নারায়ণগঞ্জের গণহত্যা ও বধ্যভূমি

- অনলাইন ডেস্ক
- ১১ মার্চ ২০২৩, ১৬:১৬
বিলকিস ঝর্ণা: ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চের বর্বরোচিত গণহত্যার মতো নারকীয়তা বিশ্বে বিরল। শুধুমাত্র ঢাকা শহরে একরাতে নিরপরাধ ঘুমন্ত ৩০ হাজার মানুষকে হত্যা করেছিলো পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী। কিন্তু আজও তার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মেলেনি। আজও তালিকা হয়নি স্বাধীনতা যুদ্ধের গণকবরের। চিহ্নিত হয়নি সব-কয়টা বধ্যভূমি, গণকবর। লিপিবদ্ধ হয়নি সঠিক মুক্তিযোদ্ধা শহীদদের নাম। ৫২ বছরের পুরনো আর্তনাদ চাপা পড়ে আছে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশের প্রতি ইঞ্চিতে।
প্রতি বছর শীত জোছনায় হেঁটে হেঁটে আসে উত্তাল মার্চ। বধ্যভূমি লিখতে গিয়ে ভেতরে ক্ষরণ হচ্ছে অসম্ভব। স্বাধীন বাংলার জাতীয় পতাকায় লেগে থাকা রক্ত আমাদের চোখে পড়েনা। মুক্তিযোদ্ধার তালিকা হয় গণহারে। অতঃপর জাতীয় পতাকার দায় মুছে যায়। সময়টা ১৯৭১ থেকে ২০২৩। ৩০ লাখ মানুষের গণহত্যার ভেতর দিয়ে অর্জিত স্বাধীনতার এই দেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় মোট কতগুলো স্থান বধ্যভূমি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে সেই সংক্রান্ত কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস ও স্মৃতি সংরক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত সরকারের মন্ত্রণালয়ে খোঁজ পাওয়া যায় ২৮০টি বধ্যভূমির। আর বেসরকারি সংস্থা 'ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি' এদেশে প্রায় ৯৪২টি বধ্যভূমি শনাক্ত করেছে। পরবর্তীতে 'ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি'র জরিপকৃত তথ্যমতে পাঁচ হাজারের মতো বধ্যভূমি উলেখ রয়েছে সারা বাংলাদেশে। গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণা কেন্দ্রও ৬৪ জেলার মধ্যে মাত্র ৩২টিতে জরিপকার্য সম্পন্ন করতে পেরেছে।
ক্ষমতায় যখন স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি। ২০০৯ সালে ছড়িয়ে থাকা বধ্যভূমি সংরক্ষণের পক্ষে রায় দিয়েছিলেন উচ্চ আদালত। বধ্যভূমি সংরক্ষণ করতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণে হাত দিলেও রক্ষা হয়নি সেই ধারাবাহিকতা। বিভিন্ন জরিপে গণহত্যা, বধ্যভূমি, গণকবর ও নির্যাতন কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী নারায়ণগঞ্জে সেই সংখ্যা ২৮৮।
২৫ মার্চ রাতে পাক বাহিনী বাঙালির ওপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ শুরুর পরেই ২৬ মার্চে ঢাকার পাশের শহর নারায়ণগঞ্জে প্রবেশের চেষ্টা করলে ফতুল্লার মাসদাইর পুলিশ লাইনের কাছে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তুলে নারায়ণগঞ্জবাসী। এ প্রতিরোধ যুদ্ধে শহীদ হন ৩৩ জন। এরপরেই নারায়ণগঞ্জের পশ্চিমাংশে বক্তাবলীর ডিক্রি চরে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের ঘটনা তুলে ধরতে আমাদের পিছনে ফিরে তাকাতে হয়।
১৯৭১ এর ২৯ নভেম্বর। রাত তখন প্রায় তিনটে। তিন দিকে নদী বেষ্টিত বক্তাবলীর ২২টি গ্রাম- তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে পাকিস্তানি বাহিনী। ধলেশ্বরীতে গানবোট নিয়ে অবস্থান নেয় পাকিস্তানিরা, এই শহরেরই কয়েকজন রাজাকারের সহযোগিতায়। কুয়াশাবৃত ধলপহরে পাকিস্তানি বর্বর সেনারা গানবোট থেকে দ্রুত নামতে থাকে বক্তাবলীর চরে। কানাইনগর হাইস্কুল - মুক্তারকান্দি প্রাইমারি স্কুল সহ কয়েকটি ক্যাম্পে অবস্থান ছিলো সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের। নারায়ণগঞ্জ রাজধানী ঢাকার নিকটবর্তী হওয়ায় যুদ্ধের শুরু থেকেই পাকিস্তানি বাহিনীর পাশবিকতার শিকার ছিল শহরবাসী। এই পাশবিকতার হাত থেকে রক্ষা করতে শহরের কাছাকাছি বক্তাবলীতে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি। যাতে পাকিস্তানি বর্বর সেনাদের উপস্থিতি সঙ্গে সঙ্গে টের পেয়ে যায় এবং তৎক্ষণাৎ প্রতিরোধী প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারে মুক্তিসেনারা। ডিক্রির চর মসজিদ ও বিভিন্ন বাড়িতে সচেতন রাত কাটাতেন মুক্তিযোদ্ধারা। ভোরের আলো ফুটতে থাকলে কুঁড়ের পাড় অঞ্চলের নদীর কাছ থেকে গুলি ছুড়তে ছুড়তে অগ্রসর হতে থাকে পাকিস্তানিরা। এমতাবস্থায় সকাল প্রায় সাড়ে সাতটার দিকে অনেকটা সম্মুখ প্রতিরোধ গড়ে তোলে মুক্তি সেনারা। প্রায় দুই ঘন্টার প্রতিরোধ যুদ্ধের পর পাক হানাদার বাহিনী ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে গ্রামগুলোর ওপর। পাক হানাদারদের আধুনিক ভারী অস্ত্র শস্ত্রের মুখে পিছু হটতে বাধ্য হয় আমাদের মুক্তিসেনারা। আর তখনই শুরু হয় পাকিস্তানি বাহিনীর অভাবনীয় তাণ্ডব। বর্বর হানাদাররা ডিক্রিরচর নদীর পাড়ে ৪০ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে সারিবদ্ধ দাঁড় করিয়ে একসঙ্গে হত্যা করে। কয়েক মুহূর্তে আগুন জ্বালিয়ে নৃশংসভাবে পুড়িয়ে মারে পুরো বক্তাবলী এলাকার খড়ের গাদায় আশ্রয় নেওয়া দলবদ্ধ গ্রামবাসীদের।
অথচ সুদীর্ঘ সময় পরেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ ছাত্রদের নামের তালিকায় খুঁজে পাওয়া যায়না শহীদ মুক্তিযুদ্ধা শহিদুল্লাহ আর মনিরুজ্জামান এর নাম। স্বজনহারা শহীদ পরিবারের দীর্ঘশ্বাসের ভার বয়ে বেড়ানো স্বাধীন দেশে মানবেতর জীবনযাপন করছে শহীদ পরিবার। ৫২ বছরেও কোনও তালিকা হয়নি এই মুক্তিযুদ্ধা শহীদদের। জেলা প্রশাসনের তালিকায়ও নেই বক্তাবলী শহীদদের নাম।
১৯৭১ সাল ৪ এপ্রিল ঘটে বন্দর গণহত্যা। বন্দরের সিরাজদ্দৌলাহ ক্লাব মাঠে ৫৪ জনকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে গান পাউডার দিয়ে পুড়িয়ে ফেলে। আগুনে পুড়িয়ে দেয় বাড়িঘর। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের ভাষ্যমতে, ভোরের দিকে নৌপথে এলাকায় এসে অতর্কিতে আক্রমণ করে পাক আর্মি। আমিনপুর, র্যালিবাগান, সিএসডি, ইস্পাহানি এবং সোনাকান্দা ডকইয়ার সহ ক্যাম্প বসায় বিভিন্ন স্থানে। রাজাকারদের সহায়তায় চালাতে থাকে একের পর এক বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ। নবীগঞ্জ থেকে বন্দর স্টেশন পর্যন্ত ১৫ ডিসেম্বর পাকসেনাদের ব্রাশফায়ারে নিহত হয় মিত্র বাহিনীর ৮ ভারতীয় সৈন্য। পরদিন সকাল ১০টা পর্যন্ত একটানা যুদ্ধে পিছু হটে পাক বাহীনি। ঘটনায় শহীদ হওয়া ২৫ জনের পরিচয় পাওয়া গেলেও খবর মেলেনি আরও ২৯ শহীদের।
পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী জুট মিলের পাম্প হাউজের ভেতর নিরীহ মানুষ, মিলের শ্রমিক এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে এনে বর্বরোচিত নির্যাতনের পর গুলি করে অসংখ্য লাশ ফেলে দিতো শীতলক্ষ্যায়। সিদ্ধিরগঞ্জ আদমজী জুট মিলের বিহারি ক্যাম্প এলাকাবাসীর কাছে 'জমঘর' হিসাবে পরিচিত। লাশ লুকোবার জন্য পুকুরের পাশে খনন করা হয় কূপ। স্বাধীনতার পর সেখান থেকে উদ্ধার হয় অনেক নর কংকাল।
গণকবরের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে সিদ্ধিরগঞ্জের গোদনাইলে মেঘনা পেট্রোলিয়াম ডিপোতে। এখানেও চিহ্নিত করা হয়নি বধ্যভূমির। একই ঘটনা দেখা যায় পদ্মা পেট্রোলিয়াম ডিপোতে। এখানেও হত্যাযজ্ঞের নির্মম চিত্র ফুটে ওঠে। নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লা পঞ্চবটির পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ঘাটিতেও নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় নিরীহ সাধারণ মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের। যুদ্ধকালীন পুরো ৯ মাস পর্যন্ত এখানে ছিলো নির্যাতন কেন্দ্র ও বধ্যভূমি। বুড়িগঙ্গার পানিতে ভেসে উঠতো হাত-পা বাঁধা পচে গলে যাওয়া লাশ। কোন পরিসংখ্যান নেই সেই সব নির্যাতন আর নৃশংস হত্যার। তবে ‘বধ্যভূমি’ লিখিত একটা সাইনবোর্ড দেখতে পাওয়া যায় মিলের এক পাশে। ১৯৭১ সালের ৭ এপ্রিল ১৬ জনকে একই সঙ্গে গুলি করে হত্যা করা হয় শহরের নিতাইগঞ্জের পোদ্দার বাড়িতে। শাসনগাও মেথর খোলায় রয়েছে গণকবর। যেখানে গর্ত করে রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে হত্যাকৃত অসংখ্য লাশ একসাথে মাটি চাপা দেয়া হতো।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ৯ মাস অগণিত বাঙালিকে হত্যা করা হয় এরকম আরও একটি বধ্যভূমির নাম আলীগঞ্জ সরকারি পাথর ডিপো বধ্যভূমি। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চেই পাকবাহিনী পাগলা মসজিদের ইমাম ও মোয়াজ্জেমসহ ৬ জনকে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। তারপর থেকেই বিভিন্ন স্থান থেকে অসংখ্য বাঙালিকে ধরে এনে এখানে রাতের অন্ধকারে হাতমুখ বেঁধে গলা কেটে হত্যা করে ফেলে দেয়া হতো। এছাড়াও অন্যান্য স্থান থেকে ট্রাকে বোঝাই করে লাশ এনে এখানে ফেলা হতো। বধ্যভূমি সংরক্ষণের দায়িত্ব আমাদের সবার। তবে সরকারি কর্মযজ্ঞ ছাড়া সম্ভব নয় সারাদেশের বধ্যভূমিগুলোর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ। তাই সরকারকেই পালন করতে হবে প্রধান ভূমিকা।
লেখক : আইনজীবী ও কলামিস্ট


