স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন ও আসলাম

- অনলাইন ডেস্ক
- ২২ মার্চ ২০২৩, ১৩:৩০
ম.মানিক: ম্যাক্সিম গোর্কির ভাষায়, বাস্তবতা থেকে উঠে আসা জীবন রূপকথার চেয়েও সুন্দর। আর আমার দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় বলে, বাস্তব কল্পনার চেয়েও কঠিন, জটিল ও ভয়ঙ্কর।
ভোর পাঁচটায় মোবাইলে এলার্ম বেজে উঠল। হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে এক গ্লাস জল খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম, ঘণ্টাখানিক হাঁটব আর সম্ভব হলে শীতের কুয়াশার চাদরে ঢাকা শিশিরে ভেজা ভোরের সুন্দর কয়েকটি ছবি তুলব এই আশায়। তখনও রাতের রেশ কাটেনি, ঘন কালো অন্ধকারে ঢাকা চারিদিক। রাস্তার ধারে ল্যামপোস্টের বাতিগুলো জ্বলছে। মোড়ের মসজিদে ফজরের নামাজ মাত্র শুরু হয়েছে। ইমাম সাহেবের মিষ্টি কণ্ঠে সুরা ফাতেহার সুমধুর সুর ভেসে আসছে। আমি কিছুটা আনমনে জলার পাড়ার রাস্তা ধরে জিমখানা মাঠের দিকে হাঁটছি। মাথার মধ্যে ইমাম সাহেবের কণ্ঠে সুরা ফাতেহার মধুর সুর প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। মাঠের কাছাকাছি এসেছি। এমন সময় পাশ দিয়ে একটা অটো দ্রুত ছুটে গেলো একটি কুকুর শাবকের বুকের ওপর দিয়ে। কুকুর শাবকটির হৃদয় বিদীর্ণ আর্ত চিৎকারে দাঁড়িয়ে পড়লাম। কয়েকটা মুহূর্ত মাত্র, একটু ছটফটানি, কিছুটা গোঙানির শব্দ, কুকুর শাবকটি মৃত্যুর কোলে লুটিয়ে পড়লো। এক মুহূর্তের মৃত্যু, তাকিয়ে রইলাম, শাবকটির মা দীর্ঘক্ষণ শাবকটিকে নাড়াচাড়া করছে, জীব দিয়ে মৃত শাবকের সারা শরীর চেটে চেটে ওর ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা করছে। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না, চোখদুটি ঝাপসা হয়ে এলো, ফোঁটা ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো।
ঠিক এভাবেই সভ্যতার বাঁকে বাঁকে মানুষ হত্যা করে চলেছে লক্ষ কোটি প্রাণ। সর্বোপরি মানুষ নামের প্রাণীটি পৃথিবীময় হত্যার এক নিষ্ঠুর খেলায় মেতে উঠেছে। মহামতি কার্ল মার্কস বলেছিলেন, 'মানুষ তখনই মানুষ হয়ে উঠলো যখন সে হাতিয়ার ধরতে শিখলো।' কিন্তু আমার ধারণা একটু ভিন্ন রকম। আমি মনে করি, মানুষ যখন থেকে হাতিয়ার ধরতে শিখলো, ঠিক তখন থেকেই ক্রমান্বয়ে সে দানব হয়ে উঠলো।
কুকুর শাবকটির মৃত্যুতে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো, ভেতরটা অস্থির হয়ে উঠলো। হাঁটার জন্যে মাঠে না ঢুকে আনমনে পাইক পাড়ার রাস্তা ধরে সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। মাথাটা একেবারে ফাঁকা মনে হচ্ছে।
১৯৮৬ সালের ৩০ মার্চ। আমার ভেতরে সংগ্রামী চেতনার অনুরণন তোলে। মনে হচ্ছে যেন মগজের ভেতরের কোষগুলো টগবগ করে ফুটছে। আমার চোখের সামনে ঘটে যাওয়া বেশ কিছু মৃত্যুর ঘটনা মস্তিষ্কের চারিদিকে জড়ো হতে থাকে, উঁকি মারতে থাকে। মুহূর্তে কয়েকটি মৃত্যুর একটা জাল আমার চেতনাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেললো। আমি হাঁটতে লাগলাম এক অন্তহীন মৃত্যুপুরীর ভেতর দিয়ে। একের পর এক মৃত্যুর বিভীষিকা আমায় ছুঁয়ে গেলো, আমি হয়ে উঠলাম মৃত্যুপুরীর এক স্থায়ী বাসিন্দা।
হঠাৎ আমার এই গভীর অনুভূতির জাল ছিন্নভিন্ন করে আমার পায়ের সামনে লুটিয়ে পড়লো মিরপুরের সংগ্রামী সহযোদ্ধা আসলামের রক্তাক্ত দেহ। মিছিলের একেবারে অগ্রভাগে আমার বামপাশেই স্লোগান দিচ্ছিলো আসলাম। মিরপুর বাংলা কলেজের তরুণ ছাত্রনেতা বাবা-মার চার সন্তানের তিন বোনের একমাত্র ভাই। আজই ওর সাথে আমার প্রথম পরিচয়। আমার গল্প বলা, স্নেহপূর্ণ সান্নিধ্য ওর ভালো লাগে। আলাপে আলাপে আড্ডা জমে ওঠে।
সংগ্রামী সহযোদ্ধা আসলামের রক্তামাখা স্মৃতি, আমার দীর্ঘ ছাত্র আন্দোলনের এক ভয়ঙ্কর অধ্যায়। ৮৬-এর ৩০ মার্চের সেই ভয়ংকর রক্তাক্ত স্মৃতির ভেতর দিয়ে হেঁটে হেঁটে আমি আমার যৌবনের শ্রেষ্ঠ সময়ের মুখোমুখি হলাম।
তখন আমি নারায়ণগঞ্জ জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক। তুখোড় সাহসী ছাত্রনেতা হিসেবে ছাত্রসমাজ ও সাধারণ মানুষের মাঝে আমার খুবই জনপ্রিয়তা। স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী সংগ্রামে আমরা তখন প্রশাসনের ত্রাস। এরশাদ ৮৬'র ৭ মে ৩য় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করলে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে স্বৈরাচার বিরোধী সংগ্রামে আন্দোলনরত রাজনৈতিক দলগুলো দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। বিএনপি নিয়ন্ত্রিত ৭ দলীয় জোট নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ায় এবং এর ফলে জোটভুক্ত দলগুলোর বেশ কিছু নেতৃবৃন্দ স্বৈরাচার এরশাদের মন্ত্রিসভায় যোগ দেয়।
এদিকে আওয়ামী লীগ নিয়ন্ত্রিত ১৫ দলীয় জোট নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৫ দলীয় জোটের জাসদ-বাসদ সহ কয়েকটি দল এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ায়। ফলে রাজনৈতিক অঙ্গনে নির্বাচনের পক্ষে বিপক্ষে এক ধরনের মেরুকরণ সৃষ্টি হয়, যার প্রভাব চলমান ছাত্র আন্দোলনে এসে ধাক্কা লাগে। ফলে ছাত্রসমাজও দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
কমিউনিস্ট পার্টি আওয়ামী জোটের সাথে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন স্বৈরশাসক এরশাদ ঘোষিত তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান নেয়। ৮৬'র মার্চের ২৯ তারিখ সন্ধ্যায় ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় কমিটি একজন প্রতিনিধির মাধ্যমে আমাদের কাছে একটি বার্তা পাঠায় । আগামীকাল ৩০ মার্চ সকাল ১০ টায় নির্বাচনী প্রচারের জন্যে নির্বাচনের পক্ষের ছাত্র সংগঠনগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে একটি প্রচার মিছিলের আয়োজন করেছে। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন সর্বশক্তি নিয়ে সেই প্রচার মিছিলে অংশ নিতে চায়। তাই কেন্দ্রীয় কমিটি কাছাকাছি জেলাগুলো থেকে একটি ভালো জমায়েত আশা করছে।
৩০ মার্চ সকাল ১০টায় ছাত্র ইউনিয়ন বুয়েট ক্যাফেটারিয়ায় জমায়েত দিয়েছে। সে সময় নারায়ণগঞ্জ জেলায় ছাত্র ইউনিয়ন খুবই শক্তিশালী ও দারুণ সুসংগঠিত। আমরা প্রায় ১২০-১২৫ জন একটিভ নেতৃবৃন্দ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সেই জমায়েতে উপস্থিত হই। আসলামের সাথে আমার এখানেই পরিচয় হয় আর তখন থেকেই আসলাম মিছিলে আমাদের জমায়েতের সাথেই মিশে যায়।
একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনার পর আমরা মিছিল নিয়ে বিভিন্ন ক্যাম্পাস ঘুরে কলা ভবনের দিকে এগুতে থাকি। বিভিন্ন দিক থেকে অপরাপর সহযোগী সংগঠনগুলোও তাদের মিছিল নিয়ে কলা ভবনের দিকে আসতে থাকে। পুরো ক্যাম্পাস নির্বাচনী প্রচারের এক বিশাল জনসমুদ্রে পরিণত হয়। নারায়ণগঞ্জের নেতা-কর্মীদের নেতৃত্বে আমাদের মিছিলের একটি বড় অংশ অপরাজেয় বাংলা, মধুর ক্যান্টিন হয়ে কলাভবনের পেছনের রাস্তা ধরে মহসিন হলের মাঠের দিকে এগুতে থাকে। আমরা অনেকে মিছিলের প্রথম সারিতে। আসলাম আমার বাম পাশে স্লোগান দিচ্ছে। হঠাৎ বৃষ্টির মতো শত শত গুলির শব্দে আমরা স্তম্ভিত। দেখতে পেলাম এক বিশাল সন্ত্রাসী বাহিনী মহসিন হলের মাঠ পেরিয়ে আমাদের মিছিল লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে ছুড়তে মিছিলের দিকে এগিয়ে আসছে। নিরস্ত্র আমরা মিছিল নিয়ে দ্রুত পিছু হটতে থাকি। যদি পেছনে গুলি লাগে তাই আমরা সামনের দিকে তাকিয়ে পেছনে দৌড়াতে থাকি যাতে ডানে বামে সরে মাথা ঘুরিয়ে ছুটে আসা গুলির আঘাত থেকে নিজেদের বাঁচাতে পারি। মুহূর্তে একটি বুলেট আসলামের কপাল ভেদ করে মাথার খুলিটা উড়িয়ে নিয়ে যায়। বুলেটের আঘাতে খুলিটা বিচ্ছিন্ন হওয়ার সময় ফিনকি দিয়ে রক্তের ছটা আমার মুখ ও সারা শরীর ভিজিয়ে দেয়। ছিন্নভিন্ন মগজ ছিটকে পড়ে রাস্তায়। রক্তে মাখামাখি মগজের টুকরোগুলো ধুলার ওপর ছটফট করতে থাকে। আমার পায়ের সামনে পড়ে আছে আসলামের নিথর দেহ, কল কল করে মগজহীন মাথার ভেতর থেকে রক্তের ধারা বইছে। আমার মনে হলো আমি নড়তে পারছি না, আমার শরীরের সমস্ত রক্ত নিঃশেষ হয়ে গেছে, স্তব্ধ আমি অনাদিকাল ধরে প্রাণহীন আসলামের পাশে দাঁড়িয়ে আছি।
সেই কবে, ছোটবেলার স্মৃতি, এক যন্ত্রণাময় হাহাকার, একটা কুকুর শাবকের করুণ মৃত্যুতে হাউমাউ করে, চিৎকার করে, কেঁদেছিলাম। আর আজ এই পরিণত বয়সে এসে আমি দৌড়াচ্ছি, মাটিতে লুটিয়ে আছে মিরপুরের তরুণ ছাত্রনেতা, সংগ্রামী সহযোদ্ধা আসলামের গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত দেহ! আমি দৌড়াচ্ছি! ভাববার এক মুহূর্ত সময় নেই। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, কী করতে হবে। একজন মরে লাশ হয়ে পড়ে আছে, অন্য সহযোদ্ধাদের বাঁচাতে হবে, যারা আমার সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে আছে। মানুষরূপী দানবগুলো আজ ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর পিশাচ হয়ে উঠেছে। খুনের নেশা ওদেরকে জানোয়ার করে তুলেছে।
আসলামের রক্তাক্ত মৃতদেহ পেছনে ফেলে আমি ছুটে চলেছি। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়, হতবাক। ভাববার সময় নেই, এক সেকেন্ডের লক্ষ্য ভাগের একভাগ সময়ও আমার হাতে নেই। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে, বন্ধুদের বাঁচাতে হবে। সবার জীবনের কথা ভেবে আসলামকে ফেলে যাওয়া যায়, আসলাম মরে গেছে। কিন্তু যারা জীবিত! আসলামের লাশ বুকে জড়িয়ে চিৎকার করে সবাইকে ডাকছে- তাদেরকে ফেলে যাওয়া যায় না। ওরা আমার সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছে। আমার মস্তিষ্ক মুহূর্তে সচল হয়ে ওঠে, আমি মধুর ক্যান্টিনের সামনে পড়ে থাকা বাঁশের একটা পরিত্যক্ত মোটা লাঠি হাতিয়ার হিসেবে হাতে তুলে নিলাম যা ঐ মুহূর্তে শত সহস্র বারুদের শিখা হয়ে আমাকে সাহস জোগালো। দৌড়ে গিয়ে সকলকে বললাম, 'আসলামের লাশ কাঁধে তুলে নিয়ে সবাই আমার পেছনে থাক।'
লেখক: প্রাক্তন ছাত্রনেতা ও কথাশিল্পী


