জীবন সংগ্রামী শেফালীর কথা


  • অনলাইন ডেস্ক
  • ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ১৫:২৩

সাধনা সাহা: ৫০ বছর বয়সী জীবন যুদ্ধে ‘হার না মানা’ এক নারী শেফালী রানী শীলের কথা বলছি। যিনি পেশায় একজন নরসুন্দর। ঝালকাঠির কাঁঠালিয়া উপজেলার শৌলজালিয়া ইউনিয়নের বলতলা গ্রামের দোগনা বাজারে ক্ষুর, কাঁচি, চিরুনি নিয়ে ব্যস্ত যে নারী। মানুষকে সুন্দর করে তুলতে একাগ্রচিত্তে কাজ করে যাচ্ছেন দুই যুগ ধরে। শত শত বাধা পেরিয়ে সমাজের পুরুষদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করে চলেছেন তিনি। আমাদের প্রতিটা পরিবারে যেমন একজন নারীর ভ‚মিকা অপরিসীম, তেমনি আমাদের দেশে বা আমাদের সমাজে সব ক্ষেত্রেই নারীর অবদান রয়েছে। রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ আসন থেকে রান্নাঘর পর্যন্ত একজন নারী অবাধে অবলীলায় বিচরণ করেন। সব কাজে নারীদের অংশগ্রহণ সমানভাবে থাকলেও নরসুন্দর বা নাপিতের কাজে সাধারণত নারীদের দেখা যায় না। অথচ শেফালী রানী শীল জীবন ও জীবিকার তাগিদে প্রায় দুই যুগ ধরে এই পেশায় কাজ করে চলেছেন। প্রত্যন্ত গ্রাম্য এলাকায় একজন নারীর জন্য এমন একটা পেশায় কাজ করা কতটা কঠিন ও দুরূহ। তবুও তিনি থেমে থাকেননি। জীবনের সব প্রতিকূলতা জয় করে এগিয়ে চলেছেন তিনি।

পশ্চিম ছিটকি গ্রামের দরিদ্র যাদব শীলের চতুর্থ সন্তান এই শেফালী। দরিদ্রতার কারণে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করার সুযোগ পেয়েছিলেন। দরিদ্রতার কশাঘাত, আর পরিবারের চাপে বাধ্য হয়ে আতর আলী গ্রামের বিশ্বনাথ শীলের সাথে মাত্র ১২ বছর বয়সে বিয়ে হয় তার। বিয়ে হলেও দরিদ্রতা তার পিছু ছাড়েনি বরং আরো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে তাকে। শুরু হয় দরিদ্রতা মানিয়ে নিয়ে চলতে জীবনের সাথে জীবন যুদ্ধের নতুন আর এক অধ্যায়। জীবনকে বুঝে ওঠার আগেই চার কন্যা ও এক পুত্রের জননী হন তিনি।

একদিকে স্বামীর অবহেলা, তার বেপরোয়া উদাসী জীবন যাপন, অন্যদিকে সন্তানদের সামনে দুমুঠো ভাতের জোগান তার জীবনকে বিষণ্ণতার গ্লানিতে ভরিয়ে তুলছিল। স্বামীর আয়ে সংসার তেমন চলছিল না। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন তার বাবার বাড়িতে থাকবেন। কিন্তু সেখানেও অভাব অনটন তার পায়ে আরো জটিলভাবে বেড়ি পরিয়ে দিল। দরিদ্রতার কশাঘাতে জর্জরিত হয়ে একসময়ে তিনি বাবার বাড়ি থেকে বলতলা গ্রামের দোগনা বাজারে চলে আসেন। সেখানে স্বামীর কাজের পাশাপাশি নিজেও এককেজি, দুইকেজি চালের পরিবর্তে অন্যের বাড়িতে কাজ করে কোনো রকম দিনাতিপাত করছিলেন। কথায় আছে, ‘অভাগা যেদিকে চায়, সাগর শুকিয়ে যায়।’ এই প্রবাদটা শেফালী শীলের জীবনে আবারো সত্য হয়ে এলো।

২০১২ সালে স্বামী জ্বরে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে। অভাবের কারণে ভালো চিকিৎসা করাতে না পারায় তার স্বামী আস্তে আস্তে মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে যান। এভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর একদিন তার স্বামী কাউকে কিছু না বলে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। পাঁচ ছেলেমেয়েসহ নিজের দায়িত্বভার শেফালীকেই নিতে হয়। বাবা সন্তানকে ফেলে চলে যেতে পারে। কিন্তু মা...! মায়ের দেহে যতক্ষণ প্রাণ থাকে ততক্ষণে সে সন্তানের জন্য লড়াই করেই যাবে। সন্তানদের মুখে দুমুঠো ভাত তুলে দেবার জন্য তিনি হাতে তুলে নিয়েছিলেন ক্ষুর, কাঁচি, চিরুনি। বেছে নিয়েছিলেন তাদের জাত পেশাকে।

গ্রামে বাজারের মধ্যে মেয়ে মানুষ পুরুষ লোকের চুল কাটছে প্রথমে কেউ মেনে নিতে পারেনি। অনেকেই তার এই পেশাকে ভালো চোখে দেখেনি। অনেক হাসি-ঠাট্টা, বিদ্রুপ, অসহযোগিতা, সমালোচনাকে উপেক্ষা করে তিনি এগিয়ে গেছেন একাগ্রচিত্তে, দৃঢ় মনোবলে। ‘মুদ্রার যেমন এপিঠ, ওপিঠ দুপিঠই থাকে’ তেমনি সমাজে কিছু ভালো মানুষও থাকে। তেমনি কয়েকজন ভালো মানুষ টাকা তুলে শেফালীকে একটি চুল কাটার চেয়ার কিনে দিয়েছিলেন। তবুও শেফালী রানী দরিদ্রতার কশাঘাতে জর্জরিত হয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখতে ভুলেই গিয়েছিলেন। জীবনের এই কঠিন, কঠোর পথচলা তার কাছে দুর্বিষহ, স্বপ্নগুলো মরীচীকার মতো হয়ে উঠছিল, ঠিক তখনই ২০১৬ সালে ঝালকাঠি জেলার কাঁঠালিয়া ব্র্যাক অফিসের টিইউপি কর্মসূচির আওতায় জরিপের মাধ্যমে চ‚ড়ান্তভাবে তিনি সদস্য নির্বাচিত হন, ফলে শেফালীকে একটা বকনা গরু ও একটা ছাগল প্রদান করা হয়।

শেফালী রানী শীল চুল কাটায় এখন একজন পুরুষ নাপিত থেকেও বেশি সিদ্ধহস্ত। শেফালী রানীর এই দক্ষতার জন্য ২০১৮ সালে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর থেকে তাকে ‘জয়িতা’ সম্মাননা দেওয়া হয়েছিল। তার এই জীবন যুদ্ধের কথা একদিন বলতলা গ্রামের দোগনা বাজার ছাপিয়ে ঝালকাঠির মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। আর তখনই তার জীবনে আসে ভালো থাকা সোনার হরিণের সোনালি আলো। নজরে পড়ে বিবিসি বাংলার। ২০১৯ সালে বিবিসি বাংলা শেফালী শীলকে নিয়ে একটি ভিডিও প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল।

তিনি বলেন, আগে আমার স্বামী চুল কাটতো। আমার স্বামী অসুস্থ হয়ে বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তারপর তিনি নিরুদ্দেশ হয়ে যান। তখন বাচ্চারা কান্নাকাটি করতো। তখন দোকানে বসে চুল কাটা শুরু করি। কারণ আমি যেখানে কাজ করবো সেখানেই আমার বাচ্চারা কান্দুক। প্রথমে মানুষেরা খুব হাসাহাসি করতো। কাটতে চাইতো না। ঝালকাঠির এই দোগনা বাজারের একমাত্র নাপিত আমি। গ্রামের বাজারে প্রতিদিন ১৫০ টাকা থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত আয় হয় আমার। এতে সংসার তেমন চলে না, তাই রাতের বেলায় বিভিন্ন দোকানে দোকানে জল দেই। দোকানগুলোতে জল দিয়ে বাড়ি আসতে আসতে রাত দশটা বেজে যায়।

সংসার সন্তান আর দোকান এক হাতে সামলে তিনি এগিয়ে চলেছেন দৃঢ় প্রত্যয়ে। রান্নাবান্না, ছেলেমেয়েদেরকে স্কুলে পাঠানো, গরু ছাগল দেখাশোনা করে সকাল ৯/১০ দশটায় দোকানে যান আর ফিরে আসেন রাত দশটায়। চুল কাটার আয় থেকে দুই মেয়েকে পড়ালেখা শিখিয়ে বিয়ে দিয়েছেন তিনি। তার দুই মেয়ে ডিগ্রি পাস, ছেলেও এইচএসসি পাস করেছে। ছোট দুই মেয়েও হাইস্কুলে।
শেফালী শীলের মতো জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়া নারীদের একজন। এই সংগ্রামী নারীর জন্য শুভকামনা।

মানবকণ্ঠ/এআই


poisha bazar