আয় বৈষম্য ও সোনায় মোড়ানো জিলাপি


  • অনলাইন ডেস্ক
  • ২৭ এপ্রিল ২০২৩, ১৫:২৯

শেখর ভট্টাচার্য: চমকপ্রদ একটি সংবাদ আর একটি সংবাদের প্রভাবে ম্লান হয়ে যায়। তবে কিছু চমকপ্রদ সংবাদের প্রভাব অনেকদিন থেকে যায়। সেরকম একটি সংবাদ নিয়ে আজকে আলোচনা করছি। সেই আলোচনায় প্রবেশের পূর্বে নিজের জ্ঞান বুদ্ধির পরিধি নিয়ে একটু কথা বলে নেয়া প্রয়োজন। জ্ঞান, বুদ্ধিতে এতো পিছিয়ে আছি, তা’ আবার নতুন করে আবিষ্কার করতে হলো। সোনা ধাতুটি শুধুমাত্র অলঙ্কার তৈরিতে ব্যবহার করা হয় এ বিষয়টি জানা ছিলো। আর জানা ছিলো বিশেষ কোনো অর্জনের জন্য পুরস্কার হিসাবে সোনার মেডেল দেয়া হয়। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে শুনতে পেলাম, রাজধানী ঢাকায় সোনায় মোড়ানো জিলাপি বিক্রি হচ্ছে। আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেলো। আক্কেল হলো বুদ্ধি আর গুড়ুম হলো কামান থেকে বের হওয়ার শব্দ।

আকস্মিক কোনো ঘটনায় আমাদের বুদ্ধি, বিবেচনা মাঝেমধ্যে লোপ পায় বা হারিয়ে যায়। আমার ঠিক সে রকমই হয়েছিলো। আজকাল টাকা পয়সা না থাকলে বিদ্যা, বুদ্ধিও থাকে না। কথাটি আমার ক্ষেত্রে কতোটুকু সত্য, সোনা দিয়ে যে জিলাপি তৈরি করা হয় এবং সে জিলাপি খাওয়ার জন্য মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে এ সমস্ত বিষয়ে অজ্ঞতা তার অকাট্য প্রমাণ।
তবে আক্কেল গুড়ুম হয়েছিলো আর একবার।

তবে দেশি ঘটনায় নয়, সেটি রাশিয়ার ঘটনায়। সোনা খাওয়া নিয়ে নয়, টয়লেট নির্মাণে সোনার ব্যবহারের কথা শুনে। করোনায় যখন সারা বিশ্ব বিপর্যস্ত তখন ২০২১ সালের জুলাই মাসে বিবিসি জানিয়েছিলো, রাশিয়াতে পুলিশের ঘুষ বাণিজ্যের একটি তদন্তে এক কর্মকর্তার বৃহৎ অট্টালিকায় সোনায় মোড়ানো টয়লেটসহ বিভিন্ন বিলাস সামগ্রী পাওয়া গেছে। রুশ তদন্তকারীরা তাদের তদন্ত শেষে সরকারিভাবে বলেছেন, তারা দুর্নীতিবাজ পুলিশের একটি চক্রকে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন। রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা এসকে-এর ওয়েবসাইটে একটি ভিডিও প্রকাশ করা হয়েছে। সে ভিডিওতে বৃহৎ অট্টালিকাসহ সোনায় মোড়ানো টয়লেটের ছবিও প্রদর্শন করা হয়েছে।

রাশিয়ায় ছিল, টয়লেট আর আমাদের দেশে জিলাপি। এক অর্থে আমাদের বিষয়টি অনেক স্বচ্ছ। ওয়েবসাইটে ঘোষণা দিয়ে সোনার জিলাপি বিক্রি আর দুর্নীতিবাজ পুলিশের সোনার টয়লেট। রাশিয়া এক অর্থে “অপচয়কারী বিলাসী” আর আমরা ভোজন বিলাসী। তাই রুচির দিক থেকে থেকে আমরা এগিয়ে। সোনায় মোড়ানো জিলাপি বিক্রির পূর্বে ওয়েব সাইটে ঘোষণাটি ছিলো দেশ ও জাতির জন্য গৌরবের বিষয়! হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ঢাকার মহাব্যবস্থাপক অশ্বিনী নায়ার ঘোষণায় বলেছিলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ পণ্য এখন আর শুধু খাওয়ার বিষয়ই নয়। লোকেরা এখন আর শুধু নামেই বিলাসিতা পেতে চায় না। তারা বিলাসী পণ্যের অনন্য স্বাদ ও অভিজ্ঞতা উপভোগ করতে চায়।’

তিনি আরো বলেছিলেন, ‘ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল এ ধরনের একটি অভিজ্ঞতার মাধ্যমে বাংলাদেশি গ্রাহকদের সেই বিলাসিতা উপভোগের সুযোগ দিতে চায়। এ জন্যই বিশেষ এ জিলাপি বিক্রির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’

এ রকম ঘোষণা যখন শুনতে পেলাম তখন পদাবলীর একটি কলি মনে হয়ে গেলো, কলিটি হলো “কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিলো গো আকুল করিলো মোর প্রাণ।” যতই নিজের জ্ঞান বুদ্ধিকে ধিক্কার দেই না কেন, কিছুটা হলেও গর্বে বুক স্ফীত না হয়ে পারেনি। ঘোষণা শোনার পর নেমে গেলাম নিজের অজ্ঞতা মোচনে। যেখানেই সোনার জিলাপি নিয়ে লেখা পাই, নিজেকে আপডেট করতে থাকি। কলকাতার একটি পত্রিকার বিজ্ঞাপন পড়েছিলাম। দমদম বিমানবন্দরে নেমেই চোখ পড়েছিলো “অমুক পত্রিকাটি পড়তে হবে না হলে পিছিয়ে পড়তে হবে।” যতই হতদরিদ্র হই না কেন, স্মার্ট বাংলাদেশে স্মার্টনেস দেখাতে না পারলে কথা বলার লোক পাওয়া যাবে না।

স্বর্ণখচিত জিলাপি বিষয়ে জ্ঞান আহরণ করতে গিয়ে জানা গেল প্রতি কেজি জিলাপিতে ২৪ ক্যারেটের খাওয়ার উপযোগী সোনার ২০ থেকে ২২টি লিফ বা অংশ পাওয়া যায়। তবে দুঃখের বিষয় একজন গ্রাহকের ন্যূনতম ২৫০ গ্রামের বেশি জিলাপি কেনার সুযোগ নেই। পড়তে পড়তে শেষ পর্যন্ত কমেডি নাটক যে ট্র্যাজেডি হয়ে যাবে সেটি বুঝতে পারিনি। আবার আক্কেল গুড়ুম! একটি ভালো উদ্যোগ বাঙালি সহ্য করতে পারে না। সামাজিক মাধ্যমে শুরু হয়ে গেলো হৈ চৈ। চিকিৎসক, সমাজবিজ্ঞানীসহ একটি শ্রেণির মানুষ “উদ্দেশ্যপ্রণোদিত”ভাবে দেশ ও সমাজকে পিছিয়ে নেয়ার জন্য এর বিরুদ্ধে নানা কু-কথা বলা শুরু করলেন। আধুনিকায়নের এই যুগে মানুষ দৈনন্দিন জীবনের পাশাপাশি তাদের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করতে এখন বিশেষ আগ্রহী।

ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে যাদের কাছে পর্যাপ্ত অর্থ রয়েছে তারাই এই সোনায় মোড়ানো বিশেষ এই জিলাপির ক্রেতা। কিন্তু রুচিহীন (!), অর্থহীন মানুষের অপব্যাখ্যায় খাদ্যাভ্যাস কিংবা রুচি(!) পরিবর্তনের এই মহান উদ্যোগ হঠাৎ থমকে গেলো। হোটেল কর্তৃপক্ষ জানালেন, সোনার প্রলেপ শেষ হওয়ার কারণে বিপুল পরিমাণে চাহিদা থাকা সত্তে¡ও বিক্রি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। নতুন করে সোনার ফয়েল আমদানি না করা পর্যন্ত বিক্রি বন্ধ থাকবে। ৪ এপ্রিল শুরু হওয়া এই মহতী উদ্যোগ ১০ এপ্রিল থমকে দাঁড়ালো। মাত্র সাত দিনের স্বর্ণ বিলাস।

১০ এপ্রিল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ঢাকার ফেসবুক পেজে জানানো হয়, ‘গোল্ড জিলাপি সোল্ড আউট’। সোনার ফয়েলে আবৃত জিলাপি বিক্রি শেষ হয়েছে। এই জিলাপি ব্যাপক সাড়া ফেলে দিয়ে পরশ্রীকাতর মানুষের নানা কথায় কী বন্ধ হয়ে গেলো। অর্থনীতির চাহিদা জোগানের সূত্র অনুযায়ী একথা বিশ্বাস করা যায় না সাধারণ মানুষের চেচামেচিতে এহেন মহৎ উদ্যোগ স্থগিত করা হয়েছে। আশা করি আবার সোনার ফয়েল আসবে, আবার বিত্তশালীদের রসনা বিলাস শুরু হবে।

আমাদের দেশে সোনা খায় কারা? কারা খায় আমরা খুব ভালোভাবে জানি। যারা খায় তাদের নাম প্রকাশ করতে চায় না হোটেল কর্তৃপক্ষ। ব্যবসায়িক কৌশল এবং আদর্শের কারণে। আমার মনে হয় যারা সোনার জিলাপি খান, নাম প্রকাশ করলে তারা মোটেই বিব্রত হবেন না। সামান্য বিশ হাজার টাকা কেজির জিলাপি তাদের জন্য নস্যি মাত্র। যারা ভেবেছেন এ কারণে লজ্জায় তারা মুখ লুকোবেন, তারা ভ্রান্তি বিলাস করছেন। সোনার জিলাপি খাওয়া মানুষেরা পাঁচ তারকাতে প্রাতরাশ সারতে এর থেকে অনেক বেশি অর্থ ব্যয় করেন। তাদের অর্থ, বিত্তের সক্ষমতা কত বিশাল তা সাধারণের কল্পনার সীমানা ছাড়িয়ে যাবে।

সোনার জিলাপি খাওয়ার যৌক্তিকতা আছে। দেশে দারিদ্র্য কমেছে। সুসংবাদটি আমরা পেয়েছি নববর্ষের আগের দিন অর্থাৎ ১৩ এপ্রিল ২০২৩ তারিখে। ছয় বছর আগে ২০১৬ সালে দরিদ্র ছিল ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০২২ সালে তা নেমে এসেছে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশে। বিবিএসের জরিপ অনুযায়ী, দেশে এখন অতিদরিদ্রের হার ৫ দশমিক ৬। ছয় বছর আগে যা ছিল ১২ দশমিক ৯ শতাংশ।

আমরা যদি আরেকটু চেষ্টা করি, আরো ৬ বছর পরে দেশের অতিদরিদ্র মানুষের সংখ্যা শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসতে পারবো। ঈদের পর সোনার জিলাপি খেতে আর বাধা থাকলো না। তবে নিন্দুক যারা, পরশ্রীকাতরতায় যারা ভোগেন তারা তখন হয়তো বলবেন দারিদ্র্য কমেছে তো কী হয়েছে? পরিসংখ্যান ব্যুরোতো বৈষম্য বাড়ার কথাও বলেছে। ২০১৬ সালের চেয়ে দশমিক ৪৯৯ পয়েন্ট বেড়েছে বৈষম্য। সাধারণত দশমিক ৫০০ হলেই একটি দেশকে উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। উচ্চ আয় বৈষম্য দেশের থেকে সামান্য দূরে আছে বাংলাদেশ।

দারিদ্র্য কমে যাওয়া যেমন সুসংবাদ, আয় বৈষম্য বেড়ে যাওয়া কিন্তু একই ভাবে দুঃসংবাদ। আয় বৈষম্য যদি বেড়ে যায় তাহলে নাগরিকদের উন্নয়ন ভোগে সমতা বিধান সম্ভব হয়ে উঠে না। মনে রাখতে হবে, সকল ক্ষেত্রে সমতা ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য কিন্তু আমরা স্বাধীনতা যুদ্ধ করেছিলাম। পাঁচ তারকা হোটেলে প্রাতরাশ, নৈশভোজ, দেশে বিদেশে একাধিক বাড়ি, দেশ থেকে নানাভাবে লুণ্ঠন করে বিদেশে অর্থ পাচার করে এক শ্রেণির মানুষের বিলাসী জীবন যাপন করার জন্য একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ মানুষ জীবন উৎসর্গ করেননি। স্বাধীনতার পরে দেয়া প্রতিটি বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু বৈষম্য নিরসনের কথা বলেছেন।

স্বাধীনতা, গণতন্ত্রের মূলবাণী কিন্তু বৈষম্য নিরসন। একদল মানুষ সোনার জিলাপি খাবে আর একদল মানুষ, প্রতিদিন তিন বেলা স্বচ্ছন্দে খাওয়ার জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলবে তা কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূল কথা নয়। আমাদের এখন সবচেয়ে গুরুত্ব দিতে হবে বৈষম্যহীন একটি সমাজ কাঠামো গড়ে তোলার আন্দোলনে। এ কথাটি এখন আর কাউকে বলতে শোনা যায় না। আগামী নির্বাচনে সস্তা কর্মসূচি হাতে না নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গীকার হওয়া উচিৎ সমতার বাংলাদেশ গড়ে তোলা। এ কথাটি বহুল উচ্চারিত হলেও মোটেই গুরুত্ব পাচ্ছে না।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক।


poisha bazar