একাত্তরের গণহত্যার নির্মম স্বাক্ষর সংরক্ষণ করা হোক

- অনলাইন ডেস্ক
- ২৯ মার্চ ২০২৩, ১১:৩৯
বিলকিস ঝর্ণা: ১৯৭২ সালে প্রকাশিত রবার্ট পেইনের প্রকাশিত ম্যাসাকার গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৭১ সালে ২২ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত এক সামরিক বৈঠকে ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন ‘ওদের ৩০ লাখ মেরে ফেলো। বাদ বাকিরা আমাদের হাতে খেয়েই বেঁচে থাকবে।’ কিল ও মিলিয়ন অফ দেম এন্ড দা রেস্ট ওইল ইট আওট অফ আওয়ার হ্যান্ডস’। কিন্তু ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মধ্য দিয়ে বদলে যায় পাকিস্তানিদের সাজানো বাগান। বাঙালির প্রগাঢ় সাহসী শব্দে পূর্ব বাংলায় উথলে ওঠা জাতীয়তাবাদের ঢেউ, ভিত কাঁপন জাগায় ততকালীন পাক সরকারের হিতাহিত নগ্ন স্বৈরাচারিতায়।
তারই রেশ ধরে ২৫ মার্চের অপারেশন সার্চলাইটের মধ্য দিয়ে শুরু হয় নয় মাস ব্যাপী এক বর্বরোচিত গণহত্যার বীভৎস অধ্যায়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। যার সব ইতিহাস চাপা পড়ে আছে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের প্রতি ইঞ্চিতে। আমরা ৫২ বছর ধরে স্বাধীনতার স্বাদে মগ্ন। বিজয়ের পতাকায় ভাসি। অথচ গণহত্যা ও বধ্যভূমি চিহ্নিতকরণের মীমাংসা হয়নি অদ্যাবধি। এমনকি তার স্বীকৃত মিলেনি জাতিসংঘেও।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তান কর্তৃক গণহত্যার উল্লেখিত বিষয়ে নিন্দা জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের নি¤œকক্ষ হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভে স্টিভ ক্যাবট ১৪ অক্টোবর একটি রেজুলেশন আনেন। যার নাম ‘১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যার স্বীকৃতি’। রেজুলেশনে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী বাঙালির ওপর যে বর্বরোচিত সহিংসতা চালিয়েছে তাকে গণহত্যা, মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। এছাড়া পাকিস্তানকে বাংলাদেশের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়ার জন্য এবং যেসব অপরাধী এখনো বেঁচে আছে তাদের বিচার করার জন্যও আহ্বান জানানো হয়।
একাত্তরের এই বীভৎস গণহত্যায় ইন্ধন যুগিয়েছিলো যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনও। গণহত্যার সমর্থনের পাশাপাশি সরাসরি অস্ত্র দিয়েও নির্মম অনৈতিক মানবেতর কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত ছিলো ইয়াহিয়া খানের দোসর এই যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। ক্ষমার দাবির প্রশ্ন থাকে তাদের কাছেও। দীর্ঘ ৫২ বছরেও ক্ষমা চাওয়ার মতো মানবিক স্বাক্ষর রাখেনি তারা। পশ্চিম পাকিস্তানের স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গের জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্ভুত নাগরিকগণের স্বায়ত্তশাসিত সরকার প্রতিষ্ঠার অধিকার চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়া অপারেশন সার্চলাইট পরিকল্পনার নীল নকশার চিত্র হলো, সর্বোচ্চ সংখ্যক রাজনৈতিক ও ছাত্র সংগঠনের নেতা, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক সাংগঠনিক ব্যক্তিবর্গ এবং শিক্ষকদের গ্রেপ্তার করা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তল্লাশি এবং দখল করাসহ ঢাকার অপারেশন সম্পূর্ণভাবে সফল করা। সেনানিবাসকে সুরক্ষিত রাখা এবং অস্ত্র ব্যবহারে সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রদান এবং সব ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে পূর্বপাকিস্তানের সৈন্যদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ কেড়ে নিয়ে নিস্ক্রিয় করে দেয়া হয়। অপারেশন পরিচালনার জন্য চিহ্নিত স্থানগুলো ছিল- ঢাকা, খুলনা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশোর, রাজশাহী, রংপুর, সৈয়দপুর এবং সিলেট।
১০ এপ্রিল পর্যন্ত এরূপ বীভৎস ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে বাঙালিকে সর্বস্বান্ত করবার প্রয়াসে লিপ্ত হয় পাক সরকার । কিন্তু বাঙালিদের অস্তিত্ব রক্ষার প্রণপণ প্রতিরোধী শক্তির মোকাবিলায় চলতে থাকে নির্বিচারে গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, মাইলের পর মাইল বাড়িঘর পোড়ানোর মতো বীভৎস এক ধংসযজ্ঞ। বিভিন্ন গবেষণায় আর প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় উঠে আসে তার অবর্ণনীয় চিত্র। পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী গওহর আইয়ুুবের লেখা ‘গিøমপসেস ইনটু দ্য করিডর অফ পাওয়ার’ বইয়েও। গওহর আইয়ুব পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের ব্যক্তিগত ডায়েরি থেকে একটি লেখা সংগ্রহ করেছিলেন। সেই ডাইরির তথ্যানুসারে যুদ্ধপরবর্তী এক বছর পরে পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডির একটি সামরিক হাসপাতালে মানসিক বিকারগ্রস্ত এক তরুণ পাকিস্তানি অফিসারকে আনা হয় চিকিৎসার জন্য। যে তরুণ অফিসার যুদ্ধ শেষে পাকিস্তান ফিরে যাওয়ার পর গুরুতর মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে যায়। যার যুদ্ধের কথা মনে হলেই পুরো শরীরে খিঁচুনি দিয়ে জ্বর উঠত। ঘুমোতে পারতো না। কেননা তার নির্দেশে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানি সেনারা। পুরো মুক্তিযুদ্ধে তিনি একাই হত্যা করেছিলেন ১৪ হাজারের বেশি নিরীহ মানুষকে। এবং এক পর্যায়ে তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন।
১৯৭২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ অবজারভার পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দিনাজপুর টিঅ্যান্ডটি অফিসের টর্চার সেলের বিবরণে দেখা যায় --দিনাজপুরে টিঅ্যান্ডটি অফিসে একটি টর্চার সেলে প্রায় ১০ হাজার বাঙালিকে নির্যাতন করেছিল পাকিস্তানি সেনারা। সেলের মেঝেতে ৩ ইঞ্চি পুরু রক্ত জমাট বাঁধা ছিল।
গণহত্যা প্রসঙ্গে উঠে আসে খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার গ্রাম চুকনগর। ভদ্রা নদীর পাড়ের এই গ্রামে স্বল্প সময়ে সবচেয়ে বড় গণহত্যার নজির পাওয়া যায়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ২০ মে মাত্র এক প্লাটুন পাকিস্তানি সেনা ৪ ঘণ্টায় ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে অন্তত ১২ হাজার নিরীহ মানুষকে। প্রকৃতপক্ষে এই গণহত্যায় এর চেয়ে বেশি মানুষ নিহত হয়েছিলেন। চুকনগরের পাশে ভদ্রা নদীর পানিতে লাশ ভাসিয়ে দেওয়ায় নিহতের প্রকৃত সংখ্যা পাওয়া যায়নি। স্থানীয়ভাবেও সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি। কারণ ওই গণহত্যায় শহীদদের বেশিরভাগ চুকনগর, ডুমুরিয়া বা খুলনার বাসিন্দা ছিলেন না।
প্রত্যক্ষদর্শী এক শিক্ষকের ভাষায় পাওয়া যায় এক নারকীয় চিত্রের বর্ণনা। অত্র এলাকায় প্রায় ৪ মাইলব্যাপী এই হত্যাযজ্ঞ চলে। কিছু লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। দুর্গন্ধ এড়াতে কিছু লাশ মাটিচাপা দেওয়া হয়। এলাকার লোক ২ মাস পর্যন্ত ওই নদীর মাছ খায়নি। ভয়ে লোকজন ৫-৬ মাস পর্যন্ত বাজারেও আসেনি।
ঢাকার জিঞ্জিরার গণহত্যা চলেছিলো ২ এপ্রিল ভোর সাড়ে ৫টা থেকে একটানা দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত । শহীদ হয়েছিলেন ২ হাজারেরও বেশি নিরীহ মানুষ। মুক্তিযুদ্ধে নৃশংসতার চিত্র দেখা যায় মিরপুরে। মুক্তিযুদ্ধের মিরপুর যেন এক কসাইখানা । মিরপুরের বিরান জনপদে গড়ে তুলেছিলো অসংখ্য টর্চারসেল। ছিল ২৩টি বধ্যভূমি।
জঙ্গলের পাশে শিয়ালবাড়ির বধ্যভূমি। যেখানে কুপিয়ে কুপিয়ে মেরে ফেলে রাখা হয় অগুনতি মৃত। ৬০ বস্তা মাথার খুলি উদ্ধার হয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা ভবন থেকে কমার্স কলেজ যেতে কালভার্টের নিচ থেকে । মিরপুরের শিরনিরটেকে ৩ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। ২৪ এপ্রিল আলোকদী গ্রামে মধ্যরাত থেকে ২৫ এপ্রিল দুপুর ১টা পর্যন্ত সেখানে পৈশাচিক গণহত্যা করে মরদেহে পূর্ণ করে মোট ৮টি কুয়া। এ ছাড়া, পাশের জলাশয়ের ধারে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে নির্বিচারে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয় নিরীহ গ্রামবাসীকে। এই গ্রামে শহীদের সংখ্যা ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজারের মতো।
চট্টগ্রামে বধ্যভূমি ১১৬টি। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল দামপাড়া বধ্যভূমিতে প্রতিদিন রাতে বেশ কয়েকটি ট্রাক ভর্তি করে মানুষ ধরে আনা হতো । এরপর তাদের দিয়ে গর্ত খনন করিয়ে তাদেরকেই গুলি করে হত্যা করে মাটি চাপা দেওয়া হতো। তথ্যে পাওয়া যায় এখানে প্রায় ৪০ হাজারের মতো মানুষ হত্যা হয়। এরকম পাহাড়তলি বধ্যভূমিতে ১০০টি গর্তের একটিতেই মিলে ১ হাজার ৮২টি খুলি।
নীলফামারীর গোলাহাট গণহত্যায় ৪৪৮জন মাড়োয়ারিকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। ১২ জুন রাতে ভারতে শরণার্থী শিবিরে নেওয়ার কথা বলে সৈয়দপুর স্টেশন থেকে ৪টি বগিতে তোলে গোলাহাটে নিয়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যা করে ৪৪৮ জন মাড়োয়ারিকে। সেই পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞ থেকে রেহাই পায়নি শিশু, বৃদ্ধ, নারীরাও। ২৫ মার্চ রাতে সৈয়দপুর শহর থেকে প্রায় ১৫০ জন বুদ্ধিজীবীকে ধরে নিয়ে যায় এবং টানা ১৮ দিন পৈশাচিক নির্যাতনের পর ১২ এপ্রিল মধ্যরাতে রংপুর সেনানিবাসের পশ্চিম পাশের উপ-শহরে নিয়ে গুলি করা হয় তাদের। যা বালারখাইল গণহত্যা নামেও পরিচিত। এটি প্রথম পরিকল্পিত বুদ্ধিজীবী গণহত্যা।
ব্যাপক হত্যাযজজ্ঞ চালানো হয় পুরোনো ঢাকার সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে। সেই রাত্রিতে একমাত্র ঢাকা ও তার আশেপাশের এলাকাতে প্রায় এক লক্ষ নিরীহ নর-নারীকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।
স্বজন হারানো, ভুক্তভোগী, প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্যে গণহত্যার ইতিহাসে এসেছে প্রান্তিক মানুষের মুক্তিসংগ্রামের বর্ণনা। বিভিন্ন জরিপ পর্যালোচনায় গণহত্যার বিশ্লেষণে খুলনার চুকনগর, গল্লামারি, চট্টগ্রামের পাহাড়তলি ইত্যাদি ভয়ংকর ও বীভৎস হত্যাকাণ্ডের স্থানগুলোর নাম বারবার আসে। জরিপে এমন অনেক গণহত্যা, বধ্যভূমির নাম পাওয়া গিয়েছে, যেগুলোর কোনো তথ্য বা কোথাও কোনো ইতিহাস নেই।
মুক্তিযুদ্ধে দেশে কতগুলো গণহত্যা হয়েছে এবং কতগুলো গণকবর আছে, তার প্রকৃত হিসাব পাওয়া যায় না। তবে গণহত্যা নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র জানিয়েছে, তারা এখন পর্যন্ত ২০টি জেলায় ৪ হাজার ৬০০ এর বেশি বধ্যভূমি, গণকবর ও নির্যাতন কেন্দ্র চিহ্নিত করেছে।
তাহলে ৬৪ জেলায় জরিপ কাজ শেষ হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা ৩০ লক্ষ ছাড়িয়ে যাবে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। এছাড়াও একাত্তরে শরণার্থী বাংলাদেশি মৃত্যুর সংখ্যাও যুক্ত করার আবশ্যকীয়তা থেকে যায়।
দীর্ঘ ৫২ বছরের পিছনে চাপা পরে যাওয়া স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় সংরক্ষণ করা আমাদের দায়। বধ্যভূমি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বধ্যভূমিগুলোর একটি সঠিক তালিকা ও বিবরণী মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে থাকা দরকার। মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক বধ্যভূমি এবং গণকবর সংরক্ষণ এবং তালিকার কাজে কালক্ষেপণে হয়ত বিলুপ্ত হয়ে যাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দলিল।
লেখক: কবি ও আইনজীবী।


