদামের আবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধি এবং প্রক্রিয়াজাতে সরকারি সব ধরনের সহযোগিতা প্রদান করা হচ্ছে। এসব ফসলের চাষ জনপ্রিয় করতে কৃষক ও উদ্যোক্তাদের আমরা বিনামূল্যে উন্নত জাতের চারা, প্রযুক্তি ও পরামর্শসেবা প্রদান করে হচ্ছে। এখন পর্যন্ত কফি ও কাজুবাদামের ১২ লাখ চারা বিনামূল্যে কৃষকদের দেয়া হয়েছে; আর এ বছর আরো ২০ লাখ চারা দেয়া হবে। পাহাড়ে কাজুবাদাম ও কফি চাষের সম্প্রসারণের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ২১১ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ২০২০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় কাজুবাদাম চাষ হতো ১৮০০ হেক্টর জমিতে, এখন হচ্ছে ৩৫০০ হেক্টর জমিতে, আর ২০২০ সালে কফি চাষ হতো ১২৫ হেক্টর জমিতে, এখন হচ্ছে ১৩৫০ হেক্টর জমিতে।

ছোট ছোট কৃষি উদ্যোগে ফলভাণ্ডার হয়ে উঠছে তিন পার্বত্য জেলা- রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি। তিন জেলায় ৪০ হাজার ছোট-বড় উদ্যোক্তা ফল চাষে যুক্ত হয়েছেন। তাদের হাত ধরে পাহাড়ি এলাকায় আম, কলা, কাঁঠাল, পেঁপে, আনারস, কমলাসহ ৪৪ জাতের ফল উৎপাদিত হচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, সারাদেশে উৎপাদিত ফলের প্রায় ১৫ শতাংশ এখন আসে এই তিন পার্বত্য জেলা থেকে। পাহাড়ের ফল এখন পাওয়া যাচ্ছে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, তিন পার্বত্য জেলায় উৎপাদিত মোট ফলের প্রায় ৮১ শতাংশই ছয়টি ফল- আম, কাঁঠাল, কলা, পেঁপে, আনারস ও কমলা। এসব ফল ছাড়াও এখন ড্রাগন, কাজুবাদাম, জলপাই, আপেল কুলসহ ৩৮টি ফল উৎপাদিত হয়। তিন জেলার ফলচাষি, কৃষিবিদ, ব্যবসায়ী ও সাধারণ ভোক্তাদের মতে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তির কল্যাণে জুমচাষ ছেড়ে স্থায়ী বাগান করার প্রবণতা ও বিপণন আগের চেয়ে সহজ হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামে ফল চাষ বাড়ছে। পাশাপাশি শিক্ষিত উদ্যমী তরুণেরা এই খাতে আসায় নতুন উদ্যোক্তাও তৈরি হয়েছে। দুই দশক আগেও পাহাড়ে বাণিজ্যিকভাবে ফল চাষ হতো না। ২০০০ সাল থেকে মূলত বাণিজ্যিকভাবে ফলের বাগান করা শুরু হয়। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে ফলবাগানের সংখ্যা। পাহাড়ি জমিও ফল চাষের আওতায় আসতে থাকে। পাহাড়ের মাটি এবং আবহাওয়া আম, কাঁঠাল, কলা, পেঁপে, আনারস ও মাল্টা চাষের উপযোগী। প্রতিবছর তিন পার্বত্য জেলায় গড়ে ১০ শতাংশের বেশি এসব ফলদ বাগান বাড়ছে। তা ছাড়া বসতঘরের আশপাশেও অনেকে বিশেষ করে আম, মাল্টা ও কলাগাছ লাগাচ্ছেন। বাগান করে অনেক কৃষক অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হচ্ছেন। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে বমরা আগে থেকেই ফল চাষ করেন। অন্যরা মূলত পার্বত্য চুক্তির পর এই কাজে যুক্ত হন। আম, কাঁঠাল, কলা, আনারস, পেঁপে, কমলাবাগানে শুরু হলেও এখন ফলের বৈচিত্র্য বেড়েছে। এ অঞ্চলের ফল যাচ্ছে সারা দেশে। অনেকেই এখন ফল ব্যবসায় নেমেছেন। অনলাইনে বিপণন শুরু হওয়ায় অনেক ফল চাষি এখন নিজেই নিজের উৎপাদিত ফল সরাসরি ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দিতে পারছেন। প্রান্তিক, ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বড় কৃষকের সংখ্যা হিসাবে তিন জেলায় প্রায় ১৬ লাখ মানুষের মধ্যে ২৫ শতাংশ মানুষ ফল উৎপাদনের নির্ভরশীল।

পাহাড়ি ফলবাগানিরা বলছেন, জুমচাষে আগের মতো ফলন হয় না। তিন-চার মাসের খোরাকও পাওয়া যায় না। অন্যদিকে ফল উৎপাদন করলেই নগদ টাকা পাওয়া যায়। বান্দরবান-চিম্বুক-থানচি সড়কের চিম্বুকপাহাড় ও থানচি পর্যন্ত ৭০-৮০ শতাংশ পরিবারই মিশ্র ফল ও সবজি উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল। ১৪-১৫ বছর আগের দরিদ্র জুমচাষিদের জীবন বদলে দিয়েছে ফলবাগান ও সবজি চাষ। পার্বত্য জেলায় একজন ফলচাষিকে ফল পরিবহনে জন্য বিভিন্ন সংস্থাকে টোল (মাশুল) দিতে হয়। বাগানি ও ফল ব্যবসায়ীরা চান, একটি সমন্বিত টোলব্যবস্থা- যা তিন জেলায় একই হারে একটি প্রতিষ্ঠান আদায় করবে। দূরত্বের কারণে পার্বত্য জেলার ফল সারা দেশের বাজারে ঠিকভাবে প্রবেশ করতে পারছে না। এ ক্ষেত্রে বাজারব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। এ ছাড়া প্রক্রিয়াজাত কারখানা গড়ে তোলার পাশাপাশি টোল ও অদৃশ্যমান চাঁদার মতো বাধা দূর করতে হবে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক