রমজান অজুহাতে চলছে স্বার্থ হাসিলের পাঁয়তারা

- অনলাইন ডেস্ক
- ২১ মার্চ ২০২৩, ১৬:৫৯
বিলকিস ঝর্ণা: এবার নিত্যদ্রব্যের বাড়তি মূল্যের চাপ নিয়েই শুরু হতে যাচ্ছে রমজান। আসন্ন রমজানকে উপলক্ষ করে ধাপে ধাপে বাড়ছে নিত্য দ্রব্যমূল্য। কর্তৃপক্ষের কঠোর পদক্ষেপের কথা শোনা গেলেও তার রেশ দেখা যাচ্ছে না বাজার ব্যবস্থায়। অসাধু ব্যবসায়ীরা রমজান অজুহাতে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের পাঁয়তারা করে চলছে আগের মতোই। জবাবদিহিতার কোনো প্রয়োজনীয়তার ধার ধারছে না তারা। ফলে বিপাকে আছে সাধারণ ভোক্তা।
টিসিবি তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গত এক বছর সময়ের ব্যবধানে কোনো কোনো পণ্যের দাম ১০ শতাংশ থেকে ৯১ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে। গণমাধ্যমের খবরে দেখা যায় চাহিদা অনুযায়ী পণ্যের সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকলেও দফায় দফায় বাড়ছে পণ্যের দাম। ভোগান্তি হচ্ছে ভোক্তার। দ্রব্য মূল্যের ঊর্ধ্বগতি কোনো ক্রমেই স্থির হচ্ছে না। দ্রব্যমূল্য অনেক আগে থেকেই সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার বাইরে অবস্থান করছে।
আর মাত্র কয়েকদিন পর রোজা। তার আগেই ধাপে ধাপে নিত্যপণ্যের মূল্যে বাড়তি চাপ। নিম্ন আয়ের মানুষকে দিশেহারা অবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। সমস্যা জর্জরিত মধ্য আয়ের মানুষও। কর্তৃপক্ষ এসব সমস্যা সমাধানের কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে কি না সেসবের কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না। নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে কর্তৃপক্ষ আর খবরওয়ালারা প্রতিনিয়ত তার খবর ছেপে যাচ্ছে। কিন্তু রাষ্ট্রবানদের কানে সে খবর পৌঁছাচ্ছে না। দেশের মানুষ এখন বাতাসের গলায় দড়ি দিয়ে কাঁদছে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বহুবিধ কারণগুলোর মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য বৃদ্ধির কারণ একটি। যার ফলে অধিক পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে খাদ্যদ্রব্যসহ উৎপাদনের উপকরণ আমদানি করতে হচ্ছে। বাংলাদেশ একটি রপ্তানি নির্ভর অর্থনীতি। আর প্রধান রপ্তানির বাজারগুলোর মধ্যে চলছে বড় ধরনের অর্থনৈতিক মন্দা।
এরই রেশ ধরে কমে যাচ্ছে দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার। এমনই এক মন্তব্য তুলে ধরা হয় আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এবং অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখার জন্য বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলা করে বাংলাদেশ বেশ কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে বলেও দাবি করা হয়। অথচ প্রতিয়ত কমছে টাকার মান। কমে যাচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ।
বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা এবং আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ন্ত্রণ আমাদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অন্তর্ভুক্ত নয়। কিন্তু সংঘবদ্ধ ব্যবসায়ীদের অনৈতিক বাজার নিয়ন্ত্রণের ফলে বেড়ে চলেছে নিত্যপণ্য থেকে প্রয়োজনীয় সকল পণ্যের মূল্য। বিশ্ব মন্দার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। তাহলে কে নিবে এর দায়ভার। একটা পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির নামে গোলক ধাঁধায় মানুষ। মূলত, দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে যথেষ্ট মানুষ। মাছ-মাংসের বাজার এখন বিত্তবানদের বিনোদন। সাধারণ মানুষ পরিস্থিতির সাথে তাল মেলাতে কমিয়ে দিয়েছে নিজেদের চাহিদা। নিম্ন আয়ের এবং দিনমজুরের মাথায় হাত। অর্থনৈতিক বৈষম্য যেন তাদের প্রকৃতিগত অধিকার।
রমজান মুসলিমদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বিশ্বের অন্যান্য দেশে রোজাদারদের কথা ভেবে অন্যান্য সুবিধা দেয়ার সাথে রমজানে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যদ্রব্যের মূল্য নিশ্চিত করা হয়ে থাকে। বিশেষত মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোতে বাজারে যে পরিমাণ ছাড় দেয়া হয় সেটা অভাবনীয়। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে তা সম্পূর্ণ উল্টো। সুযোগ সন্ধানী সুবিধাভোগীরা সুযোগের সদ্ব্যবহার করে সব সময়ই রোজায় পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। সাধারণ মানুষের বিপাক কাটে না। যদিও বাজারে পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা রমজান উপলক্ষে স্বাভাবিক রাখতে কাজ করছেন বলে জানিয়েছেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। অথচ ব্যবসায়ীরা প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ না করে অন্যায় ভাবে নিজেদের মতো যত্রতত্র মূল্য বাড়িয়ে বিক্রি করছে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য। এক দিকে সরকার নির্ধারিত বাড়তি মূল্য অন্যদিকে পাইকারি এবং খুচরা ব্যবসায়ীরা নিজেদের মতো যারপরনাই বাড়তি মূল্যে পণ্য বিক্রি করছে। বিষয়টা ভোক্তাদের জন্য বোঝার ওপর শাকের আঁঁটির মতো ঠেকছে।
বস্তুতপক্ষে কর্তৃপক্ষের তৎপরতা কতখানি তাতে সন্দেহ আছে। কর্তৃপক্ষ কেবল কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছেন। বিদ্যুত, গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধিতেও সাধারণ মানুষের সামর্থ্য বিবেচনায় নিচ্ছেন না সরকার। যানবাহন ভাড়া বৃদ্ধির যাঁতাকলে পিষ্ট সর্ব শ্রেণির মানুষ। সাধারণ বেকারত্ব ছাড়াও বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারীকালীন ধকল কাটিয়ে না উঠতেই উত্তরোত্তর দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে কিংকর্তব্যবিমূঢ় দেশের মানুষ। এই ঊর্ধ্বগতির রেশ পড়ছে মানুষের জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে। একটু চোখ খোলা রাখলেই সেসব অসামঞ্জস্যতা চোখে পড়ে।
এ মুহূর্তে আমাদের বড় সমস্যা বা চ্যালেঞ্জগুলো হচ্ছে - মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার অস্থিতিশীলতাসহ টাকার অবমূল্যায়ন, আমদানি বৃদ্ধি ও রপ্তানি হ্রাসের কারণে বাণিজ্য ঘাটতি, বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ক্রমহ্রাস এবং জ্বালানি সংকটের কারণে বিদ্যুত উৎপাদন হ্রাস। সাম্প্রতিককালে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কঠিন সময় পার করছে দেশ। কালোবাজারি ও মুনাফাখোরি অসৎ ব্যবসায়ীদের মজুতদারি আচরণ, আমদানি-রপ্তানির আড়ালে মুদ্রা পাচার, ব্যাংকের ঋণখেলাপি, দুর্নীতির মতো অনিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থায় চরম দুর্দশায় অবস্থান করছে মানুষ। এসব বিষয় এখন আর গোপনীয়তা বজায় রেখে ঘটেনা। দীর্ঘ সময় ধরে ঋণ খেলাপির তালিকায় রয়েছেন বড় বড় ব্যবসায়ীরা। এদের অনেকেই ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি। অভিজ্ঞ মহলের মতে, এসব ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ বা নামে-বেনামে গৃহীত ঋণের টাকা আত্মসাৎ পূর্বক বিদেশে পাচার করা হয়েছে। পাচারকৃত অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য কঠোর কোনো ব্যবস্থা না নেয়ার কারণ যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কারসাজি সে কথা বিজ্ঞ জনদের অজানা নয়।
ব্যাংকগুলো অপেক্ষাকৃত ছোট ছোট ঋণ আদায়ে বেশ তৎপর, অথচ চিহ্নিত খেলাপিদের ঋণ আদায়ে তেমন উদ্যোগ নেই। এক্ষেত্রে আইনের কঠোর প্রয়োগ প্রয়োজন। খেলাপিদের স্বার্থের চেয়ে আমানতকারীসহ অন্যান্য গ্রাহকের স্বার্থের দিকে নজর দিতে হবে। ক্ষুদ্র ঋণগ্রহীতাদের সুযোগের ব্যবস্থা করতে হবে।
সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের পরিধি বাড়িয়ে সংকটাপন্ন দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করা অতিব গুরুত্বপূর্ণ। আস্থাহীনতায় ভুগছে মানুষ। সর্বক্ষেত্রে সততা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে সাধারণ মানুষের আস্তা ফিরিয়ে আনা জরুরি। রমজানকে উপলক্ষ করে মূল্য বৃদ্ধির অপসংস্কৃতি বন্ধ করতে রাষ্ট্রের সুদৃষ্টির প্রয়োজন। সাধারণ মানুষের সংকট মোকাবিলায় আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করা অতিব জরুরি।
লেখক: কবি ও আইনজীবী


