ইন্টারনেট আসক্তি নিরসনে চাই সচেতনতা


  • অনলাইন ডেস্ক
  • ১৯ এপ্রিল ২০২৩, ১৬:০৫

মো. রায়হান আলী: সময়ের গতিশীলতায় বেড়েই চলছে আধুনিকতার বিস্ময়! এনালগ সিস্টেম অতিক্রম করে আমরা পৌঁছেছি ডিজিটালাইজেশনে। বিজ্ঞানের অভ‚তপূর্ব আবিষ্কার আধুনিক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপন সহজ করে দিয়েছে। হাতের নাগালেই যেন পৃথিবী! হাত বাড়ালেই নিমিশেই বিশ্বের সংবাদ থেকে শুরু করে কত কিছু জানা যায়। আধুনিক বিশ্বায়নে বিজ্ঞানের এক আপডেট আবিষ্কার হলো ইন্টারনেট সেবা। ইন্টারনেট সেবা বিশ্বময় এক জাদুর নাম। এই ইন্টারনেট সেবা ছাড়া আধুনিক বিশ্বের কোনো কিছুই চিন্তা করা যায় না। ডিজিটাল যুগে প্রায় সবকিছুই চলছে ডিজিটাল প্রযুক্তি সেবার মাধ্যমে। এত কিছু ভালোর মধ্যে আছে নানান বিপত্তি। যে ইন্টারনেট সেবা পুরো বিশ্বকে মানুষের হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। সেই ইন্টারনেট সেবা এখন অনেক প্রেক্ষাপটে আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ইন্টারনেট শিশু-কিশোর থেকে বয়োবৃদ্ধরাও ব্যবহার করে থাকে। বি আইজিডির গবেষণায় দেখা গেছে, ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সীরা অন্য বয়সের ব্যক্তিদের তুলনায় বেশি ইন্টারনেট ব্যবহার করে এবং এ বিষয়ে তাদের দক্ষতাও আছে। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান নবম।

গবেষণা বলছে, একজন মানুষ দিনে অন্তত ২৬৬৪ বার তার নিজের মোবাইল ফোনের স্ক্রিন স্পর্শ করে। আর এই স্ক্রিন স্পর্শ করার কারণ ফোনের নোটিফিকেশন চেক, কোনো এসএমএস এলো কি না ইত্যাদির দিকে মনোনিবেশ করে। অল্পবয়সীরা লেখাপড়ার প্রতি মনোনিবেশ না করে দিনে দিনে ঝুঁকে যাচ্ছে ইন্টারনেটের অপব্যবহারে। বর্তমানে যারা দ্রুত ইন্টারনেটে আসক্ত হচ্ছে তাদের বয়স ১৪ থেকে ২৪ বছর অর্থাৎ তরুণসমাজ। এদের মধ্যে প্রায় ৭৭ ভাগ পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত এবং পৃথিবীতে প্রায় ২২০ কোটি মানুষ ভিডিও গেম খেলে। বাংলাদেশে বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১১ কোটি ২৭ লাখ, যাদের মধ্যে ১০ কোটি ৩২ লাখ মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত। এই বিশাল ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর মধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ৩৫ শতাংশ। বাংলাদেশে প্রতিদিন শুধু পাবজি নামক ভিডিও গেম খেলে ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষ। এসব ভিডিও গেম খেলার ফলে শিশু-কিশোর বা শিক্ষার্থীদের মস্তিষ্কে বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি হয়; এমনকি চোখের দৃষ্টিশক্তির হ্রাসসহ মানসিকভাবে অনেকে বিকারগ্রস্ত হচ্ছে।

ইন্টারনেট গেমে সাধারণত বন্দুক, পিস্তলসহ গোলাবারুদ ব্যবহার করে একে অপরের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। যার ফলে যখন তারা গেমে পরাজিত হয়, তখন তাদের মন এবং মেজাজ খিটখিটে হয় ও একে অপরের সঙ্গে রাগারাগি, ঝগড়া-বিবাদে জড়িয়ে পড়ে। শিশু-কিশোররা আগামীর কর্ণধার। তাদের মানসিক বিকাশে এই ইন্টারনেটের অপব্যবহার দিন দিন যেন মারাত্মক আকার ধারণ করছে। মাদকাসক্তের চেয়েও বেশি আসক্ত হচ্ছে ইন্টারনেটে হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক, ভাইবার, ইমো, মেসেঞ্জার, গুগল ও ইউটিউবে। গত দুই বছরে করোনার প্যান্ডামিক অবস্থায় করোনা সংক্রমণ রোধে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ধাপে ধাপে বন্ধ রাখতে হয়েছে সরকারকে। একদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, অন্যদিকে অনলাইন ক্লাসের নামে প্রাথমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পর্যন্ত সবার হাতেই ছিল স্মার্টফোন-ল্যাপটপসহ পর্যাপ্ত ইন্টারনেট সুবিধা। ফলে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী ইন্টারনেটের এই সুবিধার অপব্যবহার করে সবচেয়ে বেশি সময় কাটিয়েছে অনলাইন ভিডিও গেমিংয়ে কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।

২০১৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) প্রথমবারের মতো ভিডিও গেমে আসক্তিকে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার তালিকাভুক্ত করেছে। অর্থাৎ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনলাইন গেম, মুঠোফোন, কম্পিউটার বা ভিডিও গেমের ক্ষতিকর ব্যবহারকে রোগ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এর আগে ২০১৩ সালে আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন প্রকাশিত মানসিক রোগ নির্ণয়বিষয়ক গাইডলাইনে (ডিএসএমণ্ড৫) বিষয়টিকে ‘ইন্টারনেট গেমিং ডিজঅর্ডার’ হিসেবে উল্লেখ করে গবেষণার ভিত্তিতে রোগ হিসেবে চিহ্নিত করার সুপারিশ করেছিল। করোনাকালে দিনের বেশির ভাগ সময়ই শিক্ষার্থীরা অনলাইন ক্লাসের নাম করে এই গেমিংয়ের পেছনে ব্যয় করছে, বেড়েছে স্মার্টফোন ব্যবহারের হার। বর্তমানে জনপ্রিয় কিছু গেমের নাম পাবজি, কল অফ ডিউটি, ফ্রি ফায়ার, প্রো ইভুলেশন সকার (পেইস) ব্যবহার করে আসক্ত অনেক শিক্ষার্থী।

শিক্ষার্থীরা যদি এভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ইন্টারনেটে সময় পার করে তাহলে ভবিষ্যতে দেখা যাবে জাতি এক মেধাশূন্যতায় ভুগছে। অনলাইন দুনিয়ার করাল গ্রাস থেকে জাতিকে রক্ষা করার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এক গবেষণা বলছে, শিশু এবং কিশোররা প্রায় ১৯ শতাংশ ভিডিও গেম এবং ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। এই সন্তানদের গড়ে তুলতে পিতাণ্ডমাতাকে সময় দিতে হবে। সন্তানদের কড়া নজরদারিতে রাখতে হবে অভিভাবকদের। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের ইন্টারনেট ব্যবহার নিরাপদ করতে বাবা-মাকে মূলত দুটি জিনিস নজরদারিতে রাখতে হবে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে, শিশুরা ইন্টারনেট ব্যবহার করতে গিয়ে কোনো ধরনের বিপদে পড়ছে কি না। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, তারা কোনো আসক্তিতে জড়িয়ে পড়ছে কি না। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মৌলিক কিছু জিনিসে পরিবর্তন এনে একটু সচেতন হলেই শিশুদের জন্য ইন্টারনেট ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা বা তাদের ইন্টারনেট ব্যবহারে নজরদারি করা যায়। এর মধ্যে অন্যতম হলো- প্যারেন্টাল কন্ট্রোল ই-মেইল অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করা। শিশুদের যদি কোনো ডিভাইস দেওয়া হয় তাহলে সেটিতে প্যারেন্টাল কন্ট্রোল ই-মেইল অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করাটাই নিরাপদ বলে মনে করেন প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা।

নটিংহ্যাম ট্রেন্ট ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় ইন্টারনেট আসক্ততায় কি হয় তা তুলে ধরেছেন। গবেষণাটিতে বলা হয়, ফেসবুক যে আসক্তি তা বোঝার জন্যে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের আচরণের দিকে তাকানোই যথেষ্ট। জীবনের ব্যাপারে আগ্রহ না থাকা, জেদ, পলায়নী মনোবৃত্তি, মুড নির্ভরতা, গোপন প্রবণতা- ইত্যাদি যে সব বৈশিষ্ট্য একজন আসক্ত মানুষের থাকে, ফেসবুকের অতি ব্যবহারকারীদের মধ্যেও তা দেখা গেছে। এমনকি মাদকাসক্তির চিকিৎসা করানোর সময় রোগীদের মধ্যে যে সব উপসর্গ দেখা যায়, ফেসবুক বন্ধ করে দিলেও একই উপসর্গ দেখা গেছে। মাদক না পেলে একজন আসক্ত যেমন অস্থির হয়ে পড়ে, অশান্ত হয়ে ওঠে, ফেসবুক ব্যবহার করতে না পারলেও তাদের মধ্যে এমনি অস্থিরতা, অশান্তি দেখা দেয়।

শিশু-কিশোরা অনুকরণশীল। তাদের সঠিক পথে পরিচালনা করা অভিভাবকের দায়িত্ব। ইন্টারনেটে তাদের যুক্ত করতে হলে শিক্ষামূলক সাইডগুলো ব্যবহারের মানসিকতা সৃষ্টি করতে হবে। শহরে অনেক ইন্টারনেটে গেম খেলার দোকান আছে, সেখানে গিয়ে ঘণ্টা চুক্তিতে মানসিকতা বিকৃতের মতো নানান গেম খেলছে শিশু-কিশোররা। ইন্টারনেটের নানান অপব্যবহারে জড়িয়ে পড়ছে সন্তানরা। অনিচ্ছা সত্তে¡ও অল্প বয়সিরা জড়িয়ে পড়ছে সাইবার অপরাধ, কিশোর গ্যাং অপরাধসহ নানা অপরাধে। প্রত্যেক পিতাণ্ডমাতার উচিত সন্তানদের এই আধুনিক যুগে আধুনিকতার অপসংস্কৃতির ভয়াল গ্রাস থেকে তাদের সুরক্ষিত রাখতে প্রয়োজনীয় সজাগ দৃষ্টি রাখা। সন্তানদের ইন্টারনেট আসক্তি থেকে মুক্ত রাখতে ধর্মীয় কৃষ্টি কালচারবোধ জাগ্রত ও সামাজিক কল্যাণমূলক কার্যক্রমে অংশগ্রহণে সবচেয়ে বেশি উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সন্তানদের বই,পত্রিকা, ম্যাগাজিন পড়ার প্রতি আগ্রহ তৈরি করতে হবে। মানসিক ও শারীরিক মেধা বিকাশে চিত্তবিনোদন ও খেলাধুলার পরিবেশ সৃষ্টি করে দিতে হবে অভিভাবকদের। সর্বোপরি সন্তানদের যোগ্য করে গড়ে তুলতে ইন্টারনেটের অপব্যবহার ও আসক্ততাকে রুখে দিয়ে তাদের সঠিক পথে পরিচালিত করে মেধা বিকাশে সহায়তা করাই হবে মুক্তির একমাত্র পথ।

লেখক : আইনজীবী ও কলামিস্ট।


poisha bazar