ভাষা সংস্কৃতি ও সমৃদ্ধির দায়


  • অনলাইন ডেস্ক
  • ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৩:২৪,  আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৩:৫৪

বিলকিস ঝর্ণা: ‘নাগরিক জোসনায় পলাশের বসন্ত।
                  এখন তোমাকে ঘিরে খিস্তি-খেউড়ের পৌষ মাস!’
                  (শামসুর রাহমান)
সত্যি ভাষার দিকে আর তাকানো যায় না। আমার বাংলা ভাষা। টেলিভিশনে বাংলা নাটক ভাষাকে নিয়ে ফাজলামোয় মাতে। শ্রদ্ধা আর আন্তরিকতাকে দলিত মথিত করে আঞ্চলিক ভাষা সবসময়ই হাসির খোরাক। বিপন্নের পথে তার বিষন্ন চলন। আমি ভাষার কথা বলছি। আঞ্চলিক ভাষার কথা। ইটভাটার ধোঁয়ায় আমি ফানুস উড়াই। রঙিন ফানুস। অস্থিতি ফানুসে আমার শিকড়ের সন্ধান করি। সন্ধান করি আমার সংস্কৃতির বুনিয়াদ। মায়ার গন্ধে যার বসতি -- জন্ম।

অনেক সময়ের দূরত্বে ক্ষয়ে গেছে আমার মাতৃভাষা। আমি তখন আমার সংস্কৃতি বিসর্জন দিয়ে ভদ্রলোক হতে শুরু করেছি। তলিয়ে গেছি ধীরে আধুনিক সভ্যতায়। সভ্য হবার তাড়নায় আমি সুবোধের মতো পরিহার করেছি আঞ্চলিকতা। আমি আর মনে করতে পারিনা আমার ভাষা, আমার ঐতিহ্য। আমি আমার প্রিয় হাত ঘড়ি মেরামতে হাত দেই। আমার মেরামতের ঘড়ি সময়ের পায়ে পায়ে আর চলতে পারে না। ভাষার প্রসঙ্গ এলেই আমি আবেগ তাড়িত হই। ভাষা আমার কাছে আবেগ -অনুভ‚তি। আমার বেড়ে ওঠা। আমার জীবন যাপন। আমার ভাষা বাংলা।

কদিন আগে আমার হঠাৎ মনে হলো, আমার দাদি যেমন করে কথা বলতো। অথবা আমার মা যেভাবে কথা বলতো বা শব্দ উচ্চারণ করতো। আমি তেমন বলি না। চারপাশের পরিবেশ প্রকৃতি আমাকে বদলে দিয়েছে অনেকখানি। নিজেকে ভদ্র করবার জন্য আমি আমার ভাষা, আমার সংস্কৃতিকে প্রায় মুছে ফেলেছি। তবুও আমার বলবার ভেতর আমার আঞ্চলিকতার টান খুঁজে পায় অন্যের। আর সেই টান থেকেই অনেকে জানতে চায় অন্য কোনও অঞ্চলে আমার বাড়ি। আমার তাতে স্বস্তি হয়। ভদ্রলোকের খোলসের ভেতর অন্য এক নিজেকে দেখতে পাই। আমার সংস্কৃতির ভিন্নতা আমি সেখান থেকেই টের পাই। আমার ভাষার মাধ্যমে উঠে আসে আমার সংস্কৃতি। আমি জানতাম পৃথিবীতে শুধু বাংলা ভাষা নিয়েই বিপ্লব হয়েছে। কিন্তু আসলে এমনটা নয়। পৃথিবীতে আরও অনেক ভাষা আছে। যাকে রক্ষা করবার জন্য সংগ্রাম হয়েছে। বিপ্লব হয়েছে। ভাষার সংগ্রাম হচ্ছে নিজের সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখবার যুদ্ধ। চীন, লাটভিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত কানাডায় মাতৃভাষা রক্ষার সংগ্রাম হয়েছে। ভাষা সংস্কৃতি মুক্তি পেয়েছে। একটা অঞ্চলের সংস্কৃতি সেই অঞ্চলের ভাষা নির্ভর। অথবা ভাষা সংস্কৃতি নির্ভর। যেমন করে আমরা বাঙালি। বাংলা আমাদের রাষ্ট্র ভাষা। সাধু বা চলিত। প্রমিত নিয়ম মেনে ভাষার ব্যবহার হয়। ভাষা চলে তার নিজস্ব গতিতে। তবে রাষ্ট্রীয় সমস্ত কাজে বাংলাভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করা দরকার সবার আগে।

পত্রিকায় পড়লাম ভাষার মাস থেকেই আদালতে রায় লেখা শুরু হয়েছে বাংলা ভাষায়। রায় সাধারণত ইংলিশে লিখিত হয়। রাষ্ট্রীয়ভাবে বিস্তৃত হোক আরও অনেক খানি। আমাদের প্রিয় বাংলা ভাষা। পৃথিবী জুড়েই আগ্রাসনের শিকার ভাষা। পুঁজিবাদীরা নিয়ন্ত্রণ করে ভাষাকেও। ভাষা তাই প্রাণ হারায়। ভাষা হারায় তার নিজস্ব গতি। সভ্যতার আক্রমণে বিস্মৃত প্রায় আমার মাতৃভাষা। দুর্দশাগ্রস্ত আমাদের সংস্কৃতি। প্রত্যেকের আঞ্চলিক ভাষা হচ্ছে তার মাতৃভাষা। বিভিন্ন অঞ্চলের সংস্কৃতির ভিন্নতা, জীবন যাপনের ভিন্নতাই আমাদের চিন্তা- চেতনা -সাহিত্য সংস্কৃতিকে বৈচিত্র্যময় এবং সমৃদ্ধ করে। জীবন জীবিকা আমাদেরকে তাড়িয়ে বেড়ায় বিভিন্ন প্রান্তে। আমরা অভ্যস্থতায় আটকে থাকি। অভ্যস্ত হই পরিবেশের ভেতর। নিজেকে খোঁজার অবকাশ নেই। এমনি করেই ভাষাও মিলিয়ে যায়। বিলীন হয় মাতৃভাষা। আমাদের জীবনের পরতে পরতে আমাদের সংস্কৃতি এবং ভাষাকে আগলে রাখার চেতনা বুনে দিতে হবে ।

প্রকৃতির বিলুপ্তপ্রায় বিপন্ন প্রাণী বা উদ্ভিদের রক্ষা করার জন্য, প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যেমনি করে বিশেষ ভাবে অনুক‚ল পরিবেশ তৈরি করা হয়। আমাদের ভাষার ক্ষেত্রেও সেই চর্চা সচেতনভাবেই করা দরকার। শোষক বাতাস ভাষাকে আহত করবে, এমনটা না হোক। আমারের মায়ের ভাষা বেঁচে থাক আমাদের অন্তরে, বেঁচে থাক দুধে ভাতে। এত সংগ্রামের পথ ধরে আসা ভাষা সংগ্রাম - তার পথ কণ্টকমুক্ত থাকুক এ প্রত্যাশা নিয়েই আমরা দিন পার করতে পারি এমন পরিবেশ হলে সমস্যা কোথায়?

বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন চর্যাপদ। ভাষার উৎপত্তি -উত্থান -জন্ম -ইতিহাস আলোচনায় চর্যাপদ আমাদের সর্বোপরি জরুরি প্রসঙ্গ। এছাড়া আমাদের ভাষার ইতিহাস জানবার তেমন কোনো পথ খোলা নেই। আর সেই চর্যাপদ, কালের সাহিত্য- কালান্তরের সাহিত্য। সবই যার যার সময়ের সাহিত্য। চর্যাপদ বিশ্লেষণে উঠে আসে চর্যাপদের পদ রচনার প্রেক্ষিত। চোখের সামনে ভেসে উঠে সময়ের প্রতিচ্ছবি। কাজেই এটা বলবার অপেক্ষা রাখে না যে, আজকের সাহিত্যই আমাদের আজকের জীবন ধারা এবং ভাষাকে আগামীর দোরগোড়ায় পৌঁছে দেবে। সাহিত্যের ভেতরও তাই আঞ্চলিকতা নিয়ে আসা দরকার। তবে তা হবে সচেতন ভাবে সন্তর্পণে। অত্যন্ত স্পর্শকাতর অবস্থানে আমাদের বর্তমান আঞ্চলিক ভাষা। সাহিত্য ভাষাকে টেনে নিয়ে যায় আগামীতে। সুদূর ভবিষ্যতে। সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধির দায় তাই সাহিত্যিকদেরকেই নিতে হবে। ভাষা এভাবেই এগিয়ে যাবে সাহিত্যের পথ ধরে।

মানবকণ্ঠ/এআই


poisha bazar